শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
তাবিজ একদা মাদুলির কাজ করত একথা এখানে মনে করতে হবে। সোনায় মোড়া বাঘের নখও ছেলের গলায় পরিয়ে দেওয়া হত তুক হিসেবে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ উল্লেখ করেছেন।
মেয়েরা ও শিশুরা হাতে শাঁখা পরত।
পায়ের আঙুলের আংটিকে বলে আংটা। সংস্কৃত অঙ্গুষ্ঠক থেকে। হাতের তুলনায় পায়ের মর্যাদা অনেক কম। তাই এই তুচ্ছতা। মনে রাখতে হবে পায়ের গয়না সোনার হয় না। পায়ের বুড়ো দু’আঙুলে মেয়েরা পরে চুটকি। এ আংটাই, তবে উপরে ছোট তোড়া থাকে। চলতে গেলে সামান্য একটু শব্দ হতে পারে।
হাতে যেমন তেমনি পায়েও আংটাগুলিকে পায়ের মলের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত। তখন বলত ‘পাসোলি’, বা ‘পাসুলি’ এখন বলা হয় পাঁইজোর। ‘পাসোলি’ এসেছে সম্ভবত * পাদশলাকিক শব্দ থেকে, ‘পাঁইজোর’ *পাদিক… যোটিক মল হল পায়ের বালার মতো। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত মল্ল থেকে। মল্লেরা পরত বলে এই নাম। মেয়েরা পরে বালার মতো মল নয়, অনন্তের মতো কারুকার্যময় এবং ভিতরে ঘুঙুর দেওয়া—একগাছি করে। অথবা সরু সরু ঢেউ খেলানো—অনেকগাছি করে। এই শেষোক্ত মলকে বলে বাঁক মল। ‘রজতের মল বঙ্ক’। শিশুরাও পরত। ঘুঙুর দেওয়া নূপুরকে এখন বলে ‘বাজন-নূপুর’, চর্যাপদে আছে ‘ঘঙা-নেউর’। মধ্যবাংলায় নেউর, সংস্কৃত ‘নূপুর’ থেকে এসেছে বলে মনে হয়। পাসোলিরই প্রতিশব্দ। এর থেকে হিন্দী ‘পায়েল’ এসেছে। ঘুঙুর দেওয়া মলকে বলত ‘তোড়মোল’ (‘‘মল্ল তোড়ল’’)।
মেয়েরা কোমরে পরত ‘চন্দ্রাহার’। এখনও পরে ‘গোট’ (অর্থাৎ গোটা গোটা দানার হার) অথবা বিছা (বৃশ্চিকের মতো গড়া বলে) কিংবা ‘দড়া’ হার।
কোমরে ঘুঙুর জড়াত সেকালে বিলাসিনী নারীরা এবং মল্লযোদ্ধারা। সংস্কৃতে বলত ‘কিঙ্কিনী’। বাংলায় বলত ‘ঘাঘর’ (সংস্কৃত *ঘর্ঘর থেকে)। কোমরে ঘুঙুর বাঁধা যোদ্ধার উল্লেখ পাই ছেলেভুলানো ছড়ায়—
আগা ডোম বাগা ডোম ঘোড়া ডোম সজে
ঢাল মেঘর ঘাঘর বাজে।
‘অগ্রগামী ডোম যোদ্ধা, বাঘের মতো ডোম যোদ্ধা, বর্ষাবৃত ডোম যোদ্ধা সেজে চলেছে। (তাদের) ঢালে আর কোমরবন্ধে ঘুঙুর বাজছে।’
এইবার প্রসাধনের প্রসঙ্গ।
প্রসাধনের সামগ্রী ছিল চারটি— গামছা, চিরুনি, আরশি ও কাজললতা। প্রসাধনের দ্রব্যগুলি—তেল হলুদ, কাজল, চন্দন, আলতা ও সিঁদুর। গামছার প্রাচীন প্রতিশব্দ ছিল *নেপথ্যসবন। আধুনিক ‘গামছা’ এসেছে ‘‘গো মোছা’’ থেকে। চিরুনির প্রাচীন প্রতিশব্দ ‘কাঁকুই’ এখনো অঞ্চলবিশেষে শোনা যায়। কাঁকুই এসেছে সংস্কৃত কঙ্কত (* ‘কঙ্কতিক’) থেকে। ‘চিরুনি’ শব্দ আধুনিক। মানে, যাতে চেরা যায়। এটিকে কাঁকুইয়ের বিশেষণ রূপে প্রথমে মিলেছে। চিরুনির সঙ্গে ‘কুরুন শব্দ তুলনীয়। ‘কুরুনি’ নারকেল কোরার ছুরির মতো। ‘আরশি’ও আধুনিক শব্দ। এসেছে সংস্কৃত * আদৃশ্য (আদর্শ) থেকে। পুরনো প্রতিশব্দ হল দাপণ, দাপুনি (সংস্কৃত দর্পণ থেকে)। আধুনিক প্রতিশব্দ আয়না ফারসী থেকে এসেছে।
কাজলপাতায় থাকত কাজল, যা চোখের কোলে লাগান হত চোখের সৌন্দর্য বাড়াবার জন্যে। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘কজ্জলপত্র’ থেকে। পাত্রটির গঠনে বিশেষত্ব আছে। সঙ্গে রাখা হত বলে হালকা, হাতলওয়ালা ডবল চামচের মতো। বিবাহের পূর্বে কন্যাকে হাতে রাখতে হয়।
তেল এসেছে সংস্কৃত তৈল থেকে। আসল মানে ছিল তিলের নির্যাস, পরে যে কোনো শস্যবীজের নির্যাস—যেমন সর্ষের তেল, রেড়ির তেল। তেমনি হয়ে গেছে তিলের তেল। হলুদ এসেছে সংস্কৃত হরিদ্রা থেকে। তিলের অথবা সর্ষের তেল আর হলুদ বাটা ছিল সেকালে এখনকার সাবান ও ক্রীমের প্রতিনিধি। কাজল এসেছে সংস্কৃত ‘কজ্জল’ থেকে।
(ক্রমশ)