রূপায়ণ ঘোষ
প্রত্যুষের প্রথম প্রহরের আলো ফুটে রয়েছে; অতি সরল দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করলে অনুধাবন করা যায় প্রথম প্রহরের বেশ কিছু দণ্ড অতিক্রান্ত। সূর্যদেব ক্রমশ রক্তিম থেকে স্বর্ণাভ বর্ণে রূপান্তরিত হয়েছেন, প্রকৃতি যথার্থ শান্ত। দিগন্ত জুড়ে বিহঙ্গদলের মনোরম কলকাকলি যেন অলৌকিক সংগীতের ন্যায় প্রতিভাত হয়। দূরে নগরের শেষ প্রান্তে একটি ক্ষুদ্র পর্ণকুটির; তার ভিতর হতে বাহিরে এল এক দীর্ঘকায় ব্যক্তি। নিবিড় পর্যবেক্ষণে অনুমান করা যায় সে আদতে এক অরণ্যচারী নিষাদ। দেহকাঠামো যেন লৌহ ও ক্ষুরধার ইস্পাতের মিশ্রণ, মুখমণ্ডল শ্মশ্রু-গুম্ফ দ্বারা আবৃত। কাঁধ পর্যন্ত নেমে আসা দীর্ঘ কেশ অযত্নে লালিত, দৃষ্টিতে রাত্রি জাগরণের ক্লান্তি! ব্যক্তিটি ধীরে ধীরে কুটির সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র জলাশয়ে নেমে গেল। কয়েকটি মুহূর্তমাত্র, অনিদ্রার যাবতীয় শ্রান্তি বিসর্জন দিয়ে অচিরেই কুটিরে ফিরে এল সে।
গৃহাভ্যন্তরে ফলাহার প্রস্তুতির শব্দ ধ্বনিত হচ্ছে। সূর্যদেব এক্ষণে অনেকখানি ঊর্ধ্বে বিরাজ করছেন, কুটির প্রাঙ্গণে বনজ পুষ্পরাজি অপরিমেয় শোভায় প্রস্ফুটিত। দিকে দিকে কয়েকটি ক্ষুদ্র কাঠবেড়ালি এক ফল হতে অন্য ফলে মনোযোগ বদলে ফেলছে, রংধনুর ন্যায় অসংখ্য প্রজাপতি ইতস্তত উড্ডয়নশীল— এই সকল দৃশ্য প্রত্যক্ষ করতে করতে মন্দ্র ভঙ্গিতে হলেও ব্যক্তির জঠরাগ্নি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠল। সামান্য উচ্চকণ্ঠে কক্ষাভিমুখে খাদ্যাহ্বান নিমিত্ত স্বরপ্রবাহকে ভাসিয়ে দিল সে। কিয়ৎক্ষণ পরে এক শ্যামাঙ্গী নারী শান্ত পদক্ষেপে কক্ষ হতে বেরিয়ে এল এবং প্রাতঃরাশের সম্ভার সজ্জিত করে পরম আদরে তার বাহুলগ্না হল। চিড়া, দধি, স্বল্প কয়েকটি সুপক্ক কদলী ও রক্তিম মৃৎপাত্রে টলটল করা স্বচ্ছ জলের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নিষাদ অকস্মাৎ স্থির হয়ে গেল। নারীটি ধীরে ধীরে তার অবিন্যস্ত কেশরাশির মধ্যে হস্ত চালনা করে সেগুলি ঠিক করে দিচ্ছিল, মৃদু কণ্ঠে সে এবার বলে ওঠে, ‘সংবাদ শ্রুত হচ্ছে গতরাত্রে পাণ্ডবকুমারেরা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন।’ —একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করে পুনরায় বলে, ‘হস্তিনাপুর এক্ষণে যুবরাজ শূন্য হয়ে পড়ল।’
কথা সমাপ্ত হতেই তার দিকে তীক্ষ্ণ ভ্রূকুটি— কুটিল দৃষ্টিতে চেয়ে রইল নিষাদ। ক্রমশ তার চিবুক প্রস্তর-কঠিন হয়ে উঠছিল। মৃৎপাত্র হতে কয়েক গণ্ডূষ জল পান করে কিয়ৎক্ষণ বারণাবত নগরীর দিকে ধাবিত মেঠো পথ বরাবর চেয়ে রইল। সময় অতিবাহিত হয়ে চলে, অকস্মাৎ অনতিদূরে হ্রেষারব ও অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা যায়। সচকিত নিষাদযুগল মুহূর্তে নতমস্তকে দণ্ডায়মান হয়, অব্যবহিত পরেই দু’জন অশ্বারোহী এসে গৃহ সম্মুখে উপস্থিত হন। অশ্বারোহী দু’জন হস্তিনাপুরের বার্তাবাহক। চারিপাশে একটিবার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তারা মহারাজের ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন, ‘হস্তিনাপুরের যুবরাজ তথা মম ভ্রাতুষ্পুত্র পাণ্ডবকুমারেরা তাদের মাতা কুন্তীসহ বারণাবত ভবনে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যু প্রাপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় সমগ্র রাজ্যে তিনদিবসব্যাপী শোক পালিত হবে। রাজপরিবারের একান্ত অনুরোধ, এই সময়কালে প্রজাগণ নিজ নিজ আনন্দানুষ্ঠান হতে যেন বিরত থাকেন এবং সূর্যাস্ত পরবর্তী সময়ে গৃহে গৃহে দীপালোকের ঔজ্জ্বল্য যেন প্রবল না হয়।’
ঘোষণাপত্র শ্রবণ করতে করতে নিষাদের ওষ্ঠাধরে আশ্চর্য এক হাস্য প্রস্ফুটিত হচ্ছিল। সেই হাস্যের ভিতর একপ্রকার অবজ্ঞা, ঘৃণা ও ক্রোধ পরিলক্ষিত হয়! বার্তাবাহকেরা পাঠ শেষে দ্রুত প্রস্থান করে, কিন্তু নিষাদযুবতীর দৃষ্টিতে তার প্রিয় পুরুষের মুখাবয়বের অভিব্যক্তির এই পরিবর্তন অধরা রইল না। প্রাঙ্গণের এক পার্শ্বে একটি প্রকাণ্ড অশোকবৃক্ষের নীচে দু’জনে উপবিষ্ট হলে যুবতী পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। অতঃপর কৌতুহলী কণ্ঠে বলে, ‘তোমার চেহারার পরিবর্তন আমার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি প্রিয়। কিন্তু কী কারণে এমন ঘটল তা অনুধাবন করে উঠতে পারছি না।’
‘অনুধাবন শব্দটা অনেক বৃহৎ প্রিয়ে, আমরা সর্বদা যা কিছু অনুধাবন করতে সক্ষম তাকে চূড়ান্ত বলে মনে করি। অথচ সত্য এই যে, যা কিছু আমাদের অবগতির বাইরে তার অস্তিত্ব অস্বীকার করি এমনকি সেসবের সংবাদ পর্যন্ত বিস্মৃত হই।’
কথা শেষ করে কিছুক্ষণ সামনের দিকে চেয়ে রইল ব্যাধ। স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে ব্যাধপত্নী বিভ্রান্ত হয়ে উঠল; এই উত্তর তার কাছে একটি রহস্যময় হেঁয়ালি ব্যতীত কিছুই নয়। তবে কী!
ধীরে ধীরে প্রশ্ন করল সে, ‘পাণ্ডবদের মৃত্যু সংবাদ কি তোমায় কোনওপ্রকারে অস্থির করে তুলেছে? তোমায় কখনও তাঁদের বিরোধী রূপে প্রতীত হয়নি। অথচ বার্তাবাহকদের ঘোষণার সময় তোমার অদ্ভুত হাস্যে সহানুভূতি তথা দুঃখের পরিবর্তে ক্রোধ ও ঘৃণা ফুটে উঠেছিল। কেন?’
একটি পিক কোথাও হতে অবিরাম স্বরক্ষেপন করে চলেছে। সেদিকে কয়েক মুহূর্ত মনোযোগ দিয়ে অতিশয় ধীর কণ্ঠে কথা বলল ব্যাধ, ‘বায়স ও পিকের মধ্যে চিরকালীন দ্বন্দ্বের কারণ সম্পর্কে কি তুমি অবগত প্রিয়ে?’
‘হ্যাঁ, তাদের একইপ্রকার আকার-আকৃতি, গাত্রবর্ণ। ফলস্বরূপ সন্তান চিহ্নিতকরণের সমস্যা হতেই এই বিবাদ।’
‘যথার্থ।’ —নিষাদের মুখমণ্ডলে রহস্যময় সেই হাস্য পুনর্বার দৃষ্ট হল, ‘পিকের আপন নীড় নেই, প্রকৃতি তাকে সেই গুণ হতে বঞ্চিত করেছে। ঠিক সেই কারণেই বায়সের নীড়ে সে প্রসব করে এবং প্রয়োজন মতো বায়সের ডিম্ব মাটিতে নিক্ষেপ করে অসূর্যম্পশ্যা ভ্রূণগুলিকে হত্যা করে। সুতরাং ঈশ্বরপ্রদত্ত সুরের যত গরিমাই তার থাক, আত্মরক্ষার্থে নিরাপরাধ প্রাণ হত্যার দায় সে এড়াতে পারে না। বায়স তাদের সন্তান প্রতিপালন করে অথচ তার সন্তান হত্যা করে কোকিলেরা তারই স্থলাভিষিক্ত হয়ে জীবন অতিবাহিত করে চলে, তাই তো সে পরভৃত।’
প্রিয় পুরুষের এই অপ্রাসঙ্গিক রহস্যালাপ ব্যাধিনীর বোধগম্য হল না। সূর্যাস্তের পূর্বেকার মলিন আলো কুটির প্রাঙ্গণে এসে পতিত হচ্ছে। সেদিকেই নিঃশব্দে চেয়ে রইল সে।
২
এক পক্ষকাল অতিবাহিত হয়েছে সমগ্র নগরী ধীর লয়ে পুরাতন জীবনে প্রত্যাবর্তন করছে। নিষাদও বসে নেই, বহু দিন পর অদ্য সে শিকারের উদ্দেশ্যে কুটির হতে নির্গত হল। তির ও ধনুক হাতে ক্রমশ যে গভীর অরণ্যে সে প্রবেশ করল— তা অদ্ভুত শান্ত ও ছায়াচ্ছন্ন। শিকার-নিমিত্ত বহিরাভিমুখী হলেও তার মন আশ্চর্যরকম চঞ্চল। কোনও এক নীরব ব্যর্থতা যেন তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে চলেছে। যেভাবে তৃষিত চাতকের তৃষ্ণা প্রবল ধারাবর্ষণেও তৃপ্ত হয় না তেমনই এক অতৃপ্তি তার সমগ্র সত্তা জুড়ে! এই মনোবস্থা সহযোগেই সে অরণ্য চারণে ব্যস্ত। বেশ কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর বিরাট একটি ক্ষীরী বৃক্ষের নীচে একজন প্রৌঢ় সন্ন্যাসীর সাক্ষাৎ পাওয়া গেল। সন্ন্যাসী ধ্যানমগ্ন, আশেপাশের প্রকৃতি নিরীক্ষণ করলে অনুমিত হয়— তিনি দীর্ঘদিন এই স্থানে সমাধি-লীন হয়ে রয়েছেন। ব্যাধ মৃদু পদশব্দে সন্ন্যাসীর সম্মুখে গিয়ে উপস্থিত হলো এবং প্রণাম জানালো। হেমন্তের বৃক্ষচ্যুত পত্ররাশি ব্যাধের পদভারে মর্মর ধ্বনি তুলল। অতি ধীরে প্রশান্ত ভঙ্গিতে চক্ষু উন্মীলন করলেন সন্ন্যাসী, ব্যাধ যুবকটির প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কয়েকমুহূর্ত চেয়ে রইলেন। অতঃপর, বর্ষাঋতুর কোমল মৃত্তিকার ন্যায় কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হৃদয়ের যে তীব্র উচাটন, তার নিহিত কারণ সম্পর্কে কি তুমি অবগত, বৎস?’
যুবক যারপরনাই বিস্মিত ও অপ্রস্তুত। হাতের অস্ত্র ভূমিতে নামিয়ে সন্ন্যাসীর সম্মুখে নতজানু হল। সামান্য নীরবতা। ধীরে ধীরে সে বলে উঠল, ‘প্রভু, যথার্থ কার্য-কারণ সম্পর্কে আমি অবগত নই। তবে সত্য এই যে— যা নিজের দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছি তাকে মানবের সর্বাপেক্ষা ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড রূপে দেখি।’
‘যদি তার অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে অবগত হও? যদি অনুধাবন করতে সক্ষম হও, সময়ে সময়ে বৃহত্তর স্বার্থে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বলিদান আবশ্যক। তথাপি কি তোমার দৃষ্টিতে সেইসব কর্মকাণ্ড ঘৃণিত রূপেই প্রতিভাত হবে?’ ‘হে তপস্বী, আমায় ক্ষমা করবেন। কিন্তু যত বৃহৎ স্বার্থই সম্পন্ন হোক না কেন, নিরাপরাধীর পরিকল্পিত হত্যার কোনও যথার্থতা থাকতে পারে না।’ —সামান্য স্তব্ধতার পর ব্যাধের কণ্ঠস্বর পুনরায় সচল হয়, ‘মৃগ হত্যা ব্যাঘ্রের অস্তিত্ব রক্ষার নিমিত্ত অতি আবশ্যক। কারণ মৃগ তার সহজাত খাদ্য। কিন্তু হে প্রভু, মানব তো মানবের খাদ্য নয়- সুতরাং একজন মানবের জীবনের স্বার্থ এতখানি বৃহৎ তথা অপরিহার্য হতে পারে না যেখানে অন্যের হত্যা আবশ্যক বলে প্রতীত হয়।’
‘কিন্তু বৎস, এই আহুতি তো একজনের জীবন রক্ষার জন্য নয়। সমগ্র আর্যাবর্তে অত্যাচারী, ষড়যন্ত্রকারী এক দুষ্টের পরিবর্তে ন্যায়, সততা তথা ধর্ম স্থাপনার নিমিত্তই এই আহুতি, এই-ই তো প্রথা।’
অকস্মাৎ হো-হো করে হেসে উঠল ব্যাধ, ‘কে অত্যাচারী আর কেই-ই বা হত্যাকারী? ন্যায়ধর্ম প্রতিষ্ঠার অন্তরালে আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার নিমিত্ত যারা নিরীহ নিদ্রিত ছয়টি প্রাণকে নির্মম রূপে দগ্ধ করে, তারা সততার প্রতিমূর্তি? হে সন্ন্যাসী, যে ন্যায় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠাহেতু অসহায় অবহেলিত মানবের আহুতি আবশ্যক হয়ে ওঠে— আমি বিশ্বাস করি তেমন ন্যায়ধর্ম আদতে আরেক পরাধীনতা, আরও ভয়াবহ দাসতন্ত্রের নির্ণায়ক। রাজ সিংহাসন কখনোই তার জন্য নয়, হতে পারে না।’
সন্ন্যাসী বিস্মিত নেত্রে চেয়ে রইলেন, কয়েকমুহূর্ত তিনি ভেবে পেলেন না কী প্রত্যুত্তর দেবেন। অতঃপর সমস্ত মুখমণ্ডল জুড়ে ম্লান অথচ প্রশান্ত একটি হাস্য ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘হে নিষাদযুবক, তুমি জীবনের বিচিত্র লীলার ভিতর হতে সারসত্যখানি উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছ। সম্মুখে অগ্রসর হও বৎস— কর্তব্য ও অপরিহার্যতা তোমার জন্য প্রতীক্ষারত।’
ব্যাধের ভ্রূ-যুগল সামান্য কুঞ্চিত হলো কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী নয়। সন্ন্যাসীকে প্রণাম করে সে নিবিড় অরণ্যের দিকে অগ্রসর হলো।
৩
প্রভাত ধীরে ধীরে মধ্যাহ্নের দিকে এগিয়ে চলেছে, একটি শালবৃক্ষের অন্তরালে নিষাদ যুবকটি বহু সময় ধরে উপযুক্ত শিকারের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিল। কীট-পতঙ্গের মুহুর্মুহু দংশনে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এমতাবস্থায় অকস্মাৎ একটি কর্কশ কা-কা শব্দে সে সচকিত হয়ে উঠল। বৃক্ষের আড়াল হতে সে লক্ষ করল, একটি বায়স প্রবল আক্রোশে শাখা-প্রশাখায় অদৃশ্য প্রায় একটি কোকিলকে তাড়ন করে চলেছে। মুহূর্তে ব্যাধের ইন্দ্রিয়গুলি টানটান হয়ে উঠল, চক্ষুদ্বয়ের দৃষ্টি কঠিন। সে স্পষ্ট অবলোকন করতে পারছে; স্ত্রী পরভৃতটি অত্যন্ত সন্তর্পণে বায়সের নীড় সন্নিকটে উপস্থিত হয়েছে এইবার সে চঞ্চুঘাতে দু-তিনটি ডিম্ব নিম্নে নিক্ষেপ করবে এবং নিজ ডিম্ব সেইখানে প্রতিস্থাপন করবে। বিদ্যুৎ গতিতে আপন কর্তব্য স্থির করে নিল ব্যাধ; ধনুকে শর সংযোজন করে তীক্ষ্ণ ঋজু ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল। কয়েকটি পল মাত্র, পরক্ষণেই উল্কা বেগে তার শর বায়সের সন্তান হত্যারত পরভৃতটির পালক স্পর্শ করে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল আর সেই সঙ্গে পিক কর্তৃক কয়েকটি ডিম্ব মাটিতে পতিত হয়ে জীবনের অধিকার থেকে ছত্রখান হয়ে পড়ল।
ব্যর্থ নিষাদ দু’হাতে মুখ ঢাকল। তার দুই চক্ষু অশ্রুর অবিরল ধারায় ভেসে যাচ্ছে, বেদনার অন্ধকারে তার সম্মুখে ফুটে উঠছে সেই ভয়ংকর রাত্রি— লেলিহান অগ্নিশিখায় দাউদাউ করে প্রজ্জ্বলিত জতুগৃহ, অগ্নিবর্তিকা হাতে তার সমীপে দণ্ডায়মান পঞ্চরাজপুত্র ও তাদের মাতা। কোনও এক আততায়ীর হস্ত হতে আত্মরক্ষার্থে তাদের এই নরমেধ যজ্ঞ! ব্যাধ নিজের কর্ণযুগল চেপে ধরে। মহাকালের অট্টহাস্যের ন্যায় সেখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে যুধিষ্ঠিরের পৈশাচিক কণ্ঠস্বর;
‘ষট্ প্রাণিনো নিধায়েহ দ্রবামো’নভলক্ষিতাঃ।’
নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে উঠে দাঁড়ায় নিষাদ। রাজার প্রাণের পরিবর্তে নিষাদের প্রাণ তুচ্ছ— সমগ্র আর্যাবর্তে মহান কূটনীতি রূপে প্রতিভাত এই বিশ্বাসকে বাণে বাণে ছিন্ন করে দেওয়াই ছিল তার প্রকৃত কর্তব্য। কিন্তু সে পারেনি; সেই রাত্রিতেও পারেনি… আজও না! ম্লান পদক্ষেপে চলতে আরম্ভ করে ব্যাধ। তার সত্তার গভীরে অনুরণিত হতে থাকে একটিই বাক্য; এক মানবের জীবিত থাকার নিমিত্ত অন্য আরেক নিরীহ মানবের হত্যা কোনওদিন অপরিহার্য নয়, হতে পারে না। এমন অপরিহার্যতা চূর্ণ-বিচূর্ণ করাই কর্তব্য। ব্যাধ অকস্মাৎ অনুভব করে তার আজানুলম্বিত দেহ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে, ক্রমশ তার ধনুকধারিত হাতের মুষ্টি দৃঢ় হয়, পদক্ষেপ আরও প্রবল। নিষাদ এগিয়ে চলেছে সহস্র বৎসরের চিরায়ত প্রথাগুলি ধ্বংস করবে বলে।