• facebook
  • twitter
Saturday, 14 June, 2025

ইচ্ছেপূরণ

অনেকদিন তো বেরুনো হচ্ছে না। আচ্ছা খোকা, এই লকডাউনের মধ্যে তোদের কোম্পানির পার্টি হবে! এ কেমন কোম্পানি? সে যাক— ন্যাতাটা নিয়ে আসি গে।

কাল্পনিক চিত্র

সুনন্দ শিকদার

শখটা অনেক দিনকার। কিন্তু পূরণ করার উপায় ছিল না শুভশ্রীর।  মধ্যবিত্ত গৃহবধূ, নৈতিকতার বাঁধনের অভাব নেই। এমনকি তার মনোবাসনাটি প্রকাশ করার জন্যে পাক্কা দুটি রাত সুবোধকে বোঝাতে হয়েছে। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে— সেখানে এসব ভাবার অবকাশ নেই। কিন্তু কথাটা যত ভাবছে তত সে শিহরিত হয়ে উঠছে। সুবোধকে ভোর চারটের সময় ঠেলে তুলে বের করতে হয়েছে তাকে।
আকাশ তখনো ফরসা হয়নি। অঘোরে ঘুমিয়ে থাকা সুবোধকে সে ঠেলা মেরেছে।
ওঠো, ওঠো।
সকাল হয়ে গেছে?
হল বলে।
দোকান খুলতে তো দেরি আছে।
সবাই লাইন দিয়েছে, এরপর আর পাওয়া যাবে না।
এত ভোরে বেরুলে ধরবে পুলিশ। নাইট কার্ফু চলছে।
তবে চলি।
যেও না, দাঁড়াও উঠছি।
আলো জ্বালিয়ে দিয়েছে শুভশ্রী। নীল মশারির মধ্যে সুবোধ এক পাশ থেকে অন্যপাশ ফেরে। এসি চালিয়ে ঘর ঠান্ডা করে চাদর নিয়ে শোয়া, সুবোধের একটা বিলাস।  আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে আবার শুয়ে পড়ে। মাথা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। শুভশ্রী হাঁ হাঁ করে উঠলে সে উঠে বসে।
ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ই। বিশেষ করে শোবার ঘরটা। ভারী পর্দায় ঢাকা। এসি চালানো ছিল… বেশিরভাগ সময়েই থাকে, তাই ঠান্ডা।  ঘরের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে বিছানাটা। বাকি আসবাবের মধ্যে দুটি স্টিলের আলমারি আর একটি সোফা। সামনে ছোট টেবিল। আর একটি বড় টেবিলের ওপর একটা ডেস্কটপ। একটি টিউব লাইট আর একটি ডিমলাইট আছে ঘরে।
সুবোধ দাঁত মেজে তৈরি হয়ে নেয়।  ট্র্যাকসুটের ওপর একটা আকাশি জামা গলিয়েই বেরিয়ে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে পিছনে ডাকে শুভশ্রী,
কটা আনবে?
চারটে।
বাবা, এতগুলো?
কবে আবার খুলবে কে জানে? আর পিছনে ডেকো না।
ভোরের আমেজ গাড়িহীন রাস্তায়। মিস্ত্রিদের ফেলে যাওয়া ছাদে বসে আছে চিল। আর রাস্তার পাশের কাউন্টারের বাইরে মোটা গ্রিল লাগানো দোকানটার সামনে লাইন লম্বা হচ্ছে। লাইনটার অনেক পিছনেই জায়গা হয়েছে সুবোধের। দোকানটা যে এক্ষুণি খুলবে তা নয়, কিন্তু লাইন লম্বা হচ্ছে।  কখন খুলবে কেউ বলতে পারছে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সাদা পোষাক পরা দুজন হোমগার্ড। তাদের হাতে লাঠি।
কয়েক ঘন্টা চলে যায়। লাইনটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে এখন চারমাথার মোড়ে চলে গিয়েছে। বেশিরভাগের মুখে মাস্ক।  হাল্কা হাসি ঠাট্টা চলছে। সুবোধের সামনের লোকটি বলে, করোনার লকডাউনে পেটে একফোঁটা দানাপানি পড়ল না, পেটটা মরুভূমি হয়ে গেল। শুনছি দুটোর বেশি বোতল দেবে না।  সত্যি নাকি?
সুবোধ বলল, যা দাম।  মনে হয় না কেউ অত কিনতে পারবে।
সত্যি মশাই এই আকালে সুযোগ বুঝে ট্যাক্স বাড়িয়ে দিল। বলছে কি না আমজনতার সরকার। মধ্যবিত্তের সরকার! দেশি হোক, বিলিতি হোক বাছবিচার নেই।  দাম বেড়ে গেল।
ব্যবসা বন্ধ, গাড়ি বন্ধ, পেট্রোল ডিজেল থেকে রোজগার নেই, সরকার আয় করবে কোথা থেকে?
তা বলে আমাদের একটু ড্রিঙ্ক করতে দেবে না।  সমস্ত মাতাল যদি বোতল থেকে মুখ তুলে রাস্তায় নামে, তবে সরকার পড়ে যাবে।
মাতালদের কি সরকারের প্রয়োজন আছে?
মাতালদের জরুরি প্রয়োজন সরকারের। আমাদের ভরসাতেই তো চলছে। আচ্ছা জিজ্ঞাসা করা হল না। আপনি মশাই কি রেগুলার না কখনো সখনো।
না মশাই, আমি ড্রিঙ্ক করি না।
সেকি আপনি তাহলে তাজমহল দেখেননি।
মহা মুশকিল হল, ভদ্রলোক কিছুতেই থামতে জানেন না। মাঝবয়সি ভদ্রলোক। চেক চেক হাওয়াই শার্ট আর কালো প্যান্ট।  মাথার মাঝখানটায় টাক, চোখে চশমা।
সুবোধ চুপ করে থাকে। উত্তর দেয় না। কিন্তু ভদ্রলোক আবার বলেন, তবে লাইন দিয়ে— এই  লকডাউনে—
হ্যাঁ বন্ধুর জন্যে—
তিনি পরে আসবেন?
হ্যাঁ।
সুবোধ সম্পূর্ণ মিথ্যে বলার আগে  মায়ের মুখটা স্মরণ করে নেয়। কথাটা বলে একটা ঢোক গিলে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।  ততক্ষণে একটা শোরগোল শুরু হয়েছে।  শোরগোলটা আর কিছুই নয়। একটা বাঁধ ভাঙছে। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে। লাইনের মুখেই শোরগোল। পিছনের হাতগুলো সামনের পিঠগুলিকে ঠেলে দিচ্ছে।
কারণ কাউন্টার খুলছে। অনন্ত অমৃতের আশ্বাস নিয়ে পানীয়ের বোতলগুলি লোহার কাউন্টারের ফাঁক দিয়ে হাতবদল হচ্ছে। বুভুক্ষু হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে হাতগুলি।  যেন শেষঘন্টি বেজে গেল, কিংবা যেন পৃথিবীর শেষ দিন। কাল সবাই যেন আর কোথাও চলে যাবে যেখানে পানীয়ের ব্যবস্থা নেই।
এবার লাইনটা এগোচ্ছে। চলন্ত লাইনের পাশে পাশে হাঁটছে দুজন হোমগার্ড। মাঝে মাঝে লাঠি উঁচিয়ে সাবধান করছে।
ওর নিজের ক্রম এলে সে চারটি বোতলের দাম জিজ্ঞাসা করে। দোকান বোধহয় মালিক নিজেই খুলেছে, প্রতিদিনের কর্মচারি নেই— হয়ত লকডাউনে দেশে চলে গিয়েছে। তাই তার কাজের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। এত খদ্দেরদের দাবিতে দিশাহারা। লোকটি বাক্স খুলে বোতল বের করতে করতে কোনক্রমে বলে, পাশের চার্টটা দেখে নিন, লেকা আচে।
এতটাই দাম বেড়ে গিয়েছে!
টাকা নিতে নিতে চারটি বোতল লোকটি এগিয়ে দেয়।  বোতলগুলি ঠান্ডা। হাতে নিয়ে বেরোতে বেরোতেই পিছনের লোকটি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাউন্টারের জায়গা দখল করে।
একটা থলেতে ভরেছে। তারপর ভাঁজ করে নিয়েছে মুখটা। যাতে বোঝা না যায়।  সুবোধ কেমন একটা অপরাধবোধে ভুগছে।  যেন চুরি বা কোন অন্যায় কাজ করেছে। সে ফিরতে ফিরতে রাস্তার দু’দিকে তাকায়।  রাস্তায় লোক যথেষ্ট কম— এই মদের দোকানের লাইন ছাড়া।  কিন্তু যে এক-দু’জন যাচ্ছে, সুবোধের মনে হচ্ছে যেন তার দিকেই তাকাচ্ছে। তার হাতের দিকে বিদ্রুপমাখা দৃষ্টিতে।
খিদেও পেয়ে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বোঝে, লম্বা লাইনটায় পাক্কা তিনঘন্টা সে দাঁড়িয়েছিল।
শুভশ্রী দরজা খুলেই বলে, ওমা কি ঘেমে গেছ। জামাকাপড় খুলে বালতিতে ভিজিয়ে সোজা স্নানঘরে চলে যাও। বালতিতে সাবানজলে স্যনিটাইজার দেওয়া আছে।
চারটে বোতল কিনতে গিয়ে কি ভোগান্তি। আর স্ট্রেঞ্জ এই মাতালরা। ভোররাত থেকে লাইন দিয়েছে। একমাস যেন কিছুই খেতে পায়নি।
ভাল করে স্নান করবে। তারপর আলাদা একটা চিরুনি রেখেছি।
ততক্ষণে মুক্তা এসে দাঁড়িয়েছেন।  ছেলেকে সোজা বাথরুমের দিকে যেতে দেখে বললেন, সকাল সকাল কোথায় গেছিলি খোকা?
চকিতে শুভশ্রীর মুখের দিকে চেয়ে সুবোধ মাকে বলে, মোবাইলটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল তো তাই।
লকডাউনে মোবাইলের দোকান খোলা পেলি?
ইমতিয়াজকে দেখলাম সামনে শাটার ফেলে পিছনের দরজা খোলা রেখেছে।  সেখানেই চেষ্টা করলাম।
কাজ হল?
একটু চলনসই করে দিল।
কথা না বাড়িয়ে সে পা বাড়ায় বাথরুমের দিকে। তাড়াতাড়ি দারজাটা বন্ধ করলে অপ্রস্তুত মুখটা আড়াল পাবে।  বাইরে থেকে শুভশ্রী যেন শ্বাশুড়িকে শুনিয়ে বলে, তোমার আলাদা গামছাটা দেখ ওদিকের কোণে রয়েছে।
আচ্ছা।
মুক্তা ভারী শরীরটা নিয়ে আস্তে আস্তে থপ-থপ করতে করতে তাঁর নিজের ঘরে চলে যান। বছর দুই আগে হাঁটু প্রতিস্থাপন হয়েছে। তারপর থেকে চিকিৎসকের পরামর্শমত চলাফেরা করতে চেষ্টা করছেন।  কাপড়টা এক হাতে তুলে চলেন।  অন্য হাতে ধরা থাকে ওয়াকিং স্টিক। পঁয়যট্টি হতে চলল, তবু আনেক রোগভোগ সয়েও অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে সুবোধের ফ্ল্যাটটা চষে ফেলেন। কোথও এতটুকু ময়লা জমতে দেন না। লকডাউনের পর থেকে হাতে উঠেছে স্যানিটাইজার। বন্দুকের মত তাক করে ঘুরে বেড়ান।
সময়ের অবসাদ কাটতে চায় না—  পাথুরে পাহাড়ি রাস্তার মত তা ঘুরে ঘুরে আসে। সুবোধ সকালের একপ্রস্ত প্রাতরাশ সেরে অফিসের কাজ করতে বসে। বাইরে না বেরিয়েই অফিসের কাজ— ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কিন্তু ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা কম্পিউটারে কাজ করার পর শরীরটা কেমন মিইয়ে যায়। অফিসের টিকাটিপ্পনী থাকে না, থাকে না পরচর্চার মশলা। একটা চায়ের কাপ টেবিলে রেখে সে কাজ করছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় ব্রডব্যান্ডটা বোধহয় অফিসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যাস্ততায় নিষ্প্রাণ হয়ে গিয়েছে।  ছবি বা কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে না। একটি ওয়েব মিটিং ছিল। হল না সেটাও। অবশেষে কম্পিউটারের পর্দায় কেবল চক্রাকারে আইকনটা ঘুরছে।  ঘুরছে অনন্তকাল। যেন এত মানুষ নেটসড়কে বসে পড়ায়, ট্রাফিক জাম হয়ে গিয়েছে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। একঘন্টা, দু’ঘন্টা বাদে পুলিশের গাড়ির ভারী শব্দ শোনা যাচ্ছে।  মাঝখানে ড্রোনও ওড়ানো হয়েছে।  সেই ড্রোন আকাশে নজরদারির পর ঘুরে এসে জানিয়েছে যে মোটের ওপর মানুষজন বাড়িতেই আছে— কিছু মানুষ কেবল ড্রোন দেখতে মুখে মাস্ক খুলে রাস্তায় জটলা করেছে।
বিকেলে মুক্তা চা নিয়ে বসেন।  কিন্তু এখন বড় অসম্ভব একটা সময়। আগে মৃন্ময়ী এসে বিকেলে কমপ্লেক্সের একের পর এক বাড়িতে চা করে দিত। যাকে অসাধু ভাষায় ঠিকে শ্রমিক বা ঝি বলে লেখা হত।  তবে অবস্থা  পাল্টেছে। মৃন্ময়ীর বাড়িতে আলো পাখা টিভি তো আছেই, উপরন্তু দ্বিতীয় পক্ষের এক মধ্যবয়সী মদ্যপ স্বামীও আছে যাকে সে বসে বসে খাওয়ায়। সেই লঘুপদ, দ্রুতহস্তসঞ্চালনপটু, অন্তত দশটি সংসারকে বিকেলে কর্মমুখর রাখার কাণ্ডারিকে  সংক্রমণ নিয়ে আসার ভয়ে, ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কমপ্লেক্সের বড় দরজা থেকেই কবে কাজে আসতে পারবে সে খবর নিয়ে সে চলে যায়। তাই মুক্তার ব্যাজার মুখ দেখে শুভশ্রী বলে ওঠে, চা-পাতা প্রায় ফুরিয়ে এল মা।
বেরোতে তো পারছ না। তোমাদের যা স্বভাব, অনলাইনে অর্ডার দিয়ে দাও।
বাইরের লোকের ছোঁয়া। ঠিক হবে?
রোদে রেখে দিও। ছারপোকা ঠিক হয়ে যায় করোনা হবে না?
টিভিতে আগে সান্ধ্য সিরিয়াল দেখতে দেখতে চা খাওয়া হত। এখন কলাকুশলীদের অভাবে, পুরোন বহুবার দেখা পর্বগুলি বার বার চালানো হচ্ছে। তাই এইসময় মুক্তা খবরে দেখে নেন— সংক্রমণের আগ্রাসনের হালহকিকত। কত হাজার সংক্রমিত, কত শো মানুষ কফিনবন্দি, ক’টি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেল, ক’জন আত্মহত্যা করল, কতজন শয্যা না পেয়ে রাস্তাতেই মরে গেল। কিছুক্ষণ এইসব দেখতে দেখতে ভয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়।  আরো কিছুক্ষণ পর হাই তোলেন মুক্তা। তারপর হয়ত ছেলে এসে দাঁড়ায়।  জিজ্ঞাসা করে, আরো কত দূর?
সবে তো বাড়ছে। কী হবে জানি না।  পুরো কলকাতা রেড জোন। আরো ছড়াচ্ছে। এর মধ্যে মদের দোকান খুলে দিল।
সুবোধ ঢোঁক গিলে বলে, আসলে চোলাই মদ বেড়ে যাচ্ছিল তাই।
ছাই, সরকারের ট্যাক্সের দরকার।
সুবোধ আর কিছু বলে না। মনের মধ্যে কোথাও কাঁটাটা খচখচ করছে।
সেই কথাটা আরেকটু রাত্রি হলে বলে শুভশ্রীকে। তখন চারিদিকে আলো নিভে গিয়েছে। শব্দও রাত্রির পর্দার আড়ালে ঘুমিয়ে পড়েছে। শুভশ্রী বোতলটা বের করেছে।  নিজেদের ঘরে আজ মশারিটা টাঙিয়ে ওরা বসেছে।  সোফার সামনে ছোট টেবিল রাখা, তার ওপর দুটি পানীয়ের পাত্র।  শুভশ্রী স্নান সেরে চুল খুলে, দুর্দান্ত একটা পোষাক পরে এসেছে। সুবোধ বসে আছে যেন সামনে পানীয় নয়, এক বোতল চিরতার জল। তার ঠোঁটের কোনের কান্নাটা হাসির পোষাক পরে উঁকি দিচ্ছে। সে অস্ফুট স্বরে বলে, শোন আমি জীবনে মদ খাইনি। পার্টিতে বসের অনুরোধেও নয়।
তুমি কি মহামানব যে খাও না? আমিও তো কখনও খাইনি। মিডল ক্লাস ফ্যামিলি। নানা ট্যাবু আছে। তা বলে কোনদিনও খাব না? সামান্য ড্রিঙ্ক সমস্ত সিভিলাইজড মানুষমাত্রই করে থাকে। আমি মেয়েমানুষ হয়ে ড্রিঙ্ক করতে চাই আর তুমি পুরুষমানুষ হয়ে—
মা-বাবাও করেনি।
রাজেনমামা খান। ওটাই স্বাভাবিক।  জাস্ট একবার টেস্ট করে দেখলে কি এমন অপরাধ হয়ে যাবে? কেউ হয়ত জানতেই পারবে না। না খাওয়াও এক প্রকার পাগলামি।
বোতল থেকে তরল পানীয় পড়ছে পাত্রে।  মায়াবি হলুদ, তাতে এক ফোঁটা বুদবুদ।  নীচ থেকে ভেসে উঠছে। ঘরের মধ্যে নীল আলোয় যেন সমুদ্রসৈকতের ব্যাঞ্জনা।  দু’জনার পাত্রই অর্ধেক ভরেছে শুভশ্রী।  অপেক্ষা করছে। প্রথম চুমুকটা কখন দেবে সুবোধ। মিনিট তিনেক পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুবোধ নিশ্চল।  অবশেষে শুভশ্রী বলে, আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।
কিন্তু কথাগুলির মধ্যে আর তেজ ছিল না।  বিদ্রোহী শিশুর প্রতিরোধের সামনে মায়ের অসহায়তার আভাস ছিল। সুবোধ মুখটা সরিয়ে অন্য পাশে ফিরিয়ে নেয়।
তাকে খেতে হবে এমনটা নিশ্চিত জেনেও সোফা থেকে উঠে আলমারির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।  সেই ফাঁকে শুভশ্রী এক ঢোঁক খেয়ে নেয়। কিন্তু গলায় যেতে না যেতেই পেটে মোচড় দিয়ে বমি আসে। হড় হড় করে টেবিল আর সোফা ভিজিয়ে বমি করে দেয়।  শুভশ্রীর পোষাক ভিজে। ঘরময় দুর্গন্ধ।  হতভম্ব হয়ে সুবোধ দরজা খুলে ডাকে, মা মা, একবার আসবে।
মাকে ডাকছো! তোমার মাথা খারাপ। দুধের খোকা—
বমি করতে করতে এইটুকুই মাত্র বলতে পারে শুভশ্রী। কী এমন কষ্ট ঘর পরিষ্কার করার। তার জায়গায় কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সঙ্কটকালে মা ছাড়া যেন কিছু ভাবতে পারে না এমন সার্থকনামা স্বামী তার!
মুক্তা তাঁর অক্ষমতা নিয়েও কখন খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
বৌমা।  শেষে কিনা—
কী করব মা? ও বলল খেয়ে দেখ।  এটা এমনি ওসব নয়— এটা ওষুধ।
শেষে তুইও খোকা—
হ্যাঁ, মা। সামনে একটা পার্টি আছে। সেটায় বসের সঙ্গে খেতে হবে। নইলে প্রমোশন হবে না।
ও—
তাই ভাবলাম একটু অভ্যস্ত হয়ে নিই।
এই বয়সে বসে বসে বৌমার বমি পরিষ্কার করি আর কি!
ও জন্যে ডাকিনি মা।
তবে কীসের জন্যে ডেকেছিস?
তোমার কাছে বমির ওষুধ আছে?
জানি না, অনেকদিন তো বেরুনো হচ্ছে না। আচ্ছা খোকা, এই লকডাউনের মধ্যে তোদের কোম্পানির পার্টি হবে! এ কেমন কোম্পানি? সে যাক— ন্যাতাটা নিয়ে আসি গে। তুই বাথরুম থেকে এক বালতি জল নিয়ে আয়।