বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
নীল রঙের জামাটায় চোখ আটকে আছে আয়ুষের। যেমন জীর্ণ, তেমনই ময়লা। ওর বোধহয় দ্বিতীয় কোনো জামা নেই। সারাদিন ওই জামাটাই পরে থাকে। ছেলেটাকে দেখে সে, অনেকক্ষণ ধরে দেখে। হাসি হাসি মুখ। হরদম কথার খই ফুটছে। গল্প করতে ইচ্ছে করে ওর সঙ্গে। কিন্তু পারে না। বাবা বারণ করেছে— ‘ওরা বস্তির ছেলে, পাত্তা দিবি না একেবারে।’
পাত্তা সে দেয় না, কিন্তু তার মন পড়ে থাকে ছেলেটির হাসিমুখের দিকে। স্কুলে যাওয়া আসার পথে তাকে প্রতিদিন পেরিয়ে যেতে হয় এই রাস্তা। তখন দেখতে পায় রাস্তার কল থেকে জল নিচ্ছে ছেলেটি। কোনোদিন হয়তো দোকান থেকে জিনিষ কিনে আনছে বাড়ির জন্য বা রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে গুলি খেলছে। সেদিন একটা গাড়ির সঙ্গে প্রায় ধাক্কা খাওয়ার উপক্রম, কপাল ভালো যে বেঁচে গেল। ওইটুকুন বাচ্চা, কতই বা বয়স হবে, আট বা নয়। আয়ুষ ভাবে তারও তো এইট প্লাস চলছে। মাস তিনেক আগে ঘটা করে বার্থ ডে সেলিব্রেট হল। তাহলে ছেলেটা তো তারই সমবয়সী। অথচ কত বেপরোয়া। কেউ ওর হাত ধরে রাস্তা পার করে দেয় না। একা একাই সে কেমন সুন্দর হেঁটে বেড়ায়। একা একাই জল আনে। হাটবাজার করে।
আজও নীল রঙের জামাটার দিকে চেয়ে আছে আয়ুষ। আজ অন্যরকম লাগছে তাকে। চেঁচিয়ে কারোও সঙ্গে যেন কথা বলছে। রাস্তা থেকে গলিটা সামান্য দূরে। সব কথা কানে আসছে না। ওদের কথাগুলো শোনার খুব ইচ্ছে হল আয়ুষের। স্কুলভ্যানের আঙ্কলকে বললে নামতে দেবে না।
কতক্ষণ লাগবে গাড়িটা সারতে, আয়ুষ জানে না। ঘণ্টা খানেক তো বটেই। তাদের বাড়ি এখান থেকে দশ মিনিটের পথ। সে রাস্তা চেনে। ইচ্ছে করলে হেঁটেও চলে যেতে পারবে। কিন্তু মা বকবে। বলবে— ‘এত গাড়ি ঘোড়া। ওইভাবে কক্ষণও আসবি না। দেরি হলে হবে। পথে কত বিপদ আপদ।’
আঙ্কল এখন গাড়ির ইঞ্জিনে কিছু কাজ করছে। আয়ুষ তিনবার হাততালি দিল। রবি আঙ্কল তবু তাকাল না তার দিকে। সে বুঝল আঙ্কলের মন এদিকে নেই। সে চুপি চুপি বই খাতা নিয়ে নেমে পড়ল রাস্তায়। রবি আঙ্কল তাকে দেখতে পেল না। অঙ্কিতা, অংশু, নীলাদ্রি, অ্যাটম, রমন, লাডলি এবং সৌমি… ওরা তাকাল তার দিকে। বোধহয় ওরাও ঠিক বুঝতে পারল না কোথায় যাচ্ছে আয়ুষ। তবু ওরা চেঁচিয়ে উঠল— আঙ্কল, আঙ্কল আয়ুষ পালিয়ে যাচ্ছে। রবি আঙ্কল শুনতে পায়নি কথাগুলো।
আয়ুষ সোজা রাস্তা ধরে একটা গলির মধ্যে ঢুকে গেল। এখন সে ছেলেগুলির মুখোমুখি। ওরা ঝগড়া করছে কি? কেমন যেন চেঁচিয়ে চেচিয়ে কথা বলছে ওরা।
‘মেরে তোর হাড়গোড় ভেঙে দেব।’ একটা মোটকা মতো ছেলে টেনে ধরল নীল জামার ছেলেটিকে। ‘দশ টাকা মেরে দিয়েছিস? তোকে কত বিশ্বাস করে বাবা দোকানে পাঠায়। আর তুই কী না। ছিঃ ছিঃ ছিঃ সন্তু। আজ আমি তোর মাথা ফাটিয়ে দেব।’
আয়ুষ এই প্রথম জানতে পারল ছেলেটির নাম সন্তু। সন্তু কাঁদছে। ওর চোখে জল— ‘বিশ্বাস কর গাবলু, আমি তোকে তিরিশ টাকাই ফেরত দিয়েছিলাম। তুই…’
‘কী আমি মিথ্যাবাদী? এক চড়ে তোর মুখের ভূগোল পাল্টে দেব।’
— মায়ের দিব্যি বলছি আমি তোর পয়সা নিইনি।
— তবে কে নিল উল্লুক?
গাবলু মানে ওই মোটকা মতো ছেলেটা জোরে ঘুষি চালাতে গেল সন্তুর দিকে। আয়ুষ ধরে ফেলল তার হাত— ‘আমার বন্ধুকে একদম মারবে না। ও তোমার পয়সা নিতে পারে না।’
এই ঘটনায় দু’জনেই চমকে গেল— বন্ধু! কে তোমার বন্ধু?
‘এই যে সন্তু’— নীল জামার ছেলেটির দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় আয়ুষ।
সন্তু কী করে তোমার বন্ধু হল?
— ওকে আমি রোজ দেখি।
— রোজ দেখলেই বুঝি বন্ধু হয়? গাবলু প্রশ্ন করল আয়ুষকে।
— হয়ই তো, দেখতে দেখতেই তো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
— তাহলে তো তুমিও আমার বন্ধু। তোমাকেও আমি রোজ স্কুল বাসে যেতে দেখি।
— আমার বয়েই গেছে তোমার বন্ধু হতে। তুমি খুব মারপিট কর। তুমি খুব দুষ্টু। তুমি অন্যকে গালি দাও।
— না বন্ধু, আমরা দু’জনের কেউই দুষ্টু নই। নীল জামার ছেলেটি বলে ওঠে। এই অপমান আমার গায়ে লাগে না। ধুলোর মতো ঝেড়ে মুছে দিই। এটাও খেলা।
— খেলা? আয়ুষ এক বুক বিস্ময় নিয়ে চমকে উঠে।
— খেলাই তো। এ তুমি বুঝবে না বন্ধু। বারবার হেরে যাই তবু আবার খেলতে আসি। জলের লাইনে দাঁড়িয়ে আমরা যেমন ঝগড়া করি। আবার লাইন থেকে বেরিয়ে আমার অসুস্থ মায়ের জন্য গাবলুই ডাক্তার ডেকে আনে। সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমিও তেমনই ওর বাবাকে দোকানের কাজে সাহায্য করি। ডিম সেদ্ধ করে দিই। জল এনে দিই।
— তোমরা স্কুলে পড়ো না?
— পড়ি। মানে নাম আছে, যাই।
— কোন স্কুল?
কলতলা থেকে সামনের স্কুলের দিকে আঙুল বাড়িয়ে দেয় সন্তু।
— ওমা ওই স্কুলে কেউ পড়ে?
— আমরা পড়ি। ডিম দেয়, খিচুড়ি দেয়। একবেলা পেট ভরে খেতে তো পাই।
— আজ যাওনি?
সন্তু চুপ করে থাকে। কোনো উত্তর দেয় না। গাবলু বলে— বিশ্বাস কর বন্ধু, ওর কোনো দোষ নেই। ও স্কুলে যেতে চেয়েছিল। আমিই ওকে বারণ করেছি যেতে। বাবার খুব শরীর খারাপ, দোকান খুলতে পারেনি। আমরা দুজনে মিলে চা আর ডিম সেদ্ধ বানিয়ে বিক্রি করেছি এতক্ষণ। তারপর দশ টাকার হিসাব নিয়ে মাথাটা গোলমাল হয়ে গেল।
— তাই বলে তুমি ওকে চোর বলবে? অপমান করবে?
— বলাটা ঠিক হয়নি। কিন্তু কী করব, আমরাও তো গরীব।
— পয়সা আমি নিইনি রে গাবলু। তবু যখন এত করে বলছিস, আমার আজকের দশ টাকা মাইনে থেকে ওটা কেটে নিস।
আয়ুষ লক্ষ্য করে সন্তুর নীল জামার ভেতর একটা অন্য মানুষ। আট বছর বয়স দিয়ে তাকে মাপা যাচ্ছে না। অনেক উপরে উঠে গেছে তার মাথা। অনেক লম্বা লাগছে তাকে। গাছের মত মনে হচ্ছে। অনেক ডালপালা। নীল মতো একটা জামা আছে বাড়িতে। জামাটা পরা হয়নি কোনোদিন। আয়ুষ কতবার ভেবেছে ওই জামাটা দেওয়ার কথা। নীল জামায় কী সুন্দর মানায় সন্তুকে। আজ তার হঠাৎ মনে হল জামাটা কি সন্তুকে খাটো হবে? অনেক বড় লাগছে ওকে। সন্তুকে জামাটা দেওয়ার আগে তাকেও অনেক বড় হতে হবে, অনেক লম্বা ছায়া পড়বে রাস্তায়। ঠিক সন্তুর মতো লম্বা না হলে তার জামা সন্তুকে দেওয়া যাবে না।
মোড়ের মাথার সামনে তারা তিনজন এসে যখন দাঁড়াল তখন তারা আর রবি আঙ্কলকে দেখতে পেল না। দেখতে পেল না স্কুলভ্যানও। সবাই ওকে একা ফেলে চলে গেছে। আয়ুষের তবু ভয় করল না। সে ভাবল বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে তার কষ্ট হবে না, কোনো অসুবিধেও হবে না। সে পথ চিনতে পারছে।
সন্তু বলল— তুমি বাড়ি যাবে কী করে?
একা একাই যেতে পারব।
এই টুকুন বাচ্চা, পারবে না। চল আমরা তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি।
‘এই টুকুন বাচ্চা’ শব্দগুলো খুব গায়ে লাগল আয়ুষের। সে আজ কত সুন্দরভাবে দু’জন বন্ধুকে বিবাদের রাস্তা থেকে ভালোবাসায় পৌঁছে দিয়েছে। আর সে কি নিজের রাস্তা চিনে নিতে পারবে না?
— তোমরা দেখ আমি ঠিক পৌঁছে যাব। লম্বা লম্বা পা ফেলে আয়ুষ বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল। আজ এই প্রথম বাড়ির সামনে এসে সে দেখতে পেল তার ছায়াটা অনেক বড় লাগছে।