ভারত অঙ্ক কষছে। কোথায়, কীভাবে, কী কৌশল অবলম্বন করে পহেলগামে হিন্দু পর্যটক হত্যার জন্য পাকিস্তানকে প্রত্যাঘাত করা যায়? তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্তাদের আলোচনা চলছে সেই ঘটনার পর থেকেই। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অত্যন্ত কড়া ভাষায় পাকিস্তানের উদ্দেশে বলেছিলেন, ওই দেশকে এই জঙ্গি হানার জন্য এমন জবাব দেওয়া হবে, যা কল্পনাতীত। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুঙ্কার ছেড়ে বলেছিলেন, পাকিস্তানকে যে প্রত্যাঘাত করা হবে তা শুরু হবে কিছু সময়ের মধ্যেই। কিন্তু পাকিস্তানকে সেই জবাব দেওয়ার কৌশল এখনও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানকে জবাব দেওয়ার আগে যে ব্যবস্থাদি নেওয়া দরকার, তা শুরু হয়ে গেছে। যেমন সিন্ধু নদীর জল সরবরাহ বন্ধ, ভারতীয়দের পাকিস্তান ছেড়ে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ভারতে চলে আসা। তেমনই পাকিস্তান ও ভারতে অবস্থানকারী পাকিস্তানের নাগরিকদের ভারত ছাড়ার নির্দেশ।
ইতিমধ্যে দক্ষিণ কাশ্মীরে ন’জন জঙ্গির আবাস বিস্ফোরণে ধ্বংস করে দিয়েছে ভারতীয় সেনারা। পহেলগাম সহ কাশ্মীর উপত্যকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জঙ্গিদের খোঁজে চিরুণি তল্লাশি শুরু করেছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা। ঘটনার দু’দিন পর যুদ্ধের মহরাও হলো। যুদ্ধজাহাজ বিক্রম থেকে ধ্বংসকারী গোলা ছাড়া হল, রাজস্থানের মরভূমি অঞ্চলের কোনও স্থানে ট্যাঙ্কের মহড়াও চলল। হাসিমারা থেকে যুদ্ধ বিমান রাফাল এবং সুখোই উড়ল— আকাশ পরিক্রমা করল। সবই যুদ্ধের প্রাক প্রস্তুতি। ওদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ ঘোষণা করেছেন ভারতে যে কোনও আক্রমণ প্রতিহত করতে পাকিস্তান প্রস্তুত। সিন্ধু নদীর জল ছাড়া বন্ধ করাতে পাকিস্তানের কোনও কোনও শহরে ‘ওয়াটার ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করা হয়েছে।
কিন্তু এসব যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব বলা হলেও, ভারত কবে ১৪০ কোটি ভারতবাসীর জন্য পহেলগামে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের ২৬ জন হিন্দু হত্যার জন্য পাকিস্তানকে উপযুক্ত জবাব দেবে, তা এখনও আলোচনার স্তরেই রয়েছে। ভারত ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পহেলগামের হত্যালীলা নিয়ে কথা বলছে। তাঁরা সবাই সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা করার জন্য ভারতের প্রয়াসকে সমর্থন জানিয়েছেন। প্রত্যাঘাতের আগে ভারতের অনেক কিছু বিবেচনার মধ্যে রয়েছে।
পাকিস্তানের সমরশক্তি অবজ্ঞা করার নয়। অতীতে ভারতের সেনাদের জঙ্গি শিবির ধ্বংস করতে গিয়ে বেশ কিছু ভারতীয় সেনার প্রাণ গিয়েছে। তাছাড়া পাকিস্তানের পাশে চিন রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই পরমাণু শক্তিধর দেশ। সুতরাং প্রত্যাঘাতের আগে এসব বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। ভারতের সব রাজনৈতিক দলের নেতারা পহেলগামের ঘটনার জন্য পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দেওয়ার জন্য বলেছেন, কিন্তু ভারতকে প্রত্যাঘাত করতেই হবে। যে কোনও দিন তা ঘটতে পারে। কারণ ভারত যদি দেশবাসীর ইচ্ছাকে মর্যাদা না দেয়, তাহলে তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে। অনেকেই মনে করেন, তাদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত ভারতের সেনাবাহিনীর শীর্ষকর্তারাও রয়েছেন— ভারতকে পাকিস্তানের জঙ্গিদের মদত দেওয়ার পথ বন্ধ করতেই হবে। তিনজন জঙ্গির বাড়িঘর বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়াই যোগ্য জবাব নয় বলে তাঁরা মনে করেন। ইতিমধ্যেই সমালোচনায় বিদ্ধ জম্মু ও কাশ্মীর সরকার এবং ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী। ঘটনার দিন পহেলগামে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য কোনও পুলিশ বা কোনও সেনা জওয়ান ছিল না। কিন্তু কেন? যে পহেলগামে প্রতিদিন তিন থেকে চার হাজার পর্যটক আসেন এই উপত্যকার সৌন্দর্য উপভোগ করতে, সেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তার জন্য কোনও নিরাপত্তারক্ষী থাকবে না কেন? এটা চরম গাফিলতির এবং অবহেলা এবং তার সুযোগই নিয়েছিল জঙ্গিরা। এমনকি যা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, ঘটনার প্রায় এক ঘণ্টা পর পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীরা ঘটনাস্থলে আসেন। এটা জম্মু ও কাশ্মীর সরকারের চরম ব্যর্থতা। সময়মতো এলে, কিছু বুলেটবিদ্ধ পর্যটকদের প্রাণ বাঁচানো যেত তাঁদের চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে গেলে।
তবে প্রাক্তন সেনাকর্তাদের মতে, ভারতকে প্রত্যাঘাত করতেই হবে— সে আজই হোক, কালই হোক। আর তা না করলে জঙ্গিরা নাশকতার কাজে আরও সুযোগ পাবে। রাজনৈতিক ভাবে যদি বিষয়টি ভাবা হয়, তাহলে বলা যায় ২০২৯ সালে লোকসভা নির্বাচন। ভারত যদি দেশের ১৪০ কোটি মানুষের প্রত্যাঘাতের ইচ্ছাকে সম্মান জানাতে না পারে, তাহলে নির্বাচনে তার প্রভাব ফেলতে পারে শাসক দল বিজেপির উপর। তবে সেই সঙ্গে তাঁরা একথাও বলেন, ভারতকে প্রত্যাঘাত নিয়ে সাবধানে এগোতে হবে। কারণ অতীতে তিনটি যুদ্ধে পাকিস্তান ভারতের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছে। কিন্তু এবার পাকিস্তান আর্থিক দিক থেকে দুর্বল হলেও সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করেছেন পাকিস্তানকে সন্ত্রাসবাদে মদত দেওয়ার নোংরা কাজে সহায়তা করেছে আমেরিকা। এদিকে রাষ্ট্রপুঞ্জ পহেলগামের ঘটনার নিন্দা করেছে। রাষ্ট্রসংঘও মনে করে সন্ত্রাসবাদকে যে কোনও মূলেইে নির্মূল করতে হবে।