• facebook
  • twitter
Thursday, 31 July, 2025

গন্ধ

চার-চারটে ছেলের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তোলপাড় পড়ে গেলো। কানাঘুষা শোনা যায় ওদেরকে কেউ বাগদির চরের দিকে যেতে দেখেছিলো। এর বেশি জানা যায়নি।

প্রতীকী চিত্র

ভাস্বতী মাইতি

দাওয়ার একপাশে হরিপদ মেঝেতে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে থালার দিকে তাকালো। পঞ্চমী বড় কাঁসার থালায় ভাত বেড়ে এনেছে। চুড়ো করা ভাত, কুমড়ো আর কুঁচো চিংড়ি দিয়ে পুঁইশাক, বেগুন ভাজা। ডালের গামলা নিয়ে পঞ্চমী এসে বসলো।
‘কই গো, এখনো হাত গুটিয়ে বসে রইলে? ডাল দুবো যে?’

ভাতের গন্ধে অন্য দিন জিভে জল চলে আসে; আজ কই তেমনটা হলো না! খুব অনিচ্ছা সহকারে হরিপদ ভাতের চুড়োয় গর্ত করে; পঞ্চমী ঢেলে দেয় খেসারির ডাল; গুঁজে দেয় একটা লাল টুকটুকে লঙ্কা। হরিপদ ভাত মেখে এক গরাস মুখে দিয়ে লঙ্কায় কামড় দেয়। বেলা একটা বাজে। এতক্ষণের অভুক্ত পেট অন্যদিনের মতই ভাতের প্রত্যাশায় অপেক্ষমান ছিলো, কিন্তু ডাল-ভাতের দলাটা পেটে পৌঁছনো মাত্রই হরিপদর সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠলো। কেমন একটা মেটে আঁশটে গন্ধ ওর সমস্ত ইন্দ্রিয়কে আচ্ছন্ন করে ফেললো আর হরিপদ ধড়মড় করে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে বমি করে ফেললো।

পঞ্চমী দৌড়ে বাইরে গেলো, হরিপদ তখন পেট চেপে ওয়াক তুলছে উঠোনে উবু হয়ে বসে। খালি পেটে বমি বিশেষ হলো না। একপাশে রাখা বালতি থেকে জল ঢেলে মুখ ধুয়ে দাওয়ায় উঠে এলো।

পঞ্চমী ভিজে গামছা এনে ওর ঘাড় মাথা মোছাতে মোছাতে গজগজ করতে লাগলো, ‘বমি তো হবেই। সেই কোন সক্কালে বেরিয়ে যাও। এই এত বেলা অবধি শুধু চা খেয়ে থাকো! তাপ্পরে কাল সারারাত কোথায় ছিলে, কী খেয়েছিলে, এখনো জানতে পারিনি। পেটে পিত্তি পড়ে গেছে!’

হরিপদ বিড়বিড় করে, ‘কাননের দোকানে মুড়ি ঘুগনি খেলাম তো!’
পঞ্চমীকে চিন্তিত দেখায়। ‘তাইলে! এখন বুসো। জল খাও। এমন তো কখনো হয়নি।’
খানিক পরে মুড়ি আনে পঞ্চমী। তাতে জল ঢেলে খায় হরিপদ; সঙ্গে তালের পাটালি; তারপর শোয় ভেতরে গিয়ে।

শীতের দুপুর কাটতে না কাটতেই দাওয়ায় ছায়া পড়ে। হরিপদ চঠপট উঠে পড়ে। বাসস্ট্যান্ডে সহদেবের ভাতের হোটেলে সন্ধে পেরোলেই ভিড়। একপাশে সহদেব নিজে চা বানায়। ওর দুই ছেলে বিরাট তাওয়ায় রোল, চাউমিন ভাজে আর ভেতরে রান্নাঘরে রাতের রান্না হয়। চারটে চৌকো টেবিল পাতা আছে চেয়ার সাজিয়ে। জনা ষোলো সতেরো লোক বসে খেতে পারে।

সহদেবের দোকানের সামনেই বসে হরিপদ রুটি করে। তাল তাল আটা মেখে শ’য়ে শ’য়ে রুটি হয়। আজকাল রুটি কিনে নিয়ে যাওয়ার চাহিদা খুবই। ঘরফেরতা মানুষ রুটি কিনে নিয়ে যায়। হরিপদর সঙ্গে সহদেবের ছেলেরাও হাত লাগায়। পুজো পার্বণের দিনগুলোতে অনেকসময় হরিপদকে রাতে দোকানেই থেকে যেতে হয়। এত রাত হয়ে যায় যে আর ফেরা হয় না।

আজ হরিপদর শরীরটা একটু বেতাল হয়ে গেছে। রুটি বেলতে সময় লাগছে। রুটির খদ্দেরের লাইন লেগে গেলো। ভেতরের টেবিলেও মেলা লোক। সহদেবের ছোট ছেলে খোকন হরিপদর দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো,‘তুমি বরং রুটি ভাজো কাকা। আমি বেলি। শরীর ভালো নেই নাকি?’

দোকানের পাট চুকতে রাত এগারোটা বাজলো। মফস্বল শহরেও লোকজন আজকাল রাত করে বাড়ি ফেরে। তার ওপর আজ শনিবার। শেষ খদ্দেরটিকে বিদায় দিয়ে সহদেব আর ছেলেরা ক্যাশবাক্স গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লো। হরিপদও এগোলো। বাচ্চু আর হরেন এই দু’জন রান্নাঘরের কাজ সেরে, ধুয়ে মুছে, ভেতরেই মাদুর পেতে ঘুমায়।

হরিপদ বাসস্ট্যান্ড পেরিয়ে বাঁদিকে মোড় নিলো। পাকা রাস্তা পেরিয়ে পুলের পাশ দিয়ে একদিকে চলে গেছে সরু রাস্তা। সেদিক দিয়ে গেলে চল্লিশ মিনিট লাগে হরিপদর বাড়ি ঢুকতে। আর এপাশে নেমে গেলে ধানজমির মধ্যে দিয়ে আল ধরে শর্টকাটে চলে গেলে মিনিট কুড়ি।
এতদিন অবধি ওই শর্টকাটেই ফিরতো হরিপদ।
গতকালও ফিরছিলো।

গতকাল মাঘী পূর্ণিমার চাঁদনি রাতের ঝিমধরানো আলোয় শুয়ে ছিলো খেতগুলো আর জমাট বাঁধা কুয়াশা থমকে ছিলো খেতের ওপর। ক’দিন হলো শীতটাও পড়েছে জাঁকিয়ে। কুসুমডাঙার হাট থেকে কেনা মোটা চাদরটায় মাথা কান ঢেকে আলপথ ধরে রোজকার মতো জোর পায়ে হাঁটছিলো হরিপদ। খেতগুলো পেরোলেই ঢালু জমিতে ঘন হোগলার জঙ্গল। তারপর শিবমন্দির। মন্দির পেরিয়ে মিনিট পাঁচেক এগোলেই গ্রামের সীমানা।

খেতগুলো পেরোতেই হঠাৎ মনে হয়েছিলো কারা যেন মন্দিরের পিছন থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে আসছে। এত রাত! প্রায় বারোটার কাছাকাছি; খুব অবাক হয়েছিলো হরিপদ। ইদানিং খুনজখম বেড়ে গেছে খুব। ছেলেগুলো যেন কিছু একটা টেনে আনছে মনে হচ্ছিলো। হরিপদ ঘাবড়ে গিয়ে চট করে গুঁড়ি মেরে হোগলার বনে নিজেকে আড়াল করে সন্তর্পনে তাকালো।
ছেলেগুলো অনেকটা এগিয়ে এসেছে ততক্ষণে। আরো এগোতেই হরিপদ দেখলো চারটে ছেলে একটা শরীর টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে। ঢালু জমিটা পেরিয়ে একেবারে ধানক্ষেতের মধ্যে উঠে এলো প্রায় ওর সামনে আর তখনই আপাদমস্তক চমকে উঠে হরিপদ দেখেছিলো ওই হিঁচড়ে আনা শরীরটা একটা নারীশরীর। ছেলেগুলোর বেসামাল পা ফেলা আর জড়ানো কথা থেকে বোঝা যাচ্ছিলো যে ওরা নেশাগ্রস্ত। চাঁদের আলো থাকা সত্ত্বেও একটা ছেলে টর্চের আলো ফেললো মেয়েটার শরীরে। থরথরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে হরিপদ দেখলো, মেয়েটার শরীরে এক টুকরো কাপড়ও নেই; তার ঠোঁটের পাশ দিয়ে, সারা শরীর বেয়ে রক্তের ধারা ক্ষীণ স্রোতে বয়ে যাচ্ছে; সেই রক্ত মিশে যাচ্ছে ধানক্ষেতের মাটিতে। একবার অস্ফুট শব্দ করে উঠলো মেয়েটা আর নড়ে উঠলো প্রায় না নড়ার মতই আর একটা ছেলে তার শরীরে লাথি মেরে বললো, ‘একে করবি কী এবার?’

ছেলেটির কন্ঠস্বর আর বাচনভঙ্গিতে চমকে উঠে ঘন ঝোপের ফাঁক দিয়ে ভালো করে তাকালো হরিপদ। চাঁদের আলোয় ও চারটি ছেলেকেই চিনতে পারলো। পঞ্চায়েত প্রধান সুজনবাবুর ছেলে রঞ্জন আর তার তিন বন্ধু সমর, অতীন আর চঞ্চল। এদের বাবারাও পার্টির বড়, মেজো, সেজো নেতা।

সমর আর অতীন এবার মেয়েটাকে একটু দূরে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো। তারপর নীচু গলায় কিছু বললো। রঞ্জন পাহারায় থাকলো আর বাকিরা মন্দিরের দিকে ফিরে গিয়ে কাঠকুটো খড়ের গাদা এনে মেয়েটার ওপর পাঁজা করে ফেললো। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মুখে চাদর গুঁজে দিলো হরিপদ, পাছে অজান্তে চিৎকার করে ফেলে। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা টিন থেকে পেট্রল ছড়িয়ে মেয়েটার ওপর জ্বলন্ত দেশলাই ফেলে দিলো ওরা। তারপরেই টালমাটাল পায়ে মন্দিরের পেছনে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।
হরিপদর পা দুটো যেন গেঁথে গিয়েছিল নরম মাটিতে; ঝুপ করে বসে পড়েছিলো ওখানেই। ততক্ষণে কটু গন্ধে ছেয়ে গেছে বাতাস। একটা জীবন্ত নারীশরীর-পোড়া ছাই উড়ছে বাতাসে। সেই আগুন ক্রমে ধরে নিলো আশপাশের শুকনো ডাল, পাতা। শীতের রুখু বাতাসে দাউদাউ করে আগুন জ্বলতে লাগলো আগ্নেয়গিরির মতো।

বেশ খানিকটা দূরের গ্রামে নিদ্রিত গ্রামবাসীদের আচমকা ঘুম ভেঙে গেলো কটু গন্ধে। তারা ঘুমভাঙা চোখে আকাশে উঠতে থাকা আগুন দেখে দৌড়ে আসতে লাগলো দলে দলে, আর হরিপদ দিক ভুলে ছুটতে লাগলো সম্পূর্ণ উল্টোদিকে।

রাত পুইয়ে পুবের আকাশে যখন সিঁদুরে আলো ফুটলো, তখন দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে হাঁটতে হাঁটতে, হরিপদ ঘরে পৌঁছে দেখলো পঞ্চমী চপ ভাজছে। রোজ সন্ধে পেরোলেই হরিপদর বোন মল্লিকা এসে চপ গড়তে সাহায্য করে। ভোররাতে উঠে পাঁচটার মধ্যে ননদ-ভাজে মিলে চারশো চপ ভেজে ফেলে। তারপর স্যালাড কাটে। হরিপদ আর ওর ভগ্নীপতি মোহন, লাল কাপড়ের ঝোলায় চপ, স্যালাড, শালপাতা, কাগজের ঠোঙা নিয়ে ছ’টার মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। মোহন যায় ইস্টিশনে আর হরিপদ বাসস্ট্যান্ডে। পঞ্চমীর হাতের চপ এ অঞ্চলে খুব বিখ্যাত।

ভোরে হরিপদ বাড়ি ঢুকতেই ছুটে এসেছিলো ননদ-ভাজে। পঞ্চমী ওর লাল চোখ আর উস্কোখুস্কো চেহারা দেখে আরো ভয় পেয়ে গেছিলো। হরিপদর কানে কিছু যাচ্ছিলো না। মনে হলো পঞ্চমী বলছে, ‘কী হয়েছিলো গো? ভয়ে তো আমার হাত পা পেটের মধ্যে সেঁদিয়ে গেসলো। এত করে বলি একটা ফোন লও। সেও লিবে না! হোটেলেই ছিলে নাকি রাতে?’

হরিপদ মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়। গতকাল রাতে যদি ওর হাতে ফোন বেজে উঠতো, তাহলে এতক্ষণে পঞ্চমীর শাঁখা সিঁদুর ঘুচতো!

হরিপদ বিজবিজ করে কী যে কৈফিয়ত দেয়, নিজেই জানে না। তারপর পুকুরে গিয়ে চান করে এসে কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝোলায় চপ ভরে বেরিয়ে যায়।

বেলায় ফিরেই শুনেছিলো পঞ্চমী গজগজ করছে, ‘বলি, সারারাত ছিলে কোথায়? কী কাণ্ড হয়েছে ইদিকে! গেরামের সব দৌড়াদৌড়ি; কোথায় আগুন জ্বলছিলো রাতে। তাপ্পরে তো শুনলাম লোকে বলাবলি করতিছে সজলের ছোট মেয়েটারে কারা যেন—’
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই হরিপদ লম্বা লম্বা পা ফেলে পগারপার।

অর্ধদগ্ধ নারীদেহ আবিষ্কৃত হতেই জানা গেছিলো গত দু’দিন ধরে নিখোঁজ ভাগ-চাষি সজল সাঁপুইয়ের ছোট মেয়েটাই এটি।
আজ রাতে পুলের ধারে পৌঁছে, আলপথের দিকে চাইতেই হরিপদর সারা শরীর শিরশির করে উঠলো। মনে হলো যেন ঘন কুয়াশা দলা পাকিয়ে একটা মেয়ের শরীর ধরে ক্ষেতের পর ক্ষেত পেরিয়ে চলেছে আকাশপথে। ও শিউরে উঠে অন্য পথ ধরলো।
রাতের পর রাত হরিপদ ছটফট করে। ঘুমিয়ে পড়লেই দ্যাখে রক্তের একটা নদী ধানক্ষেত দিয়ে বয়ে যাচ্ছে আর হাওয়ায় উড়ছে ছাই। কচি সবুজ লকলকে ধানের চারা বেয়ে চারিয়ে যাচ্ছে লাল তরল। ধড়ফড় করে জেগে উঠে হরিপদ দাওয়ায় গিয়ে বসে, ওইভাবেই রাত কাটে। আর ভাতের থালায় বসলেই ওয়াক তোলে। ভাতে আঁশটে গন্ধ লাগে।

শেষে ভগ্নীপতি ওকে নিয়ে মহকুমা হাসপাতালে যায়। ডাক্তারবাবু ওকে অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে দেন ঘুমের ওষুধ। বলেন, ‘ঠিক একটা করে খাবে। খবরদার তার বেশি নয়। কড়া ওষুধ। সপ্তায় একবার করে এসে নিয়ে যাবে।’

সংবাদপত্র আর টেলিভিশনের লোকেদের চাপে পড়ে পুলিশি ধরপাকড় শুরু হয়। শহরে মোমবাতি মিছিল হয়। একটা টেলিভিশন চ্যানেল মেয়েটির বাবাকে জিজ্ঞেস করে, ‘মেয়ের আধপোড়া মৃতদেহটা দেখে কেমন লেগেছিলো আপনার?’
প্রশ্ন শুনে মেয়ের বাপ ফ্যালফেলিয়ে চেয়ে থাকে।

একদিন হাসপাতাল ফেরত হরিপদ দ্যাখে দুটো রোগা প্যাঁটকা ছেলেকে পুলিশ ভ্যানে তোলা হচ্ছে। এরাই নাকি মেরেছে মেয়েটাকে! হরিপদ আপনমনে হাসে।
হরিপদ ভাত খায় না। ডাল তরকারি দিয়ে মেখে মুড়ি খায়। রাতে এই ঘুমায়, এই জাগে, দুঃস্বপ্ন দেখে উঠে বসে।
রঞ্জন আর সমর একদিন দুপুরে ওদের ঘরে আসে। পঞ্চমীকে দেড়শো ভেজিটেবল চপ আর দেড়শো ডিমের ডেভিলের বরাত দেয়। ওদের দলের মিটিং আছে। দাওয়ায় বসা হরিপদর দিকে তাকিয়ে রঞ্জন হাসে। বলে, ‘কী গো কাকা? একদিন সহদেবের হোটেলের রুটি মাংস খাওয়াও।’

পঞ্চমী মাঝেমাঝেই ওদের থেকে বরাত পায়। তবু ওরা পেছন ফিরতেই হরিপদকে বলে, ‘খপরদার খাইওনি ওদের। পয়সা যেন গাছে ফলে!’
মাস তিনেক পেরিয়ে গেলো। একদিন সন্ধেবেলা হোটেল যাওয়ার পথে হরিপদ দ্যাখে পুলের ধারে রঞ্জন আর তিন স্যাঙাৎ। রঞ্জন বলে, ‘কী কাকা? মাংস রুটির কী হলো?’

হরিপদ কান এঁটো করা হাসি হাসে। বলে, ‘কাল এসো। ভালো মাল আনবো। আর কাউকে বোলোনি; গরীব মানুষ আমি।’
হাসির হুল্লোড় ওঠে।
সমর বলে, ‘জিও কাকা! কোথায় বসা হবে? শিবমন্দিরের পেছনে?’
হরিপদ আঁতকে ওঠে, ‘না না। পঞ্চমী জানতি পারলে ঘরে ঢুকতে দেবে না গো! ওই বাগদীর চরে এসো; নিরিবিলিতে। রাত দশটা নাগাদ। কাউরে বোলোনি। সব ছেলেপুলে আবার ধরবে তখন।’

পরেরদিন সকালে চপ বিক্রি করে বাসে চেপে মহকুমা শহরে গিয়ে বিলিতি মদের দোকান থেকে তিনটে বোতল কেনে হরিপদ। পঞ্চমীকে বলে গেছে আজ একেবারে রাতে ফিরবে। দুপুরে পাঁউরুটি আলু্রদম খেয়ে এদিক ওদিক বিশ্রাম নেয়। তারপর ওখানকারই একটা হোটেল থেকে রুটি মাংস, শালপাতার থালাবাটি আর চারটে কাচের গেলাস কিনে ফিরতি বাস ধরে। সহদেবের হোটেলে ছুটি নিয়েছে আজ।

বাগদীর চরে হরিপদ পৌঁছে যায় দশটার অনেক আগেই। তারপর অপেক্ষা করে।
চার মক্কেল হেলেদুলে আসে দশটা পেরিয়ে। তখনই বেশ নেশা চড়ে আছে মনে হলো ওদের। যত্ন করে শালপাতার থালাবাটিতে হরিপদ বেড়ে দিলো রুটি মাংস। গেলাসে গেলাসে ঢেলে দিলো মদ। খাওয়াটা জোর হলো। চারজনেই শুয়ে পড়লো ঘাসের ওপর। চঞ্চল জড়িয়ে জড়িয়ে বললো, ‘জব্বর মাল খাইয়েছো কাকা! চোখ জুড়ে আসছে!’

হরিপদ বসে রইলো। একে একে চারজনেই ঘুমিয়ে পড়লো অকাতরে। ঘুমোবেই তো! তিনমাস ধরে জমানো ঘুমের ওষুধ গুঁড়ো করে সবটাই হরিপদ মিশিয়েছিলো মদের মধ্যে। এবার একে একে শরীরগুলো টেনে নিয়ে গিয়ে ফেলে দিলো নদীর জলে। থালা বাটি গেলাস উচ্ছিষ্ট, বোতলগুলো ভেঙে সবকিছু ফেললো নদীতে। তন্নতন্ন করে দেখলো কিছু পড়ে আছে কিনা। তারপর ঘরের পথ ধরলো।

চার-চারটে ছেলের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে তোলপাড় পড়ে গেলো। কানাঘুষা শোনা যায় ওদেরকে কেউ বাগদির চরের দিকে যেতে দেখেছিলো। এর বেশি জানা যায়নি।

তিনদিনের মাথায় পাশের গ্রামে নদীর ঘাটে ভেসে এলো একটা মৃতদেহ, সেটা অতীনের। তার চারদিনের মাথায় সমরের পচা গলা শেয়ালে খোবলানো শরীরটা পাওয়া গেলো শ্মশানের গায়ে। রঞ্জন আর চঞ্চলের পচা শরীরগুলোও ভেসে উঠলো একে একে।
হরিপদর চুলে জট, চোখের কোণে পিচুটি, পুলের ধারে উবু হয়ে বসে থাকে আর দ্যাখে ক্ষেতের ওপর ধোঁয়া উঠছে কিনা? পঞ্চমী জোর করে নিয়ে গিয়ে চান করায়, খাওয়ায়, রাতে দরজায় তালা দিয়ে শোওয়ায়। তবে ভাত খায় না হরিপদ কিছুতেই। মাথা নাড়ে আর বলে, ‘ধানের চারা বেয়ে রক্ত গড়ায়। দেখোনি? ভাতে বড় গন্ধ; রক্তের গন্ধ।’

শেষে একদিন থানার সিঁড়িতে পা রাখে হরিপদ। ভেতরে গিয়ে বড়বাবুকে বলে, ‘আমার বয়ানটা লিখে নিন স্যার। চারিদিকে বড় আঁশটে গন্ধ স্যার; রক্তের গন্ধ। হাত পা মাথা ধুয়ে ধুয়েও যায় না মোটে।’