সুরের আকাশে মান্না দে

গানের জলসাঘরে আজ তিনি নেই, কিন্তু অগণিত সংগীতপ্রেমী ভারতবাসীর জীবনের জলসাঘরে তাঁর স্থান অটুট, সেখানে তিনি অমর– সর্বভারতীয় সংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে বেঁচে থাকবেন যতদিন সংগীত বেঁচে থাকবে। ইনিই মান্না দে, যাঁর পোশাকি নাম ছিল প্রবোধচন্দ্র দে। মা আদর করে ডাকতেন মান্না বলে। মুম্বইয়ের সংগীতজগতে সেই মান্নাই একদিন রূপ নেয় মান্না দে’তে।

Written by Manasi Bhattacharya Kolkata | May 1, 2019 2:45 pm

( Photo: Twitter/@NFAIOfficial)

গানের জলসাঘরে আজ তিনি নেই, কিন্তু অগণিত সংগীতপ্রেমী ভারতবাসীর জীবনের জলসাঘরে তাঁর স্থান অটুট, সেখানে তিনি অমর– সর্বভারতীয় সংগীতের আকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হয়ে বেঁচে থাকবেন যতদিন সংগীত বেঁচে থাকবে। ইনিই মান্না দে, যাঁর পোশাকি নাম ছিল প্রবোধচন্দ্র দে। মা আদর করে ডাকতেন মান্না বলে। মুম্বইয়ের সংগীতজগতে সেই মান্নাই একদিন রূপ নেয় মান্না দে’তে।

১৯১৯ সালের ১ মে কলকাতার ১৯, মদন ঘােষ লেনে এক যৌথ পরিবারে মান্না দে জন্মগ্রহণ করেন। অত্যন্ত ছটফটে, দুরন্ত ও দুষ্টু ছেলে ছিলেন ছোটবেলায়। তাঁদের ছিল এক ডাকসাইটে গ্রুপ, যাদের কাজই ছিল নানা জায়গায় উৎপাত করে বেরানো। বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে ফুটবল ও অন্যান্য খেলা খেলতে যাওয়া ও কারণে-অকারণে অন্য দলের সঙ্গে মারামারি করা ছিল রোজকার ঘটনা। ঘুড়ি ওড়ানো ছিল আর এক নেশা। গ্রীষ্মের দুপুরে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে আচার চুরি করে খাওয়া, শীতকালের দুপুরে ভাঙা ব্যাট আর ক্যাম্বিসের বল নিয়ে ক্রিকেট খেলতে গিয়ে অন্যের বাড়ির জানালার কাঁচ ভাঙা ছিল নিত্যকার ঘটনা।

একটু বড় হলে কুস্তি লড়া ও বক্সিং খেলার দিকে ঝোঁক গেল। শিখেছিলেন বিখ্যাত কুস্তিগীর ও বক্সিং মাস্টারদের কাছে তাঁদের আখরায় ভর্তি হয়ে। গান বাজনার সঙ্গে মান্না দে’র তখনও পর্যন্ত কোনও যোগাযোগ ছিল না। এমনকী বাবা পূর্ণচন্দ্র এবং অন্য কাকারা চাননি যে, প্রবোধচন্দ্র বড় হয়ে সংগীত শিল্পী হিসেবে পরিচিত হন। বরং চেয়েছিলেন তিনি পারিবারিক পেশা মতো আইনজীবী হন।

মান্না দে’র বাড়িতে কিন্তু গানের পরিবেশ ছিল। ছোটকাকা প্রবাদপ্রতীম গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে’র সুবাদে, বলা যেতে পারে গানের পীঠস্থান ছিল ওই বাড়ি। কারণ প্রায়ই বড় বড় ওস্তাদদের আনাগোনার সঙ্গে সংগীতের আসর বসত সেখানে। পাঠকের পরিবেশও ছিল বাড়িতে। ওই আবহে বড় হয়েছিলেন মান্না দে।

স্কুল শেষে স্কটিশ চার্চ কলেজে যখন পড়তে এলেন, সে সময়ে মান্না দের জীবনে এল এক ঢার্নিং পয়েন্ট। টিফিনের সময় সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে প্রতিদিনই চলত উদাত্ত গলায় গান। ইংরাজী গানের সঙ্গে সেই তাঁর প্রথম পরিচয়। খুলে গেল এক বিস্তীর্ণ জগৎ। বন্ধুরা ‘ইন্টার কলেজ কম্পিটিশন’-এ গিয়ে তাঁর নাম দিয়ে দিল। শুরু হল আক্ষরিক অর্থে কাকার কাছে তাঁর গান শেখা। কাকার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল না। সংগীতের প্রায় প্রতিটি বিভাগে যেমন, ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, গজল, কীর্তন, বাউল, ভাটিয়ালী সবেতেই তিনি প্রথম হলেন। পরপর তিন বছর ‘ইন্টার কলেজ কম্পিটিশন’-এ চ্যাম্পিয়ন হয়ে তিনি এনেছিলেন এক সম্মানীয় উপহার– রুপোর তানপুরা, যা এখনও কলেজের একটা গর্বের স্মৃতি। এরপর একবার ‘অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশন’-এও অংশগ্রহণ করেন এবং সব বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন।

এরপর মান্না দে’র জীবনে এল অবশ্যম্ভাবী আরও কিছু পরিবর্তন। কাকা কৃষ্ণচন্দ্র দে কিছুদিনের জন্য মুম্বই গেলেন দেবকী বসুর ছবিতে সংগীত পরিচালনার জন্য। ফিরে এলে আবার শুরু হল সংগীত শিক্ষা। গান শেখা চলাকালীন একটু একটু করে নতুন ইচ্ছে অঙ্কুরিত হতে থাকে মনের ভিতরে। স্টুডিওতে কাকা কীভাবে গান তোলান, যন্ত্রীদের কীভাবে সুর তোলান, কীভাবে গান রেকর্ডিং করেন তা জানতে ঔৎসুক্য দিনে দিনে বাড়তে থাকে। কাকাকে একদিন ইচ্ছা প্রকাশ করেই ফেলেন। তখন কলকাতায় যশস্বী বীরেন্দ্রনাথ সরকার মশাই ‘নিউ থিয়েটার্স’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে সংগীত পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন কৃষ্ণচন্দ্র দে, স্বনামধন্য রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক, তিমির বরণ, ক্ষমচাঁদ প্রকাশ প্রমুখ সংগীত জগতের রথী মহারথীরা।

কাকার সঙ্গে একদিন হাজির হলেন তিনি, সেই জ্যোতিষ্ক সমাবেশে। সঞ্চয় করতে শুরু করলেন নানা অভিজ্ঞতা। কী করে সুর দিতে হয়, গান তোলাতে হয়, মূল সংগীতের আগে পরে প্রিলিউড ইন্টারলিউড মিউজিক তৈরি করতে হয়, কোন সুরে কী ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা তুলে রাখলেন মনের খাতায়। শুরু হল মান্না দের উত্তরণের সাধনা। তিনি কাকার সহকারী সংগীত পরিচালক রূপে নিযুক্ত হলেন।

এরপর ১৯৪২ সালে এল মান্না দে’র জীবনে আর এক টার্নিং পয়েন্ট। কাকার সর্বক্ষণের সঙ্গী হিসেবে, তাঁর সহকারী হিসেবে মুম্বই যাত্রা করলেন। ‘লক্ষ্মী প্রোডাকশনের’ ব্যানারে ‘তমান্না’ ছবিতে সংগীত পরিচালনা করলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে। মিউজিক অ্যারেঞ্জ করার দায়িত্ব মান্না দে’র। তাঁর জীবনে প্রথম প্লে-ব্যাক গাওয়ারও সুযোগ এল একটি ফুটফুটে বাচ্চা মেয়ে, পরবর্তীকালের গায়িকা ও নায়িকা সুরাইয়ার সঙ্গে ‘তমান্না’ ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন ‘জাগো আঈ উস্কা’। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৩ সালে প্রথম একক ‘রামরাজ্য’ ছবিতে। ছবিটির হিন্দি ও মারাঠী ভার্সানের জন্য দুই ভাষাতেই মান্না দে গাইলেন। সুরকার শঙ্কর রাও ব্যাস। চলতে চলতে সংগীত জীবনে প্রথম, একটা বড় মাপের ব্রেক পেলেন। সেটা ‘অমর ভূপালী’ নামের একটি ছবিতে। এ ছবির বাংলা ও মারাঠী দুটি ভার্সানেই তিনি গানগুলি গেয়েছিলেন। বেশ কয়েকবছর মুম্বইতে বিভিন্ন দিকপাল সংগতি পরিচালকদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। অবশেষে ১৯৫৩ সালে সেই দিনটি এল, যেদিন শচীন দেব বর্মণ তাঁর ‘মশাল’ ছবিতে ‘উপর গগন বিশাল’ গানটি গাইতে দিলেন। সারা ভারতে সংগীত জগতে এক নতুন বার্তা ছড়িয়ে পড়ল। সে সময় বম্বেতে শচীন দেব বর্মণের সহকারী হিসেবে তিনি কাজ করতেন। এরপর জীবনের মোড় ঘুরে গেল আর একবার রাজ কাপুরের সঙ্গে বন্ধুত্বের পর। একের পর এক হিট গান খ্যাতির শিখরে পৌছে দিল মান্না দে’কে। ‘লাগা চুনরিমে দাগ’, ‘পুছোনা ক্যায়সে’, ‘জিন্দেগী ক্যায়সি হ্যায় পহেলি’, ‘এ ভাই জরা দেখকে চলো’, ‘আয় মেরি প্যায়ারি ওয়াতন’, তালিকা আরও দীর্ঘ। লতার সঙ্গে তার ‘প্যার হুয়া ইকরার হুয়া’ বা ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’ হিন্দি গানে সেরা ডুয়েটের অন্যতম।

কাকা প্রবাদপ্রতীম কৃষ্ণচন্দ্র দে ছিলেন মান্না দে’র সংগীতগুরু, তাঁর দেবতা, মাও ছিলেন এক অন্য জগতের জ্যোতিষ্ক, সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে থাকা চিন্তা-ভাবনার মানুষ। মা মহামায়া তাকে বলতেন, ‘বাঙালির ছেলে বাংলা গান কখন গাইবি?’ ১৯৫৩ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় নিজের সুরে ‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে বল’র মধ্য দিয়ে বাংলা আধুনিক গানে মান্না দে’র যাত্রা শুরু। প্রশ্ন জাগে, মান্না দে এত যে প্রেমের গান গেয়েছেন তা কাকে উদ্দেশ্য করে?

মান্না দে’র জীবনে এসেছিলেন এক নারী, নাম সুলোচনা কুমারণ, পরে হয়েছিলেন মুম্বইবাসী। এই সুলোচনা দেবীই ছিলেন মান্না দে’র প্রেমের গানের উৎস। ১৯৫৩ সালে তাঁদের প্রেমের বিয়ে। সুলোচনা দেবীই তাঁর জীবনে সৃষ্টির উৎস ও প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছিলেন। তাই একদিন তিনি গেয়ে ফেললেন ছায়াছবির নেপথ্যে ভীমসেন যোশীর সঙ্গে বিখ্যাত ডুয়েট গান ‘কেতকী গুলাব জুঁহি চম্পক বনফুল’। উচ্চাঙ্গ সংগীত জগৎ ভরিয়ে দিয়েছিল উষ্ণ আলিঙ্গনে। আর একবার সলিল চৌধুরি তার সুরে ‘চেমিন’ নামে একটি মালায়ালম ছবিতে মান্না দে’কে গাইতে বললেন। সেবারেও সুলোচনা দেবীর প্রচেষ্টাতেই মালয়ালম ভাষায় উচ্চারণ শিখে গানটি গাইলেন। সেই গানটির সুবাদে শ্রেষ্ঠ সুরকার ও শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার লাভ করেছিলেন তিনি ও সলিল চৌধুরী। পুরস্কারটি দিয়েছিল কেরালা সরকার। এই একই গানের জন্য ইন্ডিয়ান মোশন পিকচারস পারফরমার্স অ্যাসোসিয়েশনের কাছে তিনি শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কারটিও পেয়েছিলেন।

মান্না দের জীবনে শচীন দেব বর্মণের ভূমিকা অসাধারণ বলে লিখেছেন তিনি। শচীন দেব বর্মণের সুরে ‘মশাল’ ছবির পরে ‘দেবদাস’ ছবিতে গীতা দত্তের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে, এরপর ‘তালাশ’ ছবিতে ‘খোই খোই আঁখে হ্যায়’, ‘মঞ্জীল’ ছবির ‘হাটো কাহে কো ঝুট বনাও বত্তিয়া’ আর ‘মেরি সুরত তেরে আঁখে’ ছবির ‘পুছনা ক্যায়সে ম্যানে বিন বিতাই’, ‘উপসার’ ছবিতে ‘পিয়া ম্যায়নে কি কিয়া’ গানগুলি শ্রোতাদের মনে এক গভীর ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে আছে। আনন্দ বক্সীর কথায় শচীন কর্তার সুরে আর একটি গান ‘মেরে সব কুছ মেরে গীতমে’।

শচীন দেব বর্মণের পরে সুরকার জুটি শঙ্কর। জয়কিষাণের সুরে মান্না দে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। গান হতে লাগল নায়ক বা অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের লিপে। ‘আওয়ারা’ ছবিতে শৈলেন্দ্রজির লেখা গানটি ছিল ‘তেরে বিনা আগ হয়ে চাঁদনি’। এরপর ‘বুট পালিশ’ ছবিতে ‘লপক ঝপক তু আয়ে বাদেরিয়া’, ‘শ্রী ৪২০’ ছবিতে ‘দিল কা হাল শুনে দিলওয়ালা’, ‘চোরি চোরি’ ছবিতে ‘ইয়ে বাত ভিগি ভিগি’, ‘উজালা’ ছবিতে ‘ঝুমতা মৌসম’, ‘মেরে হুজুর’ ছবিতে ‘ঝনক ঝনক তেরি বাজে পায়েলিয়া’, ‘বসন্ত বাহার’ ছবিতে ‘সুর না সাজে’ প্রভৃতি গান গেয়ে তিনি সেই সময়কার হিন্দি ছবির জগতে নিজের আসন চিরকালের জন্য পাকা করে নেন।

গীতিকারদের মধ্যে সাহির লুধিয়ানভি, হসরত জয়পুরী, ইন্দিবর, জয়দেব এঁদের কথায়ও খুব ভালো ভালো গান গেয়েছিলেন মান্না দে। শৈলেন্দ্রজি’র কথায়, সলিল চৌধুরির সুরে, ‘দো বিঘা জমিন’ ছবিতে গেয়েছেন ‘ভাইরে, ‘গঙ্গা আউর যমুনা কী’ গানটি। লতার সঙ্গে ডুয়েট গেয়েছিলেন ‘হরিয়ালা শাওন চোল বাজাতা’। হসরৎ জয়পুরীর লেখা গান গেয়েছিলেন ১৮৫৬ সালে ‘কিসমত কা খেল’ ছবিতে। আর একজন পছন্দের গীতিকার ভরত ব্যসজি’র লেখা বেশ কয়েকটি গান বিভিন্ন ছবিতে তিনি গেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে জনপ্রিয় নায়ক অমিতাভ বচ্চনের পিতা হরবন্স রাই বচ্চনের লেখায় সুরের জাদুকর জয়দেবের সুরে মান্না দে গেয়েছিলেন ‘মধুসালা’র অমূল্য গানগুলি। প্রথিতযশা সুরকার অনিল বিশ্বাসের সুরে গেয়েছিলেন ‘হামদর্দ’, ‘মেহমান’, ‘মহাত্মা কবীর’, ‘অভিমান’, ‘পরদেশী’, ‘অঙ্গুলিমান’ ইত্যাদি ছবিতে। এছাড়া অনিলবাবুর সুরে চারটি রাগের ব্যবহারে ‘ঋতু আয়ে ঋতু যায়ে’ এই বিখ্যাত গানটিও গেয়েছিলেন।

সংগীত পলিচালকদের মধ্যে নৌশাদজি’র কথা না বললেই নয়। নৌশাদজি’র সুরে মান্না দে গেয়েছিলেন ‘শরাব’ ছবিতে ‘ভগৎ কে বসমে হ্যায়’ ও ‘সংগীত হ্যায় ঈশ্বরকি’ গানটি ‘মাদার ইন্ডিয়া’ ছবিতে এবং ‘পালকি’ ছবিতে ‘মেরে ঘরমে পালকি চলি গই’ ও আরও কিছু গান যেগুলি দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল। মদনমোহনজিও পাঞ্জাবি লোকগীতির সঙ্গে বিশুদ্ধ রাগ সংগীতকে যুক্ত করে এক নতুন সুরের ধারা এনে দিয়েছিলেন হিন্দি ছায়াছবিতে। ‘ইলজাম’ ছবিতে ‘ইয়ে দুনিয়া কাঁটো কে বাগিয়া’ প্রথম মান্না দে গেয়েছিলেন ওঁর সুরে, তারপর ‘ছোটবাবু’ ছবিতে ‘তুমি মেরে স্বামী অন্তর্যামী’। ‘দেখ কবীরা রোয়া’ ছবিতে ‘কৌন আয়া মেরে মনকে দ্বারে’ এবং ‘বৈরাগ হো ভারী রৈন’, ‘শেরু’ ছবিতে ‘প্রভু দ্বার চালি’, ‘নবাব সিরাজদৌল্লা’ ছবিতে ‘আজ মিলে মনকি মিত’, ‘সুহাগন’ ছবিতে লতার সঙ্গে ‘ভিগি চান্দনি’, ‘আখরি দাও’ ছবিতে ‘হরতরফ অব ইয়েহি আফসানে হ্যায়’ এবং ‘দিল কি রাহে’ ছবির গান তো অমরত্বের পর্যায়ে চলে গেছে।

মান্না দে’র সংগীত জীবনে সলিল চৌধুরীর প্রভাব কিছু কম নয়। সলিলবাবুর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ‘বোম্বে ইউথ কয়্যার’। উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্যকে এক সূত্রে গাঁথা। মান্না দে’র গাওয়া ‘ধন্য আমি জন্মেছি মা’ বা ‘মানবো না এ বন্ধনে’ মানুষের মনে এক প্রেরণা জাগায়। সলিলবাবুর সুরে ‘দো বিঘা জমিন’ থেকে শুরু করে ‘আমানত’ ছবিতে ‘চেতরে সুরখ চেতরে’, ‘কিউ রোয়ি’ এবং ‘ছল ছল পানি হামারি’ গান তিনটি ‘জওহর’ ছবিতে ‘হো জী হো দিন হোলিকা’, ‘জমানা’ ছবিতে ‘নই দুনিয়া অ্যায়সি ওরসি’ এবং ‘হিম্মত না হার আয়ে বন্দে’ গান দুটি ‘মধুমতী’ ছবিতে এবং ‘আনন্দ’ ছবিতে ‘জিন্দেগী ক্যায়সী হয় পহেলি’ গানগুলি জনপ্রিয়তার সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। সুরকার কল্যাণজি আনন্দজি’র সুরে ‘ইন্দিরাজি’র লেখা ‘কসমে ওয়াদে প্যার ওয়াফা সব’ গানটি গেয়েছিলেন ‘উপকার’ ছবিতে। কল্যাণজি আনন্দজি’র সুরে ‘তমান্না’ ছবিতে ‘তুম প্যার করতা, অ্যায়সে’, ‘হাসিনা মান জায়েগি’ ছবিতে ‘মেরে মেহেবুব’ এবং ‘জঞ্জীর’ ছবির ‘ইয়ারি হায় ইমান মেরা’ সব জনপ্রিয়তার শীর্ষে পেীছেছিল।

সংগীত পরিচালক রবিজি’র সুরে মান্না দে প্রথম গেয়েছিলেন ‘অযোধ্যাপতি’ ছবিতে। অন্যান্য গানের মধ্যে ‘ওয়াক্ত’ ছবির ‘অ্যায় মেরি জোহরা জবি’ এখনও পর্যন্ত ভীষণ জনপ্রিয়। রাজ কাপুরের ছবি ‘ববি’ তে মান্না দে লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল জুটির সুরে গেয়েছিলেন একটি জনপ্রিয় গান ‘না চাহু সোনা চাঁদি’। সেই সময় বিখ্যাত সুরকার রোশনজির সুরেও তিনি কিছু গান গেয়েছেন। এর মধ্যে ‘দিল হি তো হ্যায়’ ছবির ‘লাগা চুনরি মে দাগ’ গানটি অমরত্বের পর্যায়ে চলে গেছে।

হিন্দি সিনেমায় নেপথ্য সংগীতজীবনের একদম শেষের দিকে মান্না দে পেয়েছিলেন রাহুল দেব বর্মণকে। ‘ভূত বাংলা’ ছবিতে তিনি মান্না দে’কে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি গান গাইয়েছিলেন- ‘আয়ো টুইস্ট করে’। গানটি ছিল এক বিখ্যাত আমেরিকান সিঙ্গারের ‘কাম লেট আস টুইস্ট’ গানটির অনুকরণে। ভারতীয় লঘু সংগীত জগতে এটিকে প্রথম র্যা প গান বলা যেতে পারে। ‘বুঢঢা মিল গয়া’ ছবিতে একই সুরকার বিশুদ্ধ রাগসংগীতের আধারে ‘অ্যায়ো কাঁহাসে ঘনশ্যাম’ গানটি মান্না দে’কে দিয়ে গাইয়েছিলেন। এছাড়া ‘মেহেবুবা’, ‘চাঁদি সোনা’, ‘পরায়া ধন’, ‘সীতা আউর গীতা’, ‘পতি পত্নী’ ছবিতে গাওয়া গান ইতিহাস হয়ে আছে। পঞ্চমের সুরে মান্না দে ও কিশোর কুমারের দ্বৈত কণ্ঠে গাওয়া ‘পড়োশান’ ছবির ‘এক চতুর নার’ এবং ‘শোলে’র ‘ইয়ে দোস্তি হাম নহী তোড়েঙ্গে’ গান দুটি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
লতা মঙ্গেশকর মান্না দে’র বিচারে এক ইনস্টিটিউশন। লতার কথা অনুযায়ী ওঁর সঙ্গে মান্না দে’র ডুয়েট গানের সংখ্যা একশো সত্তর। হিন্দি, বাংলা, মারাঠী, ভোজপুরী, অসমিয়া, ওড়িয়া থেকে আরম্ভ করে তামিল, তেলেগু, মালায়ালম ভাষায়। লতার সঙ্গে ডুয়েট প্রথম গেয়েছিলেন ‘আওয়ারা’ ছবিতে, তারপর ‘অমর ভূপালী’ থেকে আরম্ভ করে হাল আমলের ‘পুস্পাঞ্জলি’ ছবিতে। দেশেবিদেশে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন দু’জনে। হিন্দি ছবিতে শচীন কর্তা দরবারী কানাড়ায় একটি গম্ভীর কম্পোজিশন করেছিলেন– ‘প্যায়র কে আগমে তনবদন জ্বল গয়া যা হিন্দি সিনেমার জগতে এক আদর্শ পিকচারাইজেশনের দাবি রাখে।

মুম্বইতে কাজের দাবিতে পড়ে থাকলেও মান্না ছিলেন মনেপ্রাণে বাঙালি। তাঁর প্রথম বাংলা গান গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও নিজের সুরে ১৯৫৩ সালে ‘আর কত দূরে নিয়ে যাবে বল’ ও ‘হায় হায় গো রাত যায় গো’। ১৯৫৬ সালে পরপর কয়েকটি বাংলা গান গেয়েছিলেন। সেই বছরই প্রথম সুযোগ পান বাংলা সিনেমায় প্লে-ব্যাক করার। ১৯৫৬ সালে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে ‘এক দিন রাত্রে’ ছবিতে ‘এই দুনিয়ায় ভাই সবাই হায়’ গানটি গেয়েছিলেন। ওই একই বছর গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় তাঁর নিজের সুরে আরও দুটো বেসিক গান গেয়েছিলেন- ‘তুমি আর ডেকো না’ ও ‘তীর ভাঙা ঢেউ’। ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু হল মোটামুটি ধারাবাহিকভাবে পুজোর গান গাওয়া। ১৯৫৭ সালে শ্যামল গুপ্তের কথায় নিজের সুরে গাইলেন ‘এই ক্ষণটুকু কেন এত ভালো লাগে’ ও বিদেশি সুরের ছায়া অবলম্বনে ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’। পরের বছর চারটি গান গেয়েছিলেন– ‘চাদের আসায় নিভায়ে’ (গীতিকার অনিল বিশ্বাস), ‘এই কূলে আমি আর ঐ কূলে তুমি’ (গীতিকার বঙ্কিম ঘোষ)। এছাড়া প্রণব রায়ের কথায় ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’ ও ‘আমি সাগরের বেলা’। প্রতিটি গানের সুরকার মান্না দে স্বয়ং।

১৯৫৮ সাল থেকে শুরু হল সুরকার ও সংগীত পরিচালক সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে কাজ। সুধীন দাশগুপ্তর সুরে প্রখ্যাত সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের চিত্ররুপ ‘ডাক হরকরা’ চলচ্চিত্রে তিনি গেয়েছিলেন ‘তোমার শেষ বিচারের আশায়’, ‘লাল পাগুড়ী বেধে সাথে’, ‘মনরে আমার শুনলি না বারণ’। এর মধ্যে ‘তোমার শেষ বিচারের আশায়’ গানটি সর্বকালের একটি সংবেদনশীল গান হয়ে উঠেছে। এরপর সুধীনবাবু ওনাকে দিয়ে প্রথম গাইয়েছিলেন ‘শঙ্খবেলা’ ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি’ ও ‘আমি আগন্তুক বার্তা দিলাম’। দিকপাল সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুরে গাওয়া মান্না দের গানগুলিও অন্যতম। নচিবাবুর সুরে ‘চিরদিনের’ ছবিতে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় উত্তমকুমারের লিপে মান্না দে গেয়েছিলেন ‘ফুল পাখি বন্ধু আমার’, ‘লাল নীল সবুজের’, ‘মানুষ খুন হলে পরে’ এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দ্বৈত কণ্ঠে ‘তুমি আমার চিরদিনের’। ১৯৭০ সালে ‘বিলম্বিত লয়’ ছবিতে আরতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে দুটো দ্বৈতসংগীত গেয়েছিলেন, একটি বিশুদ্ধ কলাবতী রাগে ‘বেধো না ফুল মালা ডোরে’, অন্যটি দেশোয়ালি সুরে হিন্দি ভাষায় ‘মন কাহা লাগে মেরা চৈন’। নচিবাবুর সুরে অন্যান্য গানের সঙ্গে ‘স্ত্রী’ ছবির গানগুলি যেমন ‘সাপিনীকে পোষ মানায়’, ‘হাজার টাকার ঝাড় বাতিটা’ এবং ‘সখী কালো আমার ভালো লাগে না’ ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে। ‘নিশিপদ্ম’ ছবিতে ‘না না না আজ রাতে আর’ ও ‘যা খুশি ওরা বলে বলুক’ গান দুটির জন্য ১৯৭০ সালে শ্রেষ্ঠ নেপথ্য কণ্ঠ শিল্পীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন মান্না দে। ১৯৭১ সালে নচিকেতা ঘোষের সুরে গেয়েছেন, ‘আকাশ পানে চেয়ে চেয়ে’, ‘ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘ওগো বরষা তুমি ঝোরো না গো’, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’র মতো চিত্তজয়ী আধুনিক গানগুলি।

উত্তমকুমারের লিপে ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ ছবিতে গান গেয়ে মান্না দে বাংলা ছায়াছবির জগতে চিরকালীন আসন করে নিয়েছিলেন। অনিল বাগচী মহাশয় আভোগী কান্নাড়ার মতো রাগের সুরে এক অন্য মাত্রা দিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘চম্পা চামেলি গোলাপেরি বাগে’। ওই একই ছবিতে ‘I am the night you are the moon’ এবং ওরই বাংলা তর্জমায় ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘আমি যে জলসাঘরের’ সর্বকালের সেরা গানের মর্যাদা পেয়েছে। অনিল বাগচীর পুত্র অধীর বাগচীর সুরে ‘বেহাগ যদি না হয় রাজি’ গানটিও রীতিমতো জনপ্রিয় হয়েছিল।

সংগীত পরিচালকের ভূমিকায় মান্না দে সেরকম নাম করতে পারেননি, কি হিন্দি কি বাংলা ছবিতে। নিজের গানের রেকর্ডিং ও অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। তবে প্রচুর আধুনিক বাংলা গান নিজের সুরে গেয়েছেন যার উল্লেখ ইতিপূর্বেই করা হয়েছে। আরও দু-চারটি গান উল্লেখ্য, যেমন ‘এ জীবনে যত ব্যথা পেয়েছি’, ও ‘আমার মন যমুনার’, ‘আমি নিরালায় বসে’, ‘আমার না যদি থাকে সুর’, ‘জানি তোমার প্রেমের যোগ্য আমি তো নই’।
মান্না দে’র সুরে অনেক সংগীত শিল্পী গান গেয়েছেন। ১৯৬৭ সালে আশা ভোঁসলেকে দিয়ে গাইয়েছিলেন পুলকবাবুর কথায় ‘যখন আকাশটা কালো হয়’, ‘আর আমি খাতার পাতায় চেয়েছিলাম’ গান দু’টি। সুমন কল্যাণপুর গেয়েছিলেন ‘কাঁদে কেন মন আজ’ ও ‘স্বপ্ন নিয়ে খেলা চলেছে’। পুলকবাবুর কথায় মান্না দে’র সুরে হৈমন্তী শুক্লা গেয়েছিলেন ‘আমার বলার কিছু ছিল না’, ও ‘কেন নয়নে আবীর ছড়ালে’ পুজোর রেকর্ডে। কবিতা কৃষ্ণমূর্তিও তাঁর সুরে গেয়েছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্য দুটি গানে সুর দিয়েছিলেন, ‘একটা ছোট্ট দ্বীপ সমুদ্রে ঘেরা’ এবং ‘সবার চেয়ে দামি যা পেয়েছি আমি’। এছাড়া উৎপলা সেন, সুপ্রীতি ঘোষ এঁদের দিয়েও কিছু গান গাইয়েছিলেন। উল্লেখ্য, পুলকবাবু মান্না দে’র জন্য প্রতিটি ঋতুকে নিয়ে ‘সারা বছরের গান’ নামে লিখেছিলেন যাতে সুর করেছিলেন তাঁর ভাই প্রভাস। দীপক রাগে সুর ভেঙে উনি তৈরি করেছিলেন ‘প্রখর দহন অতি দীর্ঘ দগ্ধ দিন’, বর্ষার গানটি ছিল ‘গহন মেঘের ছায়া ঘনায়ে যে আসে’।

সুরকার ও সংগীত পরিচালক অনেকের কথাই তাঁর মনে আসে। রতু মুখোপাধ্যায়ের কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। ১৯৬৪ সালে তাঁর সুরে মান্না দে গেয়েছেন ‘আবার হবে তো দেখা’ ও ‘দেখি ওই হাসির ঝিলিক’ ও আরও কিছু গান। অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য। পিনাকী চৌধুরীর ছবি ‘চেনা অচেনা’তে মান্না দে ওঁর সুরে গেয়েছিলেন ‘এসেছি এসেছি আমি আজ ছন্নছাড়া বেদুইন’, ‘জীবন রহস্য’ ছবিতে গেয়েছিলেন ‘পৃথিবী তাকিয়ে দেখো’। মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরেও মান্না দে গেয়েছেন অনেক গান। ‘মা’ সিরিজে ‘আমায় একটু জায়গা দাও গো’র সুরে মৃণালবাবু ভাসিয়েছিলেন সারা বাংলাকে। বাংলা মাসে তেরো পার্বণের ওপর ও বাংলার মনীষীদের নিয়ে এবং তীর্থক্ষেত্রগুলি নিয়েও গান গেয়েছেন।
নচিকেতা ঘোষের পুত্র সুপর্ণকান্তি ঘোষের কথা বার বার বলেছেন মান্না দে। পুলকবাবুর লেখা একটি ব্যালাডধর্মী গান ‘সে আমার ছোট বোন’ গানটিতে অসাধারণ সুর করেছেন সুপর্ণকান্তি। ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ বাংলা গানের সমস্ত জনপ্রিয়তার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছিল। এছাড়া ‘সারা জীবনের গান’- এর অদ্ভুত সুন্দর গানগুলি উনি সুপর্ণকান্তির সুরে গেয়েছেন।

আধুনিক গানের মতো রবীন্দ্রনাথের গানের বেশি রেকর্ড আমরা পাই না মান্না দে’র কণ্ঠে। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের একান্ত ভক্ত। তাঁর নিজের কথায়, ‘যখনই রবীন্দ্রসংগীত গাই তখনই বুঝতে পারি, ওঁর কোনও গানেরই কোনও শব্দকে আরও অর্থবহ শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা কোনওদিনও কারও পক্ষে সম্ভবপর নয়… এই গানের মধ্যে আমি খুজে পেতাম নিজেকে, পেতাম দুঃখের দিনে সান্ত্বনা, আনন্দের দিনে সঙ্গী।’ মান্না দে’র রবীন্দ্রসংগীতের রেকর্ড ‘ওগো স্বপ্ন স্বরূপিনী’, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’ থেকে আরম্ভ করে ‘পেয়েছি ছুটি বিদায় দেহো’র মতো গান। এছাড়া বেশ কিছু দ্বিজেন্দ্রগীতি ও নজরুলগীতিও তিনি রেকর্ড করেছিলেন।

গীতিকার হিসেবে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় ও গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের সুস্থ প্রতিযোগিতা গানকে স্বাস্থ্যকর করে তুলেছিল। ওই প্রতিযোগিতার প্রভাবেই গৌরীবাবু প্রথম লিখলেন ‘ওগো বর্ষা তুমি ঝোরো নাকো অমন করে’। উত্তরে পুলকবাবু লিখলেন, ‘আমার ভালবাসার রাজপ্রাসাদে’। রাগসংগীতে যেমন আলাপের পর সুরের বিস্তার হয়, তেমনই একটি গান মান্না দে’র কথামতো পুলকবাবু লিখেছিলেন ‘কথা দাও আবার আসবে’। বহু গীতিকার ও সুরকারের গান তিনি গেয়েছেন, তাঁদের কাছে তিনি কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ। এছাড়া বহু বিশিষ্ট যন্ত্রশিল্পী তাঁর গানে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের কথাও তিনি কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন।

আপামর সংগীতপ্রেমীর হৃদয়ের অন্তঃস্থলে মান্না দে চিরকালীন স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর পিছনে কোন জাদু আছে জানতে অনেকেই আগ্রহী। শ্রোতারাই বলে দিতে পারবেন যে এর মুলে আছে তাঁর অসাধারণ প্রতিভা। বাংলা গানের জগতে মান্না দে’র প্রবেশ ১৯৫২-৫৩ সালে। সেই সময় বাংলার সংগীতাকাশে জ্বলজ্বল করছেন জগন্ময় মিত্র, বেচু দত্ত, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি নিজেই বলেছেন বাংলা জগৎটায় আসা তাঁর পক্ষে বেশ কঠিন, কারণ তাঁর সুরটাই হিন্দি বলিউডে। কিন্তু অনেক পরে বাংলা গান গাইতে এসে প্রচলিত ধারা ভেঙে নিজেই হয়ে উঠেছেন একটা যুগ। গানের প্রতিটি বিষয়ে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করতেন। যেন সরস্বতী নিজেই ধরা দিয়েছে তাঁর গায়কীতে। তাই শাস্ত্র মার্গ ছেড়ে একটু একটু করে সরে এসেছেন, মগ্ন থেকেছেন বাণীর তন্ময় উচ্চারণে, বিশেষ গোত্রের স্বরক্ষেপণে।

প্রবাদপ্রতিম গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে ছাড়াও তিনি শাস্ত্রীয় সংগীত আয়ত্ত করেছেন আমন আলি খান, আবদুর রহমান খান, দবির খান, গুলাম মুস্তাফা খানের কাছে। ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুমরী, দাদরা, গজল সবেতেই ছিল তাঁর অনায়াস যাতায়াত। এর সঙ্গে ছিল রাগপ্রধান গান, পুরাতনী গান, শ্যামা সংগীত, খেমটা, পল্লীগীতি, আধুনিক বাংলা গান প্রভৃতি। কিন্তু বিশেষত্ব এখানেই যে শাস্ত্রীয় সংগীতের ভারে কখনওই তাঁর গান নান্দনিকতা হারায়নি। গানের ব্যাপারে তাঁর কোনও রক্ষণশীলতা ছিল না। গানের সঙ্গে ছড়ানো ছিল শাস্ত্রীয় সংগীতের মণিমুক্তো। যখনই প্রয়োজন বোধ করেছেন তখনই তাঁর অফুরন্ত ভাণ্ডার থেকে তুলে এনেছেন নানা অলঙ্কার। প্রতিটি গানের বাণী ও সুর অনুযায়ী তাঁকে ব্যবহার করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দিতে পারতেন। এখানেই তাঁর মাত্রা জ্ঞান ও পরিমিতি বোধ এবং অননুকরণীয় প্রতিভা। জীবনবোধ ও সংগীতবোধের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে মান্না দে’র শিল্পীসত্তা প্রকাশের ঐশ্বর্য ও উল্কর্য। নান্দনিক অনুভব ও প্রগতিশীলতার সমন্বয় ঘটেছে এখানে। তাঁর সাংগীতিক বোধ রক্ষণশীলতার বেড়াজালে যেমন আবদ্ধ নয়, তেমনই প্রগতিশীলতার লাগামছাড়া উচ্ছলতাও সেখানে নেই। বিশিষ্ট গীতিকার সুরকার ও গায়ক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন বিস্ময় লাগে এক খানদানি শাস্ত্রীয়সঙ্গীত মহল ও উচ্চমার্গের কীর্তন দরবার থেকে বেরিয়ে রক্ষণশীলতার সমস্ত মানসিক বিকারের খোলস ছেড়ে অথচ ঐতিহ্যকে যোগ্য মর্যাদা দিয়ে কীভাবে সময়ের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে ছিলেন।

কতখানি অভিনয়গুণ থাকলে একজন গায়ক প্রকৃত শিল্পী হতে পারেন, মান্না দে তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। মাতাল থেকে বাউল, রোম্যান্টিকতা থেকে বেদনার গানে এমন দরদ কে দিতে পারে? এখানেই তাঁর অভিনয় গুণ। ‘সে আমার ছোট বোন’, ‘শুনছ নটবর’, ‘কাহারবা নয় দাদরা বাজাও’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’, ‘কে তুমি নন্দিনী’, ‘আমি কোন পথে যে চলি’, ‘লেগেছে লেগেছে আগুন’ থেকে শুরু করে হিন্দিতে ‘মেরা নাম জোকার’, ‘এক চতুর নার’, ‘প্যার হুয়া একরার হুয়া’, ‘জিন্দেগী ক্যায়সি প্যার পহেলি’ ও আরও গানে সুরের চলনের মধ্যে মান্না দে’র অনন্য অভিনয় গানগুলিকে জীবন্ত করে তুলেছে। বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্তর কথায়, ‘সাধারণ মানুষের মুখের কথায় গানের আলিঙ্গন মান্না দে’র গানকে ডায়লগ করে তুলত… হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়ার মোক্ষম জাদুটিই তো হস্তগত করে ফেলেছিলেন মান্না দে। নানারকমের নানা আঙ্গিকের গান গাইতেন…।

মান্না দে’র বাংলা গানের বৈচিত্র্য নিয়ে আমরা পুলকিত হই, বিস্মিত হই। ওর হিন্দি গান শুনলে আসলে বোঝা যায় বৈচিত্র্য জনিসটা কি। ভজনের চূড়ান্ত সিরিয়াস গান দিয়ে সুর করে চলে গেলেন, চুড়ান্ত ইয়ার্কি ঠাট্টার গানে সব কিছুর মধ্যেও ক্ল্যাসিকালের হাতটা কিন্তু ছাড়েননি। তাঁর হিন্দি গান শেকল ভেঙে উড়ে যাওয়া ডানা মেলে দেওয়া পাখির মতো। ‘লাগা চুনরি মে দাগ’, ‘পুছো না ক্যায়সে’, ‘জিন্দেগী ক্যায়সি পহেলি’, ‘এ ভাই জরা দেখকে চলো’, ‘আও টুইস্ট করে’, ‘ইয়ে রাত ভিগি ভিগি’, ‘ইয়ে দোস্তি হম নহি’, ‘চলতে মুসাফির’, ‘আজ সনম মধুর চাদনি মেহম’, ‘ঝম ঝম বাজে রে পায়েলিয়া’ একের পর এক লেখা যায়। শুনলেই বোঝা যায় মান্না দে’র গান।

মান্না দে নিজে বলতেন, আমি বাঙালি থাকতে চাই। কিন্তু গায়ক হতে চাই সর্বভারতীয়। রাজকাপুর, সাম্মি কাপুর থেকে শুরু করে অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, সবার লিপে হিট গান করেছেন। কোন ভাষায় গান করেননি তিনি? গানের ক্ষেত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন জীবনভর। কোন হিন্দি গান, তাঁর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রসংগীত, কীর্তন অঙ্গের সঙ্গে গজল। বড় মাপের সংগীতকারেরা সকলেই স্বীকার করতেন, কঠিন গান মান্না দে ছাড়া আর কেউ গাইতে পারবেন না। মহম্মদ রফি স্বীকারোক্তি করেছেন, ‘আপনারা শোনেন আমার গান, আর আমি শুনি মান্নাদার গান, ‘গায়কদের গায়ক’ এই বিশেষণটা তাঁকেই মানায়’।
বাংলা রোম্যান্টিক তথা প্রেমের গানে মান্না দে অবিসম্বাদী সম্রাট। মান্না দে’র রোম্যান্টিক গান স্মার্টনেস, নাটকীয়তা ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। স্বরক্ষেপণের নতুন দিগন্ত তৈরি করেছেন বাংলা গানে। তাই নব্বইয়ের দরজায় পৌছে তিনি বলতে পেরেছেন, ‘প্রেমের কোনও বয়স হয় নাকি?’ প্রেমের গান আবার দু-রকমের, একটা উদ্দাম প্রেমের, আর একটা বিরহের। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কথায় বলা যায়, ‘মান্নাবাবুর অবদান হল, ওঁর কথা দিয়ে ছবি আঁকার ক্ষমতায়’। প্রেমের গানের আকুতি বা আর্তি সুরের সঙ্গে কথা দিয়ে তিনি প্রকাশ করেছেন। মজার গানেও এত সুন্দর অনুরাগ মিশিয়ে দিয়েছেন। রাগের মধ্যে অনুরাগের অংশটাও ড্রামাটিকভাবে প্রাণবন্ত করে মানুষের মনে পৌছে দিয়েছেন। পণ্ডিত অরুণ ভাদুড়ী একই রকমভাবে বলেছেন, বহু মানুষের প্রেম, বিরহে, হাসি কান্নায় উকি দেয়, মান্না দে’র অজস্র গান… যা দরদি কণ্ঠে মরমী শ্রোতার অন্তঃস্থলে গিয়ে পৌঁছত।’

একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হিন্দি গানে মান্না দে’র যা সীমাবদ্ধতা, সেগুলিই তাঁর অশেষ কৃতিত্ব। মান্না দে নায়কের লিপে গান বেশি পাননি। অনামি একস্ট্রাদের লিপে গান গেয়েই হিট করিয়েছেন। প্রচুর হিট গান বৃদ্ধ, ভিখিরি, মাতাল, ফেরিওয়ালা বা অনামী মুখে গেয়েছেন। একের পর এক ফ্লপ সিনেমায় হিট গান দিয়েছেন। সিনেমার নাম লোকে মনে রেখেছে মান্না দে’র গানের জন্য।

মানুষ হিসেবে একেবারে দিলখোলা ছিলেন তিনি। এত বড় মহান ব্যক্তিত্ব অথচ যেন কত আপনার জন্য। শিল্পীসুলভ কোনও আত্মম্ভরিতা নেই। এঁরাই হচ্ছেন প্রকৃত শিল্পী। নতুন আনকোরা শিল্পীদের সঙ্গে যেভাবে সহযোগিতা করতেন, দেখার মতো। সেলিব্রিটি হয়েও মাটির কাছাকাছি থাকতে ভালবাসতেন।

সুরকার, সংগীত পরিচালক এবং সর্বোপরি সংগীতশিল্পী হিসেবে মান্না দে পরিচিত হলেও, তিনি অভিনয় করেছেন তাঁর নিজেরই ভূমিকায় ‘পাগল তোমার জন্য যে’ টেলিফিল্মে সুদেষ্ণা রায়ের পরিচালনায়। ‘স্বপ্নের গান স্বপ্নের নায়ক’ নামে আর একটি টেলিফিল্মে অভিনয় করেছিলেন পার্থ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায়, তিনি এফএম লাইভ প্রোগ্রামেও কয়েকবার গিয়েছিলেন।

জীবনে অগুন্তি মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মান্না দে পেয়েছেন, যেমন পেয়েছেন উপহার। মান্না দে বললেন, তোমরা আমার গান ভালবাস এই তো যথেষ্ট। এই যে ভালবাসা, এটাই তো আমার কাছে অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপহার। সারা জীবনে অগুন্তি মানুষের ভালবাসা পাওয়ার মত অগুন্তি পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। বহুবার পেয়েছেন বহু রাজ্যের শ্রেষ্ঠ গায়কের সম্মান, পদ্মশ্রী খেতাব, বাংলাদেশের সরকারি সম্মান, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি.লিট খেতাব। কিন্তু শ্রোতাদের অকুণ্ঠ ভালবাসার কাছে এসব তুচ্ছ মনে হয় তাঁর।

মান্না দে’র সংগীত জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে এক বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে এই অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট মানুষজনের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন মান্না দে’র কাছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘ওই অনুষ্ঠানে সমস্ত শিল্পী ও দর্শকদের সমবেত রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী’ আমার এখনও কানে লেগে আছে। মানুষের বুকের ভেতর, মনের ভিতর শ্রদ্ধা, ভালবাসা, মমতার এই যে চিরস্থায়ী আসন আমি পেয়েছি। এই পাওয়া ক’জন শিল্পীর ভাগ্যে জোটে? সত্যিই আমি ধন্য হয়ে গেছি সেই ভালবাসায়। আমার গান শুনে শান্তিতে শেষ নিশ্বাস ফেলতে পারেন মৃত্যুপথযাত্রী, আবার চিরসাথীকে হারিয়ে অসীম শূন্যতার মাঝে আমার গান শুনেই খুঁজে পায় সান্তনা, এরকম ঘটনা আমি দেখেছি নিজের চোখে।’

সমালোচনার কষ্টিপাথর তাঁর প্রয়োজন নেই, তাঁর জনপ্রিয়তা স্বোপার্জিত। পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তী যথার্থই বলেছিলেন, ‘মান্নাবাবু সত্যিকারের ‘ভারতরত্ন’। ভারতের প্রত্যেকের মনে। যে মানুষটা স্থায়ী আসন তৈরি করে, সে যদি ভারতরত্ন না হয় তবে কে হবে ভারতরত্ন?’

(ঋণ স্বীকার : মান্না দে’র আত্মজীবনী ‘জীবনের জলসাঘরে’। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত মান্না দের উপরে বিশিষ্ট গীতিকার, সুরকার, গায়ক, অভিনেতা, চলচ্চিত্রকারদের কিছু লেখা।)