• facebook
  • twitter
Tuesday, 13 May, 2025

বাঙালির ভাষা

মিষ্টান্ন আর তরকারির মাঝামাঝি শ্রেণীর সুখাদ্যের নাম দিতে পারা যায় মুখচার। এ মুখচার আবার দুরকমে ভাগ করা যায়। একরকম হল অম্ল ও কটু (অর্থাৎ ঝাল) রসপ্রধান।

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

গজা খাজারই মতো মিষ্টি দেওয়া, তবে খাজার মতো খাঁজা কাটা নয়। হয় জিবের মতো পাতলা ও সরু। (সেই থেকে নাম গজা। শব্দটি আরবী থেকে এসেছে।) অথবা মোটা ও চিপলে (এ হল কলকাতায় তৈরি)। লুচিতে ক্ষীরের পুর দিয়ে সাজা পানের মতো মোড়ক করে তা লবঙ্গ দিয়ে বিঁধে ঘিয়ে ভেজে রসে ডুবিয়ে নিলে হয় যে খাদ্যটি তার একদা নাম ছিল এমপ্রেস গজা। (নামটি লেডিকেনি স্মরণ করায়)। কলকাতায় উদ্ভূত এই মিষ্টান্নটি এখন লবঙ্গলতিকা নামে চলছে।
ময়দা লুচির মতো বেলে তাতে ক্ষীরের অথবা নারকেল ছাঁচের পুর দিয়ে অর্ধচন্দ্রাকারে জুড়ে ঘিয়ে ভেজে রসে ভিজয়ে নিলে হয় পেরাকি।

পেরাকি দীর্ঘস্থায়ী খাদ্য, ভ্রমণকারীর ও পথিকের উপযোগী। এই ধরনের মিষ্টান্নের মধ্যে সবচেয়ে অপরিচিত অথবা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য খাদ্য হল ঘিওড় (সম্ভবত সংস্কৃত ‘ঘৃতপুট’ থেকে)। এ একরকম খাজা। মৌচাকের মতো, বড়ো। ঘিয়ে ও চিনিতে পুষ্ট। শক্ত দীর্ঘকাল স্থায়ী। সেকালের তীর্থযাত্রীরা ধনীব্যক্তিরা পাথেয় নিতেন মিষ্টান্ন। এক একটি পাঁচ-সাতজনের প্রাত্যহিক আহারের উপযুক্ত। এ মিষ্টান্ন এখন কলকাতায় বড়ো বাজারে কোনও কোন কোন পশ্চিমা হালুইয়ায়ের দোকানে পাওয়া যায়। (শ্রদ্ধেয় বন্ধু শ্রীযুক্ত নিকুঞ্জবিহারী চক্রবর্তীর প্রসাদে আমি ঘিওড়ের পরিচয় পেয়েছি। সে কথা, এখন স্বীকার করছি। তবে নামটা আমার আগে থেকেই শোনা ছিল।)

বাঙালীর প্রথম ছেনার মিষ্টান্ন ছিল ছেনাবড়া ও মন্ডা। তারপর পান্তুয়া-সন্দেশ-রসগোল্লা ইত্যাদিতে যে লোভন ও শোভন বিস্তার হয়েছে তার মূলে পোর্তুগীজদের কিছু হাত ছিল বলে আমি অনুমান করি। শাহজাহানের আমলে বাংলা দেশে একজন আর্মানি সুবেদার ছিলেন কিছুকালের জন্যে। তাঁর উদ্যোগে এদেশে অনেক কিছু নতুনত্বের চলন হয়েছিল। তার মধ্যে মিষ্টান্নের উন্নতিও ধরতে পারি।

মিষ্টান্ন আর তরকারির মাঝামাঝি শ্রেণীর সুখাদ্যের নাম দিতে পারা যায় মুখচার। এ মুখচার আবার দুরকমে ভাগ করা যায়। একরকম হল অম্ল ও কটু (অর্থাৎ ঝাল) রসপ্রধান। আর একরকম হল মিষ্টরস প্রধান। মুখচারের প্রধান সামগ্রী হল আম, বাঙালীর প্রধান সুখাদ্য ফল, প্রাধান্যে যা নারকেলের পরেই। একটি ছাড়া মুখচাররূপে আমের ব্যবহার পোর্তুগীজরাই শিখিয়েছিল বলে মনে হয়। মিষ্টরস বর্জিত প্রধান আম্রঘটিত মুখচারটির নাম আচার। এটি পোর্তুগীজ শব্দ। এতে লাগে কাঁচা আম, নুন, সর্ষে ও তেল, হলুদ, লঙ্কা। তৈরী করতে হয় অত্যন্ত শুদ্ধাচারে। তার থেকে হয়ত কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে আচার পোর্তুগীজদের কাছ থেকে পাওয়া নয়, আমাদের দেশে আগেই প্রচলিত ছিল। কিন্তু আগে প্রচলিত থাকার বিন্দুমাত্র প্রমাণ নেই। শুদ্ধাচারের ব্যাপারটা এসেছে আবার এই পোর্তুগীজ শব্দের বাংলা মানে থেকেই।

(ক্রমশ)