নন্দিতা সাহা
রাতের শেষ প্রহর। ভোর প্রায় ছুঁই ছুঁই। দরজায় প্রবল বেগে ঠাস ঠাস শব্দে আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলো ভারতী, এমন অসময়ে! বুকের ভেতর ধক করে উঠলো! বাইরে কলমির গলা মনে হয়! এই অসময়ে! কী হলো!
এক লাফে পালঙ্ক থেকে নেমে সটান দরজা খুলল, পেছনে স্বামী বসুদেব। দরজা খুলতেই কলমি একেবারে হুড়মুড় করে ভারতীর পায়ের উপর এসে আছড়ে পড়ল, হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো দু-পা জড়িয়ে। তার একটাই কথা এক নাগাড়ে বলে চলল,
—বৌদি তুমি কথা দাও আমারে ফিরাইয়া দিবা না, তুমি মোরে মানা করবা না, বৌদি আমরা নিচু জাত গরীব তুমগো বাড়ির চাকর। তবু তুমি আমার কথা রাখবা বৌদি, আমারে কথা দেও বৌদি। ফুরফুরির বাপ মোরে মুখ বেঁকিয়ে কইলো ওরা ধনী, উঁচু বংশ, ওগো কি মান সম্মান নাই! ওরা তোর কথা মোটেই শুনবো না কলমি, তুই মিছাই যাইতেছিস। তাও আমি ছুইটা আইছি বৌদি, বড় আশা নিয়া আইছি গো, কও বৌদি আমার কথা রাখবা।
বলতে বলতে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে কলমি, অথচ ভারতীর পা-দুটো একই ভাবে আঁকড়ে ধরে আছে শক্ত করে। এ তো মহা মুশকিল, কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না ভারতীর, ব্যাপারটা কী হলো! হঠাৎ এই শেষ রাতে কী হলো মেয়েটার! এই ক’দিন তো মেয়েটার পাত্তাই ছিল না। আজ আবার হঠাৎ—!
ভারতী বড্ড নাজেহাল, বলল— আহা আমার পা-দুটো ছাড়তো আগে, তবে তো কথা শুনব। এই অসময়ে হলোটা কী তোর?
কে শোনে কার কথা, কলমি নাছোড়বান্দা, শাড়ির আঁচলে অবিরাম চোখ মুছে যাচ্ছে আর একই গোঁ, মুখে একই কথা, আমারে ফিরাইয়া দিও না বৌদি, আমারে না কইরো না। বড় আশা নিয়া আইছি গো তুমার কাছে।
ঠিক পাঁচ বছর আগে কলমির এমনই রূপ দেখেছিল ভারতী। ভারতী তখন সবে বিয়ে হয়ে এসেছে। কলমি ভারতীর শাশুড়িমা ইন্দুদেবীর দুই পা ধরে কেঁদে পড়েছিল, মাগো আমার স্বামীর পা দুইডা নষ্ট হইয়া গেল, দুধের বাচ্চা মাই পায় না। তুমার বাড়িত কত লোক কাজ করে, মোক একটা কাজ দাও। দুইটা খাইয়া বাঁচি।
তারপর থেকে শাশুড়িমায়ের হুকুমে কলমির এ বাড়িতে কাজ বাঁধা হয়ে যায়। বনেদি বাড়ি, অসুবিধে কী? কত কাজই তো আছে, করুক না কিছু। বাইরের নোংরা কাজ ছাড়াও ভারতীর চুলে বিনুনি করে দেওয়া, মাথায় তেল দিয়ে দেওয়া, শাড়ি পাট পাট করে ভাঁজ করে দেওয়া, এমনকি স্নানের জন্য জল তুলে দেওয়া কলমি এমনিতেই করতো, নিজে থেকেই করতো তাকে বলতে হতো না। পুজোর দিনে নিজেই ভারতীর পা টেনে বসে পড়ত, বৌদি, আলতা পরায় দেই গো।
কলমি সকালে যখন আসতো ওর ছয় মাসের ছোট্ট ফুরফুরিকে একটি কাপড়ের পুঁটুলিতে মুড়িয়ে নিয়ে আসতো। ঘোরানো বারান্দার এক কোণে ফুরফুরিকে শুইয়ে রাখত। ধীরে ধীরে বারান্দার ওই কোনাতে ফুরফুরি বসতে শিখলো, হামাগুড়ি দিতে শুরু করল, তারপর একটু একটু করে হাঁটি হাঁটি পা-পা এগুলো। তখন অবশ্য ফুরফুরির কোমরে দড়ি পড়ল। একটা লম্বা দড়ি কোমরে লাগিয়ে অন্য প্রান্ত লোহার শিকে আটকানো থাকতো। ছয় মিটারের মধ্যেই ও ঘোরাফেরা করতো।
ঝিয়ের মেয়ে বলে কেউ তেমন একটা গা করত না বটে, তবে ভারতী কিন্তু মাঝে-মধ্যে এসে মেয়েটিকে দেখতো। ফুরফুরি গোল গোল করে তাকিয়ে থাকতো ভারতীর দিকে। ভারতী বলতো, কলমি তোর মেয়ের চোখদুটো বড় ডাগর, চকচক করে, যেন কালো হীরে। এদিকে ফুরফুরিও সবার শুনে শুনে কলমিকে ‘কম্মি’ ‘কম্মি’ বলা শুরু করল। না, তাকে দিয়ে কিছুতেই আর ‘মা’ বলানো গেল না। খিদে পেলেই মেয়েটি তারস্বরে ডাকবে, কম্মি, কম্মি।
দেখতে দেখতে ভারতীর শরীর জুড়ে নতুন প্রাণের আভাস, ভারতী ক্লান্ত শরীরে গা ছেড়ে শুয়ে থাকে। কলমি ওর মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। কখনো হাত-পা টিপে দেয়। বলে, বৌদি আরাম কর গো, বাচ্চা হলি পরে সব আরাম যাইবো। ভারতী বিন্দাস, বলে, আমার বাচ্চাটার সামনে তোর ফুরফুরিকে বসিয়ে রাখব। তোর ফুরফুরি ওর সঙ্গে খেলবে, ওই নজর রাখবে আমার আর কী চিন্তা!
ভারতীর কথা শুনে কলমিও হাসে, সে আর তোমারে কইতে হইবো না বৌদি, তুমরা আমগো বাঁচায় রাখছো, তুমরা না থাকলে আমরা! তুমগো করুম না তাই হয়! মোর ফুরফুরি অরে দেইখা রাখব।
ঠিক এক মাস আঁতুড়ঘর কাটানোর পর মেয়ে কোলে ভারতী নিজের ঘরে যখন এল, তখন আচমকা দমকা হাওয়ায় অতর্কিতেই এই অভিজাত ‘রায় ভিলা’র আলো যেন দপ করে নিভে গেল, আঁধারে ছেয়ে গেল চারপাশটা। প্রতিটি ঘরে নিভু নিভু টিমটিমে বাতি। সদ্যোজাত শিশু যত একটু একটু বাড়তে লাগলো, ভারতীর বুকের ভেতর অজানা আশঙ্কাও একটু একটু দানা বাঁধতে শুরু করল। ডাক্তার বদ্যি করা হলো, শেষমেষ আশঙ্কাই যেন রূপ পেল। আঁতুড় ঘরেই ভারতীর বুক কেঁপে উঠেছিল আর সেটি সত্য প্রমাণিত হলো। মায়ের চোখ কি ফাঁকি দেওয়া যায়! যায় না।
ভারতীর মেয়ের দুই চোখ যে ভাষাহীন, কল্লোলহীন, দ্যুতিহীন, সেই সত্যি আর চাপা রইল না। আলো তার দুই নয়নমণি স্পর্শ করেনি। কোনও উপায় নেই। উপায় অবশ্য একটি আছে বটে, কিন্তু সে বড় দুরূহ, সে দূর স্বপ্ন। ভারতী, বসুদেব মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে। ভারতীর চোখের তলে কালি পড়ল, সোনার বর্ণ কোথায় হারালো, বসুদেবের অমন সুঠাম দেহ যেন অনেকটা ঝুঁকে গেল, শাশুড়িমা প্রায় হাঁটাচলা ছেড়েই দিলেন। এক ধাক্কায় তাঁর বয়স একেবারে কুড়ি বছর বেড়ে প্রায় নব্বই হয়ে গেল। কোনোরকমে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে শরীর টেনে টেনে কখনো ক্বচিতে বারান্দায় এসে বসেন। মনে কারও সুখ নেই আনন্দ নেই। এ যে বড় আঘাত। এমনটা তো কেউ ভাবেইনি। কার অভিশাপ? কেন অভিশাপ? নানা প্রশ্নের ভিড় মনে। এমন একটা ধাক্কা সামলানো বড় কঠিন বৈকি। রায় পরিবারের একমাত্র প্রদীপ, সেই প্রদীপ শিখাহীন আলোহীন! একটি জীবন অন্ধকারময়! ভাবা যায়! ভারতী অহরহ ঈশ্বরের চরণে মাথা ঠোকে, যদি কিছু উপায় হয়, যদি ঈশ্বর চোখ তুলে তাকান।
বেশ ক’টি বছর কেটে গেল। ভারতীর মেয়ে মণি কেবল দোলনাতেই বসে থাকে। কলমির মেয়েটি মাঝে-মধ্যে এসেছিল খেলতে মনির সঙ্গে, কিন্তু নাহ, ফিরে গেছে। সেও গিয়ে মাকে বলেছে,
—কম্মি, বুনু তো কেমন আমার দিকে চায় না, কী খেলুম!
ফুরফুরিও এ বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিল। অদৃষ্টকে মেনে নিয়েছে, মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে পরিবার। নিস্তরঙ্গ শুকিয়ে আসা নদীর মত একঘেয়ে স্বপ্নহীন আলোহীন জীবন কেবল এগিয়ে চলছে, দিন কেটে যাচ্ছে। কলমিও আসে যায়। হঠাৎ ক’দিন নিপাত্তা মেয়েটা। কোন জঙ্গলে থাকে কে জানে? আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। বড় বিরক্ত লাগছিল সবার। মাঝে মধ্যে অবশ্য কলমি এমন করে বটে, তাই কেউ গা করেনি।
আজ সাতদিন পর এই শেষরাতে হঠাৎ কলমি এসে হাজির। শোরগোল শুনে শাশুড়িমা কোনোরকমে এসে দাঁড়িয়েছে, বাকিরাও জড়ো হয়েছে। বসুদেবই বলল,
—আহা, তুই বলবি তো কী কথা! তবে না বৌদি—
—না এখানে সকলের সামনে কমু না, শুধু বৌদিরে কমু!
ভেতর ঘরে গেল, পিছন পিছন বসুদেবও গেল। কলমি মুখে আঁচল চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যা বলল শুনে ভারতীর মাথা টলে পড়ে যাবার যোগাড় আর কী! ভাগ্যিস বসুদেব ধরে ফেলল তাই রক্ষে, নইলে হয়তো মাথা ঘুরে পড়েই যেত, রক্তারক্তি কাণ্ড হত! ভারতীর মাথায় হাত, থর থর করে কাঁপছে,
—সর্বনাশ! কী বলিস।
—হ্যাঁগো বৌদি, মেয়েটা আমার সাত দিনের জ্বরে মইরা গেল গো, দুই ঘন্টা আগেই মরল। আমি কাউরে ছুঁইতে দেই নাই, ঠাকুরের দিব্যি দিয়া আইছি, ডাক্তার বাবুরে কইয়া আইছি। বৌদি গো, আমার ফুরফুরের চোখ দুইডা তুমার মণিরে দাও, তাইলে আমি আমার ফুরফুরিরে তুমার মণির মধ্যে দেখবার পামু, অরে বাঁচায় রাখো বৌদি গো, আমার ফুরিরে বাঁচায় রাখো, তোমার পায়ে পড়ি, ফুরিরে মরতে দিও না গো।
উচ্চস্বরে কেঁদে উঠল কলমি।
ভারতী আর থাকতে পারলো না, মুখ চেপে ধরল কলমির,
—ওরে পাগলী তুই বলিস কী! তুই যে আমার কাছে এই মুহূর্তে দেবদূততুল্য, আমার যে তোকে প্রণাম করতে হয় রে, আমি তোকে ফেরাবো কী! এত বড় উপকার, এত বড় উপহার! এ যে অমূল্য রতন! আমার মঙ্গল চণ্ডীই তোকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন! এ যে আমি স্বপ্নেও ভাবিনি!
কলমি কাঁদতে কাঁদতে বলল, অত কিছু বুঝি না বৌদি, তয় আমারে কাজ থিইকা ছাড়ায়া দিও না। আমি এখানেই কাজ করুম আর ফুরফুরিরে দেখুম।
—সে আর বলতে! সারা জীবন। তোকে কথা দিলাম। তুই যে আমাদের বাঁচালি রে কলমি।
বসুদেব তাড়া দিল, শিগগির চলো সব গুছিয়ে নাও, কবে কী হবে ঠিক নেই। দশ বারো দিন তো লেগেই যাবে, কলমি তুইও চল। ভারতী মণিকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিল। কিন্তু কলমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। বলল—
—না বৌদি, আমি যামু না। মরা মেয়ের মুখ দেইখা কী করুম! মোর পরাণ যে ফাইটা যাইব। একেবারে মণির মধ্যেই আমি ফুরফুরিরে দেখুম। তুমরা ভালয় ভালয় ফিরা আইসো।
কলমির দুই চোখে কেবল জল আর জল।
দিন দশেক পর। আলোর ঝরনাধারায় সেজে উঠল অভিজাত ‘রায় ভিলা’। গুটিগুটি পায়ে ছোট্ট মণি সদর দরজা পেরিয়ে ঢুকলো নিজের বাড়ি, মুখে তার মিষ্টি হাসি, চোখে বিস্ময় আকাশ-সমান আনন্দ। উঠোন, বাগান, ঠাকুরঘর, নিজের ঘর, মুগ্ধ চোখে দেখতে দেখতে চোখ পড়ল দরজার আড়ালে। মণি থমকে দাঁড়ালো, নিজের অজান্তেই ছোট্ট মণির মুখ দিয়ে বেরোলো সেই স্বতঃস্ফূর্ত ডাক, কম্মি! কম্মি!
না, আর অপেক্ষা নয়! আড়াল থেকে ছুটে এল কলমি, দুই হাতে বুকে জড়িয়ে ধরল মণিকে। মণির দুই চোখের গভীরে আরও গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল কলমি, চোখদুটো বড্ড চেনা। মণির দুই চোখে কলমি খুঁজে পেল তার প্রাণের ধনকে, বলল, হ মুই কম্মি, কম্মি।
কলমির দুই চোখে আজ ধারা, সুখের ফল্গুধারা। আলোয় ভরে উঠলো একটি জীবন। আনন্দে উদ্ভাসিত দুটি মাতৃহৃদয়।