• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

বাঙালির ভাষা

বিলাসিনী মেয়েরা দুপাশে কান ঢেকে চুল বাঁধত। তাকে বলত ‘কানোড়ি’ বা ‘কনোড়’ (অর্থাৎ কান ঢাকা) খোঁপা। মাথার উপর চুড়ো করে চুল বাঁধাকে সংস্কৃত বলত ‘শিখন্ড’।

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

Advertisement

চিরকালই আমাদের দেশের মেয়েরা চুল রাখে। সেকালে ভদ্রলোকেও রাখত। মেয়েরা সাধারণত চুলে খোঁপা বাঁধত। পুরুষেরা কখনও কখনও চুল গুটিয়ে রাখত, তবে খোঁপা বাঁধত না। ‘খোঁপা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘ক্ষুম্পক’ থেকে। মানে, ছত্রাক (), ‘ক্ষুপ’— যার থেকে ‘ঝোপ’ এসেছে, সেটিও এর সঙ্গে সংলগ্ন। পুরনো ভাস্কর্যে ও চিত্রে সেকালের মেয়েদের বিচিত্র খোঁপা বাঁধার নমুনা পাওয়া যায়। সাহিত্যে দুই একটি নাম আছে। পুরুষেরা ও কাজের মেয়েরা অনেক সময় চুল মাথার উপর চূড়ার মতো করে বাঁধত।

Advertisement

বিলাসিনী মেয়েরা দুপাশে কান ঢেকে চুল বাঁধত। তাকে বলত ‘কানোড়ি’ বা ‘কনোড়’ (অর্থাৎ কান ঢাকা) খোঁপা। মাথার উপর চুড়ো করে চুল বাঁধাকে সংস্কৃত বলত ‘শিখন্ড’। গোপাল-কৃষ্ণের এইভাবে চুল বাঁধা হত। ‘বিনুনি’ (সংস্কৃত*বয়নাপনিক্, অর্থাৎ knittex সংস্কৃত ‘বেণী’) করে মাথার উপর অবাঁধা চুলকে বলত কপর্দ (বাংলা ‘কড়ি’ তেমনি দেখতে বলে)। আর ঘাড়ের কাছে বাঁধা হলে বলত ‘কবরী’  ছেলেরা ঘাড় পর্যন্ত চুল রাখত। তাকে বলে ‘ঘোড়া চুল’।

সেকালে রাজরাজড়া ও খুব ধনী ব্যক্তিরা চুল রাখতেন। একথা আগে বলেছি। তাঁদের পার্শ্বচর বিশ্বস্ত ভৃত্যেরা কিন্তু সর্বদা মাথা নেড়া রাখত। এব্যাপারে মিলটা দুতরফ থেকে। পুরোনো ছবিতে সর্বদাই পার্শ্বচর ভূত্যের মাথা নেড়া। সাহিত্যেও দেখি এমন ভৃত্যের সাধারণ নাম ‘নেড়া’ বা ‘নাড়া’। শব্দটি এসেছে নারিকেলের পুরনো প্রতিশব্দ (যা এখনও উড়িষ্যার চলিত আছে) ‘নড়িয়া, নাড়িয়া’ থেকে।

ভদ্রপুরুষদের মধ্যে চুল রাখার ফেশন কমে যেতে থাকলে তার পরিবর্তে শিখা অর্থাৎ ‘টিকি’ রাখার ফেশন বাড়তে লাগল ব্রাহ্মণ সমাজে। এই টিকি রাখা হত মাথার মাঝখানে। চৈতন্য মতাবলম্বী বৈষ্ণবেরাও শিখা রাখতেন। এঁরা অনেক সময়, এবং গৃহস্থ হলে, ঘাড়ের নীচে টিকি রাখতেন। লেকে ঠাট্টা করে বলত ‘চৈতন্য-চুটকি’। টিকি অর্থে চৈতন শব্দটি এসেছে ‘চৈতন্য’ নাম থেকে।

গোঁফ-দড়ি রাখা না রাখা সেকালে ইচ্ছাধীন ছিল। সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে গোঁফ-দাড়ি রাখা নিয়ে দুটি দল ছিল। এক দলে দাড়ি-গোঁফ ও মাথার চুল কামানো হত। এঁরা শঙ্করাচার্যের পন্থাবলম্বী সন্ন্যাসী। দাড়ি গোঁফ চুল সবই রাখতেন যোগী ও তান্ত্রিক সাধকেরা। বৈষ্ণবদের মধ্যেও এইরকম বিভাগ দেখা যায়। যাঁরা শাস্ত্রনিষ্ঠ তাঁরা গোঁফদাড়ি কামান, আর যাঁরা বাউল-ভাবের, তাঁরা দাড়িগোঁফ চুল সবই রাখেন। বিলাসী ও বীর গোঁফের বাহার করত। শ্রীচৈতন্য একদা এক নাট্যাভিনয় করিয়েছিলেন। তাতে হরিদাস কোটাল সেজেছিলেন। ‘‘মহা গোঁফ করিয়া বিন্যাস।’’

(ক্রমশ)

Advertisement