শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
আমের পাক করা মিষ্ট মুখচার হল কাঁচা আম ও গুড়। কিঞ্চিৎ লংকা। এ মুখচারের নাম হল আমগুড় বা গুড়াম।
অনিষ্ট আর একটি মুখচার হল আমতেল। কাঁচা আম কেটে সর্ষের তেলে ভিজিয়ে রাখা। এই তেলে ভেজা আম অম্লব্যঞ্জনের কাজে লাগে আর এই তেলমাখা মুড়ি খেতে ভালো লাগে।
আমাদের দেশে আমের যে মুখচার আগে থেকে চলিত ছিল তার নাম আমচুর (অর্থাৎ আম্রচুট, আমচুড়)। কাঁচা আম সরু ফালি ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে রাখা। এই আংশুঁট দীর্ঘস্থায়ী ব্যঞ্জনের সামগ্রী ছিল।
আমের যে মুখচারটি এখন সর্বত্র সমাদৃত তা হল আমসত্ব। মিষ্টি আমের রস রোদে শুকিয়ে মোটা রুটির মতো করে রাখা। এর পুরোনো নাম হল আমোট। এ নাম আমি ছেলেবেলায় শুনেছি। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত আনুমানিক ‘আম্র+পুষ্ট’ থেকে। আম ছাড়া অন্য দু-একটি ফল নিয়েও মুখচার হয়। এ সব ফলের মধ্যে প্রধান হল তেঁতুল।
এইবার বাসনকোসনের প্রসঙ্গ। শরা, খুরি, হোলা। শরা এসেছে সংস্কৃত ‘শরাব’ থেকে। হাঁড়ির মুখের তলার মতো, হাঁড়ির মুখে ঢাকনির মতো ব্যবহারের ও অন্যান্য কাজের জন্য। ‘খুরি’ খুব ছোট শরার মতো তবে তলা গোল নয় চেপটা। শব্দটি খোলা শব্দের খর্বরূপ। ‘হোলা’ মালসারই মতো, তবে আকারে বড়ো। মধ্য বাংলায় শব্দটি ‘হোলনা’ রূপেও মিলছে। কোন বিশেষ রান্নার জন্যেও বিশেষ বাসন তৈরি হয়। যেমন আসকে পিঠের জন্যে। মাটির ‘গেলাস’ এখনকার জিনিস। ও এসেছে ইংরেজি glass থেকে। আামাদের সেকালে জলপানের পাত্র ছিল ‘ঘটী’— ধাতুনির্মিত অথবা ভাঁড়—মাটির গড়া।
পাথরের বাসনের রেওয়াজও কিছু ছিল এবং এখনও আছে। কানা-উঁচু পাথরের থালাকে এখন বলে খোরা। শব্দটি এসেছে ফারসী তেকে ‘খুরা’ মানে খাদ্য অথবা খাওয়া। (এরই খর্বরূপ ‘খুরি’)। আগে বলত ‘পাথরা’ (সংস্কৃত ‘প্রস্তর’ থেকে)।
কবিকঙ্কণ লিখেছেন, ‘মাটিয়া পাথরা’ (কালকেতুর ভাত খাবার পাত্র)। এর দু-রকম মানে হতে পারে। এক মাটির থালা, দুই মেটে পাথরের থালা। শেষের অর্থই সঙ্গততর মনে হয়। কোনো কোনো অঞ্চলে মাঝারি সাইজের বেশি কানা-উঁচু পাথরের পাত্রকে বলে ‘আাধ-খোরা’ (অর্থাৎ খোরার অর্ধেক মাপের)। খোরা-খুরির তলা চেপটা এবং খাড়া ও উঁচু কানা। অন্যরকম হলে বলে এখন ‘পাথরের থালা’, ‘পাথরের-বাটি’। কাঁসা-পিতলের থালায় ভাত খাওয়ার রেওয়াজ পুরোনো নয়। তখন লোকে ভাত খেত থোরা কিংবা কলাপাতায় অথবা শালপাতায় বা পদ্ম পাতে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে একটি পন্ডিতি রসিকতার শ্লোক।
অয়ঃপাত্রে পয়ঃপানং শালপত্রে চ ভোজনম্।
তালপত্রে চ শয়নম্ মল্লভূমি নিবাসিনাম্।।
‘লোহার পাত্রে জলপান, শালপাতায় ভোজন, তালপাতায় (অর্থাৎ চেটাইয়ে) শয়ন—(এ ছিল) মল্লভূমির অধিবাসীদের রীতি।’
(লেহার বাসন, উনুনে চড়াবার বাইরে, অপবিত্র বলে গণ্য হয়ে এসেছে সেদিন পর্যন্ত। ছেলেবেলায় দেখেছি বিধবারা কলাই করা পাত্রেও খেতেন না।)
‘কড়া’, ‘কড়াই’ (সংস্কৃত ‘কটাহ’) লোহার হয়, পিতলের হয়, মাটিরও হয়। ‘হাতা’ (সংস্কৃত ‘হস্তক’ থেকে, মানে হাতের মতো) ও ‘খনতি’ (খুনতি) (সংস্কৃত খনত্রিক থেকে, মানে চাঁচবার ফলক) লোহারও হয়, পিতল কাঁসারও। ‘বেড়ি’ (সংস্কৃত * বেষ্টিক থেকে, হাঁড়ির গলা বেড়ে নামাবার হাতিয়ার) লোহারই দেখেছি। পলা (সংস্কৃত * ‘পলক’ থেকে) লোহার পিতল কাঁসারও হয়। পলায় তেল-ঘি তোলা হয়।
(ক্রমশ)