সুব্রত সরকার
সৌমির খুব আনন্দ জেঠু জাপান থেকে ওর জন্য কী সুন্দর একটা রঙিন ছাতা নিয়ে এসেছে। একদম হাল্কা, পাখির পালকের মত হাল্কা। কত রংবাহারি ফুলের ছবি দিয়ে সাজানো ছাতাটা সৌমি মাথায় দিয়ে সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে বেড়ালো। ছাতার ফুলগুলোর নাম চেরিফুল। জাপানের চেরিফুল খুব বিখ্যাত। জেঠু জাপানে গিয়েছিল এই চেরিফুলের ফেস্টিভ্যাল দেখতে। জেঠু একদিন বলেছিল, ‘সুমু, আমি এবার চেরিফুলের দেশে যাব।’
‘চেরিফুলের দেশ!’ সৌমি অবাক হয়ে বলেছিল, ‘সেটা কোথায়? কোন দেশকে চেরিফুলের দেশ বলে জেঠু?’
জেঠু হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘জাপানকে বলে চেরিফুলের দেশ। সেই দেশে যাব চেরি ব্লসমের সময়। শুধুই চেরিফুল ফুটে থাকে তখন জাপানের সব জায়গায়। সারা পৃথিবীর লোক দেখতে আসে। জাপানিরা বলে, সাকুরা ফেস্টিভ্যাল।’
সৌমির জেঠুর পৃথিবী ঘুরে বেড়ানোর নেশা। জেঠু বলে, ‘আমি একশোটা দেশ ঘুরে বেড়াতে চাই।’ এখন পর্যন্ত জেঠুর দেশ বেড়ানো হয়েছে ছত্রিশটা। জেঠু বলে, ‘আমি তো এখনো ইউরোপ, আফ্রিকা যাই-ই নি!… ইউরোপ ঘোরা শুরু করলেই পঞ্চাশ হয়ে যাবে। আফ্রিকা গেলেই সত্তরটা দেশ হয়ে যাবে। একশো নম্বর দেশে যখন যাব, সেই দেশটায় তোকেও নিয়ে যাব! যাবি তো তখন আমার সঙ্গে?’
সৌমি একটু ভেবে বলে, ‘আমি কীকরে যাব? আমার কি পাসপোর্ট আছে?’
‘হা হা হা…’ জেঠু হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘তুই জানিস তাহলে বিদেশে বেড়াতে গেলে পাসপোর্ট লাগে!’
‘জানি তো! তোমার পাসপোর্টে কত দেশের স্ট্যাম্প মারা আছে তুমিই তো দেখিয়েছো।’
‘ঠিক বলেছিস তো। তোর মনে আছে দেখছি।’
জেঠু যখন যে দেশে যাবে, সেই দেশের টাকা ও কয়েন নিয়ে আসবেই আসবে। জেঠুর এক বন্ধু আছেন, তিনি দেশ-বিদেশের টাকা ও কয়েন জমান। এটা নাকি তাঁর হবি। সেই ছোটবেলা থেকে তিনি এই টাকা ও কয়েন জমাতে জমাতে অনেক জমিয়ে ফেলেছেন। জেঠু এবার জাপানের টাকা ও কয়েন নিয়ে এসে সৌমিকে দেখিয়ে বলল, ‘সুমু, দেখ জাপানের টাকা কেমন? ওরা বলে ইয়েন। এই দেখ জাপানের কয়েনগুলো।’
সৌমি জাপানের টাকাটা হাতে নিয়ে বলল, ‘জেঠু এটায় তো ওয়ান থাউজ্যান্ড লেখা!’
‘হ্যাঁ, এটা এক হাজার ইয়েন।‘ জেঠু বলল, ‘জাপানের টাকা শুরু হয় এক হাজার থেকে। বাকি সব কয়েন।’ বলে জেঠু তিনটে কয়েন দেখিয়ে বলল, ‘এই দেখ এটা পঞ্চাশ ইয়েন, এটা একশো ইয়েন, এটা পাঁচশো ইয়েন।’
সৌমি জাপানের ইয়েন ও কয়েনগুলো অনেকক্ষণ ধরে দেখে নিয়ে বলল, ‘এগুলো তোমার বন্ধুকে দিয়ে দেবে?’
‘এক বন্ধুকে নয়। চার বন্ধুকে দেব।’
‘ওরা সবাই এগুলো জমায়?’
‘সবাই জমায় না। একজন ছাড়া বাকি তিন বন্ধুর ছেলে-মেয়েরা জমায়।’
‘জেঠু এগুলো জমিয়ে কী হয়?’
‘এটা একটা আনন্দ। এগুলোকে বলে হবি।’
‘জেঠু তুমি কি জমাও?’
‘আমি জমাই স্মৃতি। দেশ-বিদেশ বেড়ানোর স্মৃতি।’
সৌমি চুপ করে থাকে জেঠুর একথা শুনে। জেঠু তখন হাসতে হাসতে বলে, ‘সুমু, তুই ঠিক বুঝতে পারলি না তাই তো?’
সৌমি এবারও চুপ করে থাকে। জেঠু তখন বুঝিয়ে দেওয়ার মত করে বলে, ‘আমার দেশ-বিদেশ বেড়ানোর আনন্দ অভিজ্ঞতার স্মৃতিগুলোই আমি জমিয়ে রাখছি। অনেক অনেক স্মৃতি আমার জমা হয়ে গেছে বুকের মধ্যে। এই জমিয়ে রাখাটাই আমার আনন্দ। আমার হবি। আমার নেশা।’
‘তাই!’ সৌমি এবার হেসে বলল, ‘খুব ভালো হবি তোমার।’
‘তুইও একটা হবি তৈরি কর। দেখবি কত আনন্দ পাবি।’
সৌমি আবার চুপ করে থাকে। জেঠু তখন বলতে শুরু করে ‘আমার এক বন্ধুর নাতির হবি হলো স্ট্যাম্প কালেকশন। দেশ বিদেশের হাজার হাজার স্ট্যাম্প ও জমিয়ে ফেলেছে।’
সৌমি অবাক হয়ে বলে, ‘তাই জেঠু!’
‘সুমু, বুঝলি সব মানুষেরই একটা করে হবি থাকা উচিত। হবি থাকলে কত আনন্দ পাওয়া যায় জীবনে।’
সৌমির সত্যি কোনও হবি নেই। ও বই পড়ে। ছবি আঁকে। গান গায়। সাঁতার শেখে। কিন্তু ওর কোনও হবি বলে কিছু নেই। তা নিয়ে সৌমি ভাবেওনি কোনোদিন। কিন্তু আজ জেঠুর মুখে হবির কথা শুনে সৌমি ভাবে, আমারও একটা হবি থাকলে ভালো হতো। কত আনন্দ পেতাম সেই হবিটা নিয়ে!
হবির কথা ভাবতে ভাবতে ও চিলেকোঠার বারান্দায় এসে দেখে মা আজও পাখিদের জন্য দানা ছড়িয়ে রেখেছে। একটা বাটিতে জল ভরে রেখেছে। মা এটা রোজ করে। পাখিরা সব জেনে গেছে। ওরা ঠিক উড়ে উড়ে এসে এই দানাগুলো খেয়ে যায়, জল খেয়ে গলা ভিজিয়ে চলে যায়। মায়ের এটা খুব ভালো লাগে করতে। মা রোজ করবেই। পাখিদের খাবার দেওয়া, জল রেখে দেওয়া মায়ের একটা নেশা। এটাকে কি হবি বলা যায়, জেঠু? মনে মনে এ কথা ভাবে সৌমি। জেঠুকে আজ জিজ্ঞেস করবে একবার!
চিলেকোঠার বারান্দায় হঠাৎ খুব চেঁচামিচি। কিচিরমিচির। পাখিরা এসে দানা খাচ্ছে। সৌমি স্কুল ম্যাগাজিনের জন্য একটা লেখা লিখছিল। লেখা থামিয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে কয়েকটা পাখি নিজেদের মধ্যে খুব লড়াই শুরু করেছে, কে কত দানা আগে খেয়ে নিতে পারবে। তাই খুব কিচিরমিচির। সৌমিকে দেখে পাখির দল উড়ে গেল হুশ করে। সৌমি কিছুই বলেনি, বকেওনি। তবু ওরা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল। ওরা উড়ে যেতেই সৌমি কাছে গিয়ে দেখল একটা পাখির পালক পড়ে আছে। হাতে তুলে নিয়ে দেখল কী সুন্দর রঙিন পালকটা। কোন পাখির পালক সৌমি ঠিক বুঝতে পারে না। পালকটা এত সুন্দর যে সৌমি ফেলে দিতে পারে না। যত্ন করে রেখে দেবে ভাবে। ঘরে এসে বইয়ের তাকে গুছিয়ে রাখে।
তারপর স্কুল ম্যাগাজিনের লেখাটা লিখতে লিখতে হঠাৎ ওর ভাবনায় ভেসে ওঠে, এটা তো হবি হতে পারে আমার! পাখির পালক জমাব এবার থেকে। আমাদের বাড়িতে তো রোজ কতরকম পাখি আসে। পাখিদের ভালো করে দেখব। চিনব। ওদের গা থেকে ঝরে যাওয়া পালকগুলো কুড়িয়ে নেব। অনেক পালক হয়ে যাবে আমার। আমিও বলতে পারব, আমার একটা হবি আছে। বার্ড ওয়াচিং ও ফেদার কালেকশন। জেঠুকে বলব, ‘জেঠু তুমিও দেশ বিদেশের পাখিদের পালক আমাকে এনে দিও।’ সৌমির হঠাৎ খুব আনন্দ হলো। ভীষণ খুশি মনে ও ঘর ছেড়ে দৌড়ে চলে গেল মায়ের কাছে। মাকে গিয়ে সবার আগে জানাতেই হবে এ কথাটা!