• facebook
  • twitter
Saturday, 17 May, 2025

ওদের কথা বলছি

নির্মাল্যর চোখে জল আসে দেখে! ভাবে, এমন বৌ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার! যে কাজটা তার নিজের করবার কথা; বৌটা করে দেয়!

কাল্পনিক চিত্র

বিপদভঞ্জন দাস

গিন্নি বলেছিল, ‘সব সময় উপযাচক হয়ে দিতে চেয়ো না, ঠিক নয় সেটা! যাদের সঙ্গে পারিবারিক বা আত্মিক যোগ সে রকমের ঘনত্ব পায়নি তাদের তো নয়ই! নিম্ন মধ্যবিত্ত এমনকি হতদরিদ্র মানুষটিও তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করতে পারে, এমনকি বিমুখ হবার সম্ভাবনাও থেকে যায়! এটাকে আদিখ্যেতা বা বিলাসিতা বলেও মনে হতে পারে তাদের!’
সব পুরুষ মানুষের ভেতরেই অহংবোধ কাজ করে! ভাবে, আমি যা বলছি, যা করতে চাইছি, সেটাই ঠিক! ভুল করেও বাইরে স্বীকার করতে দ্বিধাবোধ হয়, পাছে স্ত্রীর কাছে পৌরুষে ঘাটতি দেখায়!

শিক্ষা-দীক্ষা একটু ভালো যাদের, তাদের ক্ষেত্রে টানাপোড়েনটা বেশিই! যাদের নেই, কিছুটা নিরীহ, শান্ত প্রকৃতির গৃহিনীরা হাল ছেড়ে দিয়ে স্বামীর বাক্যকেই মেনে নেয়। বর্ধিত সমাজব্যবস্থা এভাবেই চলছে চিরটাকাল!

সবাই নয়! কেউ এমনও আছে মুখোমুখি তারা ঝগড়া করে না, ভাবটা এমন, ‘তুমি শুনলে শোনো, না শুনলে যা ইচ্ছে করো, পরে একটা কথাও বলতে এসো না।’

নরম পেয়ে সারা জীবন এমন করেই বৌটাকে ছোট করে এসেছে নির্মাল্য। বয়স যতো বেড়েছে, শরীরে আর মনের জোর কমতে থেকেছে, গিন্নির প্রতিটা কথাতেই এখন ‘হ্যাঁ তুমিই ঠিক বলছো’ বলা ছাড়া উপায় নেই কোনও!

প্রথম দিকে বৌয়ের কথার অবাধ্য হয়ে বাইরে বেরিয়ে টের পেয়েছে কতো! মনে হয়েছে, কেন ওর কথা শুনে ছাতাটা হাতে করেই বেরোলাম না! এতোক্ষণ ছিল না, বর্ষাকালে আকাশে মেঘ জমতেই বা কতোক্ষণ! পুরনো বন্ধুদের আড্ডায় বসলে সময়জ্ঞান হারায়! কোন ফাঁকে আকাশে ঘন মেঘ জমে ঝমঝমিয়ে নামতে শুরু করেছে, কে জানে! নাওয়া-খাওয়ার সময় পেরিয়ে গেলেও বৃষ্টি ছাড়ার অপেক্ষা ভিন্ন উপায় থাকে না আর। বাড়ি ফিরে কথা শুনতে কার বা ভাল লাগে!

বলতেই হয়, জানোই তো, আমি ভুলো মানুষ! কোথায় রাখতে কোথায় রাখবো, এ দোকান সে দোকান করেও খুঁজে পাবো না! কতোবার ছাতা হারিয়েছি, তাই আর নিতে চাই না গো!

এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এমন আরও আছে! এখন ভুল হয় না। সাধারণত বৌয়ের অবাধ্য হন না নির্মাল্যবাবু, তবু পুরোনো অভ্যাসমতো হয়ে যায়, কখনও!

গত বছর পুজোর মাসখানেক আগে বাড়িটাকে ঝাড়াঝুড়োর সময় হঠাৎ নির্মাল্যর মনে হল, বৌয়ের আলমারি ছাড়াও একখানা বড় বাক্সবোঝাই শাড়ি; এ বছরেও কয়েকখানা হল, রাখবার যেন জায়গা হচ্ছে না! বছরান্তে একখানা নিজে সঙ্গে গিয়ে পছন্দ করে কিনে দেন। মেয়ে দেয়, ছেলে-বৌমা দেয়, নিজের পছন্দমতো কখনো কিনে নিয়েও আসে, খোঁজ রাখে না! কিনলে ছিঁড়তে চায় না আর! এমনটা আগে ছিল না, তখন সব সুতির কাপড়! প্রয়োজন ছিল খুব, দেবার ছিল না কেউ! পরনেরখানা ছিঁড়ে গেলে বলতে দ্বিধা করত সে, নির্মাল্যকেই বলতে হতো, আর ক’টা দিন এভাবেই চালিয়ে নাও!
সাহসটা তার হয়ে গেছে। দু’বছর আগে মেয়ের বাড়িতে দুই নাতির দুটো নিজেদের আলমারি বোঝাই বইপত্র আর পোশাকের গাদাগাদি দেখে বলেই ফেলল, যেগুলো ছোট হয়ে গেছে; ঝোলা ভরে আমাকে দিস, সরকার পাড়ার শিশুরা ছেঁড়া-ময়লা পোশাক পরে ছোটাছুটি করে, শীত আসছে, ওদের দিলে পরতে পারবে।
সরকার পাড়া শুনেই মেয়েটা জানতে চাইল, সেটা আবার কোথায়?

বললাম, তুই ছোটবেলায় যেটাকে বাগ্দিপাড়া জানতিস, সেইটা। এখন নিজেদের বাগ্দি বলে পরিচয় দেয় না ওরা। ভোটের খাতায় সবাই সরকার হয়ে গেছে, তাই সরকার পাড়া! নেতাদের পরামর্শেই হয়েছে, এই বুদ্ধি ওদের হবার নয়! ঘর চল্লিশেক পরিবার, যখন যারা ক্ষমতায় আসে ওরা তাদের লোক হয়ে যায়। বিনিময়ে মদ, মাংস আর কিছু টাকা হাতে পেলেই খুশি! খুব সম্প্রতি শিশুরা স্কুলে যায়। দু’একজন হাইস্কুলের গণ্ডি পেরিয়েছে! ওদের
পিতৃ-পিতামহরা আগের মতোই রয়ে গেছে।

মেয়ে বলল, না থাক। এখানে বিভিন্ন সংস্থা আছে, ওরা গরিবদের দুরবস্থায় দেবার জন্যে ফ্ল্যাটে এসে নিয়ে যায়।
পরে তার কী মনে হল কে জানে; অনেকগুলো প্যান্ট-জামা-টিসার্ট একটা পুরনো ব্যাগে ঠেসে ভরে দিয়ে বলল, তোমার নিতে কষ্ট হবে বাবা! নিতে চাইলে নিতে পারো!

সেই শুরু। বাড়িতে এসে শিশুদের ডেকে বললেন, ‘যার পরনে যেটা হবে, নিয়ে যা!’
মাত্র দশ মিনিটেই সাফা!

তার আগে অবশ্য কাজের মেয়েটিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বড় ছেলের জন্যে বেছে বেছে কয়েকটা আগেই রেখেছে সে।

তার নিজের অবশ্য শাড়ির চেয়ে চুড়িদার বেশি পছন্দের। তাতে কাজ করতেও সুবিধে! নির্মাল্যর মেয়ে আর তার বৌমা সেই অভাব পূরণ করে দিয়ে আসছে কিছুদিন ধরে।

শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় প্রতি রবিবার ওরা কয়েকজনা নির্মাল্যর বাড়িতে নিয়ম করে আসে। অবসর জীবনে ওদের জন্যেই বারান্দায় চেয়ার পেতে রবিবাসরীয় সকালটায় অপেক্ষা করে। প্রতিদিন দেখে, পরনে তাদের ময়লা জীর্ণ পোশাক! তিনি ভেবে বসলেন, বয়স অনুপাতে ওদের মধ্যেই খান কতক শাড়ি বিলিয়ে দিলে কেমন হয়?

গিন্নি একবার বলল, ‘এইসব শাড়ি ওরা পরবে? বিক্রি করে দেবে! ধুয়ে পরিষ্কার করে ইস্তিরি করে রাখা সমস্ত কাপড়!’
বলেছেন, ওটা তুমি আমার ওপরেই ছেড়ে রাখো! নিশ্চয়ই একালের মেয়ে-বৌমা আছে ওদের, ওরাই নাহয় পরবে! বিক্রি করলে ওদের দুটো পয়সা আসবে হাতে, তোমার আলমারিটাও হাল্কা হয়ে যাবে।

বৌ শুনে ঈষৎ বক্র দৃষ্টি হেনে কিছু বলতে গিয়েও বলেনি আর!

তারপরেই কথা শুনতে হয়েছে অনেক! ওদের মধ্যে কে একজন বলেছে, ‘সব পুরানো দিলেন? নতুন দিবেন না?’
তাই তো! ভুল হয়ে গেছে! উপযাচক হয়ে সাহায্য করতে চাওয়া ঠিক কাজ হয়নি!

উত্তরে তাকে বলেওছে, ‘আমরা রাজা না জমিদার? তোমায় একা দিলে হবে? দিলে সবাইকেই দিতে হয়! সেটা কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?’

দু’বার করে তাই ভাবতেই হচ্ছে নির্মাল্যকে! সেইসব দিন আর নেই। বদলে গেছে! বদলেছে মানুষের সামর্থও! সারা বছর কোনো না কোনোভাবে সার্ভিস দেয় যারা; যেমন কাগজঅলা, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, বছরে ছ’সাতটা দিন মাত্র ছুটি থাকে ওদের! সেদিনেও মনে হয় মানুষটা আজ আসবে না, সময় কাটবে কীকরে? প্রতিদিন সুডোকু আর শব্দছক নিয়ে অলস দুপুরটা কেটে যায়। ভাবতে একবারও ইচ্ছে করে না, ওরাও রক্তমাংসের মানুষ! তিনশো পঁয়ষট্টি দিন কি কাজ করা সম্ভব কারোর পক্ষে?

বর্ষায় ঝমঝম বৃষ্টি! কোনোরকমে কাক-ভেজা হয়েও কাগজগুলোকে ঢেকে-ঢুকে রক্ষা করে এনে বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যায় মানুষটা! প্রতিদিন রাস্তা চেয়ে থাকেন নির্মাল্য! গ্রীষ্মের খরতাপে শরীর পুড়িয়ে, ঘামে ভিজিয়ে, সাইকেল চালিয়ে যখন এগিয়ে আসে তাঁর বাড়িটাকে লক্ষ্য করে; ওকে দূর থেকে দেখে শুকনো, ক্ষুধার্ত, একটা কাক ছাড়া কিছুই মনে হয় না আর! আহা বেচারি! মানুষটিকে যতোখানি কালো দেখায়, ততোটা কালো ও নয়; সারা বছর অতি পরিশ্রমের ফলেই এই অবস্থা! রোজগার খুব কম! অপুষ্টিতে ভুগে-ভুগেই এই দশা মানুষটার!

পুজোর আগে তার কথাই ভাবছিলেন বসে! প্রতিমাসে কাগজের দাম রাউন্ড ফিগারেই দিয়ে থাকেন, কামাই করলেও পুরো মাসের পয়সা দিয়ে দেন! চারটাকা, ছ’টাকা, ন’টাকাও অতিরিক্ত হয়ে থাকে কোনো মাসে! গত বছর কাগজ-ছেলে বদলে গেছে এ পাড়ায়। মজুরি না পোষানোয় ছেড়ে দিয়েছে এই কাজ। তাকেও দিতেন, এই মানুষটিকেও একশো টাকা বাড়তি দেবেন, ভাবছেন! আদিখ্যেতা হয়ে যাচ্ছে, ভাববে না তো মানুষটা!

মাসের দাম মিটিয়ে দিতেই বলে উঠল, ‘কাকাবাবু, আরও একশো টাকা লাগবে!’
তবে কি কম দিয়ে ফেলেছে ওকে, ভুল করে!
বিস্ময় প্রকাশ করতে নিজের মুখেই বলে ফেলল, ‘পুজোর বকশিস, কাকাবাবু!’
যাক, যেটা চাইছিলেন; সেটাই হল! বললেন, দেবো! আজ নয়, কাল তোমায় ঠিক দিয়ে দেবো!

এছাড়াও আছে! বছরে একবার এসে বেয়াড়াভাবে বেড়ে ওঠা গাছের ডালপালা কেটে পরিবেশটাকে মানানসই করে দিয়ে যায় ছেলেটা, বছর-বছর পুজোর মুখেই তার ডাক পড়ে! মজুরি যা চায়, পঞ্চাশ টাকা ধরে দিলেই খুশি। ছেলেটির খোঁজ দিয়েছিলেন যিনি, বললেন, ‘ডাক্তার’! নির্মাল্য শুনে থ! ডাক্তার মানুষ ,কীকরে গাছে চড়বে?

হেসে বলেছিল, ‘ওর একটা নাম আছে, পাড়াতে ডাক্তার বলেই সবাই ওকে চেনে! খুব ভাল গাছে চড়তে পারে। উপযুক্ত অস্ত্রখানাও থাকে সঙ্গে। বেশি কথা বলতে হয় না। ফাঁকিবাজ নয়। ও জানে কোনটাকে কাটতে হবে, কোনটা রাখতে! গাছের ব্যালান্স তাতে ঠিক থাকে। তার চেয়েও বড় কথা— ডাল-ডুল, পাতা-লতা কোথায় ফেলতে হবে বলে দিলেই হল! বাড়িওলাকে ভাবতে হয় না! বাড়ি বাড়ি ঘুরে সারাবছর জঙ্গল সাফ করাটাই ওর পেশা, ওকে মানুষ পছন্দ করে!’
সেই থেকেই যখন প্রয়োজন, ডেকে পাঠানো হয়।

এছাড়া আছেন দুধওয়ালা। রোজগার তাদের ভাল। যাকে যতো বিশ্বাস করা যায়, ততোই সে ঠকায়। ছানার জল— পরিমাণ মতো, কিছুটা সয়াবিনের পাউডার, তার সঙ্গে একটুখানি পাম অয়েল, একটুখানি রং মেশালেই দুধের পরিমাণ বেড়ে গেল! নিজের মুখে বলে, ‘আমরা শ্রীকৃষ্ণের জাতভাই! মানুষ কৃষ্ণকে পুজো করে; গোয়ালাকে বিশ্বাস করে না! আমাদের নামেই দোষ! যতো খাঁটিই দিই না কেন; খদ্দেররা বলবেই— দুধে জল মেশাও কেন? এ আমাদের কপাল!’

ওদের অবস্থা তুলনায় ভালো! এমনিতেই মানুষের অবিশ্বাসী, পুজোয় দুধওয়ালা বকশিস চায় না, আশাও করে না!

আছে গ্যাসের ডেলিভারি বয়। দিতে হয় ওকেও। দিতে হয় কাজের মেয়েটিকে, সবাই দিয়ে থাকে! তবু অন্য বাড়িতে ওকে যে কাপড়খানা দেয়, এনে দেখিয়ে বলে, ‘কাকিমা দ্যাখো, এই কাপড় কি মানুষকে দেয়? বছরে একবার, তাও একটু ভাল জোটে না! নিজেদের ডবল-ডবল, কাজের মানুষের বেলায় পয়সা থাকে না!’

নিজেরা আলোচনা করেই এক মাসের মজুরি নির্মাল্যবাবু এবছরেও পঁচিশশো অতিরিক্ত দিয়ে বলেছেন, পছন্দ মতো কিনে নিও!
বলে, ‘না কাকু, এই টাকাতে ছেলেদুটোর কিনে দেবো!’
‘তুমি কেন? ওর বাবা দেবে না?’
‘মদ খাবে; নাকি বৌ-ছেলেকে দেবে! সারা বছর খায়, পুজোগন্ডার দিনে আরও বাড়ে!’
কথা না বাড়িয়ে অন্য প্রসঙ্গে যেতে হয়! কথায় আছে, ‘চোরেরা না শোনে ধম্মের কাহিনী!’

মেয়েটা যেদিন এল, তাকানো যায় না মুখপানে! অপুষ্টি, অনাহার-ক্লিষ্ট, রোগা প্যাঁকাটি যেন! নির্মাল্যর বাড়িতে কাজ একটু বেশিই! স্ত্রীকে বললেন, ওর জন্যে একটু ধরে নিয়ো, অন্যান্য রান্না যা হয় আমাদের ওত্থেকেই হয়ে যাবে ওর!
শুনে গিন্নি বললেন, আমিও ভাবছিলাম সেই কথা! শরীরে জোর না পেলে বেচারি এতোগুলো বাড়িতে কাজ করবে কীকরে! শুনেছি কোলের একটা আছে, বড় হয়েও মায়ের দুধ ছাড়েনি এখনো। বাচ্চাটার জন্যেও শরীরে পুষ্টি দরকার। কাল থেকেই ওকে খেতে দেবো। তুমি জানো না, ও আমায় বলেছে, কাকিমা, আমার জন্যে মুড়ি বা বিস্কুট না রেখে একখানা করে রাতের রুটি রেখে দিও, চা-টা ঠান্ডা হয়ে গেলেও ডুবিয়ে খাবো। আমার ভাল লাগে!

তারপর থেকেই বাড়তি দু’খানা রুটি বানানো হয় রাতে! সে তো গেল সকালবেলা, দুপুরেও ক্ষিদে পায় মেয়েটার। খাবার চাইলে মাইনে কমাতে চায় গৃহস্থেরা। মাইনে কমলে দুটো বাচ্চা নিয়ে সংসার চলে কীকরে একথা ভাবতেই হয় ওকে!
এখন বিকেলের কাজ সারার আগে ভাতটুকু খেয়েই শুয়ে পড়ে মেঝেতে! একটু বিশ্রাম যেমন হয়, কাকিমার সঙ্গে টিভির সিরিয়াল দেখাও চলে। কাজ ফেলে ঘুম তো হয় না, নেশা ধরা সন্ন্যাসীর মতো গড়াগড়ি পাড়তে থাকে বিজ্ঞাপনের ব্রেক দেয় যখন টিভিতে।

একদিন কী কারণে যেন কাকিমার ঘরের টিভি খারাপ হয়ে যাওয়ায় নির্মাল্যবাবুর ঘরে ঢুকেই কাকিমার পাশের চেয়ারটাই বসে পড়ল সিরিয়াল দেখতে! প্রেম, বিরহ, সংসারে হিংসা ছাড়া সিরিজ হয় না আজকাল! নতুন ট্রেন্ড দেখা দিয়েছে দুটো করে বৌ অথবা বৌয়ের সঙ্গে আরও একটা ফেউ, তাই নিয়ে টানাটানি! মাঝেমধ্যে ওই দেখে তরুণীর মনে বড় উচ্ছ্বাস। উচ্চৈঃস্বরে তার আনন্দের বাঁধ-ভাঙা হাসি! কাকিমা ইশারায় ফিসফিসিয়ে বলে, আস্তে। অতো জোরে হেসো না। কাকু ঘুমোয়নি। সিরিয়াল দেখা একদম…।

মেয়ে তখন চুপ মেরে যায়, হাসি পেলেও শব্দ করে না!

কিছুদিন হল, শরীরটায় লেগেছে। বলে, ‘কাকিমা, সব বাড়ির কাজ ছাড়লেও তোমার বাড়ির কাজ ছাড়বো না।’
এবাড়ির ও একটা মেয়ে হয়ে উঠেছে যেন! প্রয়োজনে বাড়ির টয়লেট ব্যবহারেও দ্বিধা নেই তার। কিছু বলে না কেউ।
কোনো-কোনোদিন এখন ছোট বাচ্চাটাকে সঙ্গে আনে। নিজের ভাতটুকু ছেলেটাকে খাইয়ে শেষে একটুখানি মুখে দেয় নিজে! কাকিমা বলে ওঠেন, ‘পুঁচকেটাকে আজ সঙ্গে আনবে, আগে বলোনি তো!’

শুনে লজ্জা পায় হয়তো-বা! নিজের মতো করে একটা যুক্তি খাড়া করে নেয়! মায়ের প্রাণ, কোনও কারণে হয়তো তার মনে হয় বাচ্চাটাকে না খাইয়ে সে খাবে! লজ্জার মাথা খেয়ে কোনোদিন সঙ্গে করে নিয়েই আসে।

এভাবেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় নির্মাল্যর! বাবা ছিলেন চিররুগ্ন! পরপর কয়েকটা ভাইবোন। কী করে, কোথা থেকে, ঠিক যোগাড় করে আনতো তাদের মা! তখন বোঝেনি! যতো বড় হয়েছে, টের পেয়েছে! সাতসকালে বাড়ির কাজ সেরে পাড়ায় বেরিয়ে পড়ত, আসতো সেই বেলা করে আঁচলে তাদের আহার জুটিয়ে নিয়ে! কোনো বড় গৃহস্থের বাড়িতে ঢেঁকিতে চাল কুটে দিয়ে মজুরি নিয়ে ফিরতো মা! দিনের পর দিন দেখেছে এইভাবেই তার মাকে পরের বাড়ির কাজ করতে। অকালে বিনা চিকিৎসায় বাবা একদিন চলে গেলেন। সব দায়িত্ব তখন মায়ের কাঁধে! অন্যের বাড়ি থেকে খাবার চেয়ে আনতেও দেখেছে মাকে! ঈশ্বর তাই হয়তো শুভবুদ্ধিটুকু দিয়েছেন মানুষকে ভাল বাসতে! দিয়েছেন ন্যূনতম সামর্থটুকুও! সঙ্গিনীটিকেও জুটিয়ে দিয়েছেন তেমন করেই। কতোদিন দেখে আসছে, অবশিষ্ট দুটি টুকরোর বড়টিই মেয়েটার জন্যে সরিয়ে রাখে সে! নিজের পাতে মাছের ছোট পিসটুকুই রেখে দেয়! বললে বলে, ‘না, ওটাই ওর জন্যে থাক!’

নির্মাল্যর চোখে জল আসে দেখে! ভাবে, এমন বৌ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার! যে কাজটা তার নিজের করবার কথা; বৌটা করে দেয়! লৌক-লৌকিকতা, নিমন্ত্রণ রক্ষা কিচ্ছুটি ভাবতে হয় না তাকে। তাদের সাধ এবং সাধ্য সবকিছুই বোঝে সে! সেইমতোই পরামর্শ দেয় নির্মাল্যকে।

এর মধ্যেই হঠাৎ একটা দুঃসংবাদ পৌঁছে দিল নির্মাল্যর কানে! দুঃসংবাদ বলবে না তো কী বলবে একে? টাকা দিলে এমন একটা কাজের মেয়ে হয়তো আবারও জুটে যাবে; মেয়েটার জীবনটাই বিপন্ন হয়ে পড়বে এতে! এ যেন নিজের পরিবারের আরও একটা জ্বলন্ত সমস্যা বলে মনে হতে লাগল তার কাছে! গিন্নির মুখে শুনে মুখ দিয়ে কু-কথাটা বেরিয়েই পড়ল! দিগ্বিদিক না ভেবে বলেই ফেলল, ‘দেখেছো মাতালের কাণ্ড! এমনিতেই চলে না, আবারও একটা পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে? হতভাগা এমন সব মাতালদের মরণ হয় না সবগুলোর!’

নির্মাল্য নিজে ধূমপানটুকুও করে না, তাই হয়তো-বা মাতালেরা দু’চক্ষের বিষ! গিন্নিকে বলেই ফেলল, তুমি ওর সঙ্গে কথা বলে দেখো— ক’সপ্তা চলছে! প্রয়োজনে কোনো নার্সিংহোমের ওপিডি-তে ডাক্তারের পরামর্শ নাও! যদি রাজি থাকে, যা খরচা হবে, আমিই দেবো!