বিজেপি শাসিত রাজস্থানে মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়েছে নারী পাচার চক্র। শুধু নারী পাচারই নয়, বাংলার নাবালিকা মেয়েদের সেখানে বাজারজাত পণ্যের মতো বেচাকেনা চলছে। পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছে এমনই ভয়াবহ তথ্য। পুলিশ-প্রশাসনের চোখের আড়ালে কীভাবে সেখানে এতটা সক্রিয় হয়ে উঠছে নারী পাচার চক্র, তা রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছে তদন্তকারী আধিকারিকদের। পুলিশসূত্রে খবর, সেখানে বাংলার নাবালিকাদের নিলাম করে বেচাকেনা চলে। একবার নয়, একাধিকবার তাদের হাতবদল করা হয় মোটা অঙ্কের বিনিময়ে। নথি জাল করে সাবালিকা করে তোলা হয় নাবালিকাদের। লোক দেখানো বিয়েও দেওয়া হয়। এরপরেই তারা পাচারকারীদের করায়ত্ত হয়ে পড়ে। রাজস্থানে নারীপাচার চক্রের এই রমরমা পুলিশের কাছে ধরা পড়ে বাংলার এক নাবালিকার সন্ধান করতে গিয়ে। এক নিখোঁজ নাবালিকার খোঁজে রাজস্থান গিয়ে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে সিবিআই। এক সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা গিয়েছে, অন্য একটি পাচারের তদন্ত করতে গিয়েও একই তথ্য পেয়েছে পুলিশ।
নারী পাচার চক্রের অন্যতম ডেরা রাজস্থানে পাইকারি বাজারের মতো নিলামে তোলা হয় নাবালিকাদের। দর ওঠে ৫ লক্ষ থেকে ১০ লক্ষ টাকা বা তারও বেশি। সর্বোচ্চ দর যে দেয়, নাবালিকা তারই হয়ে যায়। এ যেন সেই মধ্যযুগীয় প্রথা। নাবালিকাকে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে কেনার পর অন্যত্র বিক্রিও করতে পারে। একইভাবে সেখানেও নিলামে বিক্রি হয়ে হাতবদল হয়ে যায় এরা। চড়া দামে বাংলার নাবালিকাদের বেচাকেনা শুধু নয়, পাচার হওয়া হওয়া এই সব নাবালিকাদের ক্রীতদাসী হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। রাজস্থানের এই নারী পাচার চক্রের এজেন্টরা ছড়িয়ে রয়েছে গোটা দেশে। ভুল বুঝিয়ে নাবালিকাদের নিয়ে যাওয়ার পর মোটা অঙ্কে বিক্রি করে দেওয়া হয়। বিনা পারিশ্রমিকে রাতদিন শুধু পরিশ্রম করার পাশাপাশি এই নাবালিকারা বাবুদের যৌন লালসার শিকার হন। সম্মতি না দিলে জোটে চরম শারীরিক নির্যাতন। এক সংবাদ মাধ্যম সূত্রে একথা জানা গিয়েছে।
Advertisement
পূর্ব বর্ধমানের নিখোঁজ এক নাবালিকাকে সম্প্রতি রাজস্থান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে গলসি থানার পুলিশ। এক এজেন্টের মাধ্যমে তাকে সেখানে পাচার করা হয়েছিল বলে জানতে পারে পুলিশ। সিবিআই-ও বিজেপি শাসিত ওই রাজ্য থেকে এই জেলারই রায়নার এক নাবালিকাকে উদ্ধার করেছে। পাচারকারী সন্দেহে এক মহিলা-সহ যে ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারা সকলেই রাজস্থানের বাসিন্দা। রাজস্থানের পালি জেলার মারোয়ার জংশন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে শনিবার ধৃতদের পেশ করা হয়। তিনদিনের ট্রানজিট রিমান্ডে তাদের বর্ধমানে নিয়ে আসে সিবিআই। অন্যদিকে, এই নাবালিকা পাচার চক্রে জড়িত থাকার অভিযোগে আসানসোল থেকেও ২ জনকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। সোমবার ধৃত ৭ জনকে বর্ধমানের প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা আদালতে পেশ করা হয়।
Advertisement
রাজস্থান থেকে ধৃত ভরত কুমার, জগদীশ কুমার, রাতা রাম, দিলীপ কুমার ও মিনা দোপুপেন-দের ৮ দিনের হেফাজতে নিতে চেয়ে আদালতে আবেদন জানায় সিবিআই। বিচারক বিভাস চট্টোপাধ্যায় তা মঞ্জুর করেন। পাশাপাশি আসানসোল থেকে ধৃত রানু খাতুন ও মহম্মদ বিলালকেও এদিন আদালতে পেশ করে ৮ দিনের হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই।
উদ্ধার হওয়া ছাত্রীকে নিজের কাছে রাখার জন্য আবেদন জানান তাঁর মা। নাবালিকা তার মায়ের কাছে যাওয়ার বিষয়ে মত প্রকাশ করে বিচারকের সামনে। নাবালিকাকে তার মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। এদিন নাবালিকার মা পুলিশি নিরাপত্তা চেয়ে আদালতে আবেদন জানান। সিবিআইয়ের আইনজীবীও নাবালিকা ও তার পরিবারের নিরাপত্তার প্রয়োজনীয়তার কথা আদালতের সামনে তুলে ধরেন। তার ভিত্তিতে নাবালিকার বাড়িতে পুলিশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। এছাড়াও মামলার প্রয়োজনে নাবালিকার যে কোনও জায়গায় যাতায়াতের সময় উপযুক্ত পুলিশি নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। জেলার পুলিশ সুপার ও রায়না থানার ওসিকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
সিবিআই সূত্রে জানা গিয়েছে, রায়না থানার খালেরপুল মাছখাণ্ডা এলাকায় এক নাবালিকা ২০২৩ সালের ৯ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ প্রাইভেট টিউশন পড়তে যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী আর বাড়ি ফেরেনি। প্রথমে রায়না থানা ঘটনার তদন্ত করে। অপহরণের সন্দেহে শেখ সফিকুল ও শেখ জসিম উদ্দিন নামে দুই যুবককে গ্রেপ্তারও করেছিল পুলিশ। কিন্তু নাবালিকার সন্ধান মেলেনি। পরে তারা জামিনও পেয়ে যায়। এরপর ঘটনার তদন্তভার নেয় সিআইডি। তারাও খুঁজে দিতে পারেনি নাবালিকাকে। ২০২৪-এর জানুয়ারি মাসে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন নাবালিকার মা। বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত ঘটনার সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। সিবিআইয়ের স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চের ডিএসপি রাজেন্দ্র হেমন্ত কুজুরের নেতৃত্বে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়।
সম্প্রতি গলসি থানার পুলিশ সেখানকার এক নিখোঁজ নাবালিকাকে রাজস্থান থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। এরপরই সিবিআই পাখির চোখ করে রাজস্থানকে। বিভিন্ন সূত্র থেকে সিবিআই জানতে পারে নাবালিকাকে পাচার করা হয়েছে রাজস্থানে। সিবিআইয়ের একটি টিম রাজস্থানের পালি জেলায় রওয়ানা দেয়। গত শুক্রবার রাতে ওই নাবালিকাকে উদ্ধার করা হয়।
ধৃতদের বর্ধমান আদালতে পেশ করে হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকদের প্রশ্ন, তাদের হয়ে স্থানীয় এজেন্ট কারা ছিল। স্থানীয় এজেন্ট ছাড়া রাজস্থান থেকে এসে কোনও নাবালিকাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তাদেরই সন্ধান পেতে চাইছে সিবিআই। পাশাপাশি, আর কোনও নাবালিকা বা তরুণী এই চক্রে পড়ে গিয়ে পাচার হয়ে গিয়েছে কি না তাও জানতে চাইছেন তদন্তকারীরা।
পুলিশ সূত্রে খবর, জয়পুরের কাছে ‘গায়ত্রী সর্ব সমাজ ফাউন্ডেশন’ গরীব পরিবারের মেয়েদের গণবিবাহের আয়োজন করত। সমাজসেবার আড়ালে এই সংস্থার একাধিক লোক বিহার, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং উত্তর প্রদেশের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জোগাড় করত। এদের পরিবারগুলি থেকে অর্থের বিনিময়ে মেয়েদের কিনে নেওয়া হত। বলা হত, ওই সংস্থা মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে দেবে। গরীব পরিবারগুলি তাতেই খুশি থাকত। যারা এই মেয়েদের জোগাড় করত তারা সকলেই নারী পাচার চক্রের এজেন্ট। এজেন্টরা মেয়েদের ওই সংস্থার হাতে তুলে দিত। বসানো হত লোকদেখানো গণবিবাহের আসর। যেসব লোকেদের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হত তাদের কাছ থেকে গোপনে আড়াই থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা করে নিত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। এইভাবেই বিয়ের টোপ দিয়ে নারী পাচারচক্র চলত রমরমিয়ে।
‘গায়ত্রী সর্ব সমাজ ফাউন্ডেশন’ নাবালিকাদের জন্য জাল আধার কার্ডের ব্যবস্থা করত, যাতে তাদের বয়স ১৮ বছরের বেশি দেখানো যায়। এই সংস্থা প্রায় ১,৫০০টি বিবাহের ব্যবস্থা করেছিল ।পরে এই সংস্থা ও তার এজেন্টদের ঠাঁই হয় কারাগারে।
Advertisement



