• facebook
  • twitter
Thursday, 14 August, 2025

নিজের হাতে ভালো কাজ

শ্রেণিকক্ষের ছাত্ররা মোটামুটি ভেবে নিয়েছে অমিত বা ইন্দ্রনাথের মধ্যে কেউ ‘সেরার সেরা’ হবে। অমিত তৈরি করে এনেছে সুন্দর তাজমহল। আর ইন্দ্রনাথের আইফেল টাওয়ারও বেশ দেখার মতো।

কাল্পনিক চিত্র

তাপস বাগ

পৌষের শেষ। উত্তুরে হাওয়া বইছে। শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। মফস্বলের আলোর দিশা হাইস্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস চলছে। শিক্ষকের চেয়ারে শঙ্করকুমার নাথ বসে। ছাত্রদের প্রিয় স্যার। খুব ভালোভাবে পড়া বুঝিয়ে দেন। এমনকি স্কুলের টিফিন টাইমে কোনও ছাত্র যদি কিছু শিখতে বা জানতে চায়, স্যার টিচার্স রুমে বসে ভালো করে বুঝিয়ে দেন। তবে আজ একটু অন্যরকম পরিবেশ। এই পিরিয়েডে আজ পড়া নয়, ‘নিজের হাতে ভালো কাজ’ —স্যার দেখবেন। মানে ছাত্ররা কে কীরকম ভালো হাতের কাজ করে এনেছে সেসব দেখা হবে।

শ্রেণিকক্ষের ছাত্ররা মোটামুটি ভেবে নিয়েছে অমিত বা ইন্দ্রনাথের মধ্যে কেউ ‘সেরার সেরা’ হবে। অমিত তৈরি করে এনেছে সুন্দর তাজমহল। আর ইন্দ্রনাথের আইফেল টাওয়ারও বেশ দেখার মতো। নবীনের শরবতের স্ট্র দিয়ে তৈরি হাওড়া ব্রিজটাও বেশ নজরকাড়া। ছাত্ররা পরস্পর লাইনে দাঁড়িয়ে একে একে তাদের শিল্পকর্ম স্যারের টেবিলে এনে রাখছে। স্যার দেখার পর একটি কাগজে ছোট্ট করে নম্বর লিখে রাখছেন। সকলে হাতের কাজ স্যারকে দেখালেও অতীন বেঞ্চেই বসে রইল। দীপঙ্কর ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। হঠাৎ সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার অতীন হাতের কাজ করে আনেনি।’ শঙ্কর স্যার বললেন, ‘অতীন তোমার ভালো কাজ তো দেখলাম না।’ অতীন মাথা নিচু করে রইল। স্যার আবার বললেন, ‘তুমি তো অনেক বিষয়ে পারদর্শী। বাড়িতে কোনোরকম অসুবিধার কিছু ঘটেনি তো?’ অতীন বলল, ‘স্যার, আসলে আমার কাজটা তেমন ভালো হয়নি। খুবই সাধারণ মানের তাই…।’
‘ঠিক আছে, যদি এনে থাকো, তাহলে নিয়ে এসো’ —স্যার বললেন।

অতীন ব্যাগের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট এনে স্যারের টেবিলে রাখল। স্যার খুলে দেখলেন, বড় রুমালের সাইজে রঙিন কাপড়ের চার ধারে চারটে ফিতের মতো টুকরো ঝুলছে। স্যার বললেন, ‘এগুলো কী?’
—‘জামা, স্যার।’
—‘জামা?’

ক্লাসরুমের সবাই হো-হো করে হেসে উঠল। স্যার ইশারায় ছাত্রদের থামতে বললেন। অতীন, শঙ্কর স্যারের কাছে এসে খুব আস্তে আস্তে কিছু কথা বলল। স্যার কাপড়গুলো আর নম্বরের কাগজটি নিয়ে হেড স্যারের ঘরের দিকে চলে গেলেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন প্রধান শিক্ষক বিক্রমবাবুকে নিয়ে। প্রধান শিক্ষকও ছাত্রদের বেশ কিছু শিল্পকর্ম দেখলেন। শঙ্কর স্যারের সঙ্গে সামান্য আলোচনা করে প্রধান শিক্ষক উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘তোমাদের সকলের হাতের কাজ বেশ সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয়েছে। তবে কাজের নিয়মটা তোমরা অনেকেই ঠিকঠাক পালন করোনি। বিষয় ছিল, ‘নিজের হাতে ভালো কাজ।’ কাজটা তোমাদের নিজেদেরকেই করতে হতো। অনেকের শিল্পকর্ম বাড়ির অভিভাবকরা করে দিয়েছেন। দীপঙ্কর যে ‘ফার্স্ট এইড বক্স’ নিয়ে এসেছে ওটা তো দোকান থেকে কেনা। বাক্সের নিচে দোকানের স্টিকার রয়েছে। আমাদের নজরে পড়েছে। পরের বার থেকে হাতের কাজগুলো তোমরা নিজেরাই তৈরি করবে। নিজের হাতে কাজ করার একটা আলাদা আনন্দ আছে। অতীনের নিজের হাতে তৈরি, চারটে বড় রুমালের মতো রঙিন কাপড়গুলি হল কুকুরদের জামা। ওদের পাড়ায় চারটে কুকুর রাস্তাতেই শুয়ে থাকে। এই প্রচণ্ড শীতে ওদের কষ্টের কথা ভেবে, অতীন নিজে সূচ সুতো দিয়ে সেলাই করে এই জামাগুলো তৈরি করেছে। এগুলো সে তুলে দেবে ওদের এলাকার এক পশু চিকিৎসকের হাতে। অতীনের এই মানবিক কাজকেই শঙ্কর স্যার ও আমি সেরার সেরা হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছি। স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে অতীনকে পুরস্কৃত করা হবে।’’

ক্লাসের সকলের চোখ চকিতে অতীন মন্ডলের দিকে। পৌষের সোনা রোদের লাজুক আলোয় উদ্ভাসিত পিছন বেঞ্চের ছাত্র অতীনের মুখ।

News Hub