শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
মানে, অত্যন্ত সরু হার (এই থেকে হেলে সাপেরও নাম)।
‘চন্দ্রহার’ চাঁদের মতো গাঁথা। কোমরেও পরা হত। দেবতার গলায় যে চাঁদমালা দেওয়া হয় তারই প্রতিরূপ গয়না। মুক্তো হারও ব্যবহার হত। একটি চর্যা-গানে ‘মুক্তাহার’ (সংস্কৃত মৌক্তিক হার থেকে) উল্লিখিত আছে।
সধবা নারীর গলায় কোন কিছু না থাকা অমঙ্গলজনক মনে হত। তাই দরিদ্র নারী গলায় সুতোর হার পরত (এবং এখনও পরে)। সোনার মতো সুতোও একদা গলায়, হাতে ও কোমরে পরা হত। এখনো হয় বিশেষ বিশেষ কারণে।
সুতোর হার পরার স্মৃতির ফসিল রয়ে গেছে এখানকার ‘দড়া’ হারে। এ-হার দড়ির মতো পাকানো।
ঊর্ধ্ববাহুর বালা অথবা সেইরকম গয়না সংস্কৃতে ‘কেয়ূর’ ও ‘অঙ্গদ’ নামে প্রসিদ্ধ ছিল। এখন প্রচলিত আছ দুটি ফারসী শব্দ, ‘বাজু’ (সংস্কৃত বাহুর প্রতিরূপ) এবং ‘তাগা’ (আরবী থেকে আগত?)। পুরো ফারসী শব্দ বাজুবন্দও বলা হয়। এই ধরনের বালা—সাপের দুটি মুখঅলা—বাজু হিসাবেই বেশি চলে—‘অনন্ত’ নামে খ্যাত। (‘অনন্ত হল শেষ নাগের নাম)। চতুর্থ নাম হল ‘তাবিজ’। এও ফারসী থেকে এসেছে। ‘ত্যগা’ ও ‘তাবিজ’ সমার্থক।
উপরের হাতে মন্ত্রপূত সুতোর বেড়কেও বলে ‘তাগা’। নীচের হাতে পরে বালা, কাঁকন, চুড়ি, বাউটি ও পৈঁছে। বালা এসেছে সংস্কৃত ‘বলয়’ থেকে। গোলগাল একটু আলগা। উপরের হাতেও পরত। কাঁকন এসেছে ‘কঙ্কণ’ থেকে। চেপটা সোনার পাত, পালিশ করা। সরু বালাকে বলে ‘রুলি’। শব্দটির মানে হল নিরেস বালা।
কঙ্কণ উপর হাতেও পরত। কঙ্কণ উপহার দিয়ে সেকালে রাজারা কবিদের পুরস্কৃত করতেন।
‘চুড়ি’ শব্দ আধুনিক। ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে সরু ফালি (চূর্ধ)। চুড়ি সরুই হয়। ‘রতনচূড়’-এর ‘চুড়’ শব্দ এই সঙ্গে তুলনীয়।
‘বাউটি’ এসেছে সংস্কৃত * বাহুপট্টিক থেকে। ব্যুৎপত্তি ধরে চিন্তা করলে বলতে হয় বাউটি আগে উপর হাতে পরা হত। বাউটি আঁটসাঁট, তাই খিল দেওয়া। ইংরেজী bracelet-এর সমার্থক।
পৈঁছা এসেছে সংস্কৃত *প্রতীক্ষক থেকে। মানে দর্পণ। সুতরাং এ শব্দটি কঙ্কণেরই প্রতিশব্দ। এখন শব্দটি অব্যবহৃত।
মেয়েদের পক্ষে হাতের পরা চুড়ি ইত্যাদির মধ্যে সবচেয়ে পবিত্র হল কড়। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘কট’ থেকে, মানে খড়কুটায় গড়া। কড় হল মাটির বালা, লাল রঙ করা। বিয়ের সময় কনেকে কড় পরতে হয়। (শব্দটির সঙ্গে ‘কড়া’ ‘লোহার বালার মতো বস্তু’ শব্দের যোগ আছে।) সদ্যোবিবাহিত মেয়ে বিধবা হলে তাকে বলে ‘কড়ে রাঁড়ি’, অর্থাৎ কড় পরা অবস্থায় পতিহীন হয়েছে।
(ক্রমশ)