• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

৪.
সুরঞ্জনা

Advertisement

ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল–পিয়ালের বন

Advertisement

ক্যালেন্ডার এখন ফাল্গুনের দোরগোড়ায়৷ মনের ঠিকানায় বসন্ত আসছে, কিন্তু কলকাতা শহরে এত বেশি ইট–কাঠ–পাথরের উপস্থিতি, সবুজের ছোঁয়া এত কম যে, বসন্তের আবির্ভাব টের পাওয়া মুশকিল৷ পলাশ-শিমুলের আগুন খুঁজে পেতে বহু পিচপথ পার হয়েও পাওয়া যাবে শুধু হাওয়ার হলকা৷ ক্বচিৎ–কদাচিৎ এক–একটা কৃষ্ণচূড়া বা রাধাচূড়ার উঁকিঝুঁকি৷ কলকাতা শহরে বসন্তের ভরসা ময়দানের কিছু মহীরুহ৷

তমোনাশের ফ্ল্যাট অভিমুখে যেতে যেতে এমন আলটপকা ভাবনায় জারিত হচ্ছিল সুরঞ্জনা৷ তাদের যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাট থেকে রানিকুঠির ‘সন্ধ্যারাগ’ আবাসনের দূরত্ব খুব বেশি নয়৷ ড্রাইভার পুনিতকে ঠিকানা বলতে মোবাইলের জিপিএস খুলে মিনিট পনেরোর মধ্যে পৌঁছে দিল সুরঞ্জনাকে৷

সন্ধে সাড়ে ছ’টা, চারপাশে আলোর ঝরনায় আলোকিত দক্ষিণ কলকাতার এই জ্যামজট–শোভিত রাজপথ৷ আবাসনের গেটের কাছে অপেক্ষা করছিল সুমিতাভ৷ তিরিশোর্ধ্ব সপ্রতিভ যুবক হেসে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলল, ‘আসুন, দিদি৷’ সিকিউরিটিদের ঘরের খুঁটিনাটি সেরে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেল তমোনাশের ফ্ল্যাটের সামনে৷
উঁচু পাঁচিল দেওয়া আবাসনের ভিতরটি বেশ প্রশস্ত৷ তারই একটি ব্লকের একতলায় তমোনাশদের দু–কামরার ফ্ল্যাট৷ একটিতে থাকেন তার মা, অন্য ঘরটিতে তমোনাশ৷ তার মা এই মুহূর্তে ঘরে নেই৷
দরজা খুলল তমোনাশ নিজেই৷ সুমিতাভ বলল, তমো, সুরঞ্জনাদিকে নিয়ে এসেছি৷
তমোনাশ বলল, হুঁ, গন্ধ পেয়েছি৷ আসুন, ভিতরে বসুন—
সুরঞ্জনা কি একটু অবাক হল!

সুমিতাভ সঙ্গে সঙ্গে বলে, সুরঞ্জনাদি, তমোর দৃষ্টিশক্তি নেই, কিন্তু অন্য ইন্দ্রিয়গুলি খুব শক্তিশালী৷ কোনও চেনা মানুষের গায়ের গন্ধ শুনে বলে দিতে পারে মানুষটি কে।

সুরঞ্জনা ঘরের ভিতর টেবিলের এপাশে রাখা চেয়ারে বসে বলল, আমি তো চেনা মানুষ নই৷
—কিন্তু আমি তো চেনা মানুষ৷ তমো জানত আপনাকে আমি পথ চিনিয়ে নিয়ে আসব৷ তাই আমার গায়ের গন্ধের পাশাপাশি আর একজন নতুন মানুষের গায়ের গন্ধ পেতেই বুঝে গেল আপনি এসেছেন৷ এখন আপনার গায়ের গন্ধ ওর মগজে গেঁথে গেল৷
সুরঞ্জনার ভিতরটা শিরশির করে উঠল৷ তার গায়ের গন্ধ মনে রেখে দিল তমেনাশ।

তমোনাশকে এই প্রথম দেখল সুরঞ্জনা, দেখে মুগ্ধ হল৷ বেশ দীর্ঘ শরীর, সুদর্শন, ধবধবে সাদা পাজামার উপর তেমনই সাদা পাঞ্জাবি৷ চোখে কালো সানগ্লাস৷ এমন সুন্দর যুবকের দুটি চোখ নেই। কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে খুব আফশোস হচ্ছিল সুরঞ্জনার৷

ঘরের একদিকে তার শোবার খাট, অন্যদিকে একটি প্রশস্ত টেবিল, মাঝখানে একটি ফ্লাওয়ার ভাস, তাতে রাখা দুটি কাঞ্চন ফুলের মধ্যে একগুচ্ছ রঙ্গন৷ টেবিলের একপাশে রাখা একটি মাঝারি আভিজাত্যের হারমোনিয়াম৷
বেশ পরিপাটি করে গোছানো ঘর৷ কে গোছায় তার ঘর এত যত্ন করে? নিশ্চয় ওর মা।
সুমিতাভ বলল, সুরঞ্জনাদি, আমি এখন যাচ্ছি৷ আপনারা গানে বসুন৷

সুমিতাভ চলে যাওয়ার পর কিছুক্ষণ নিঃস্তব্ধতা৷ তমোনাশ বলল, আমি কিন্তু তেমন ভালো গায়ক নই৷ আপনার পাশে বসার কোনও যোগ্যতাই নেই৷

সুরঞ্জনা বলল, যোগ্যতা আছে কি না তা তো বলবেন শ্রোতারা৷ আগে অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি হই আমরা৷ রত্নদীপদা বলেছেন সব বসন্তের গানই গাইতে হবে৷
—সুমো আমাকে সেরকমই চারটে গান বেছে দিয়েছে৷
—কই দেখি কী কী গান? আমার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে কি না।
তমোনাশ তার খাতাটা বাড়িয়ে দিল সুরঞ্জনার দিকে৷
‘কখন বসন্ত গেল এবার হল না গান’
‘বসন্ত তার গান লিখে যায় ধূলি ’পরে’
‘বসন্তে কি শুধু কেবল ফোটা ফুলের মেলা’
‘বসন্তে ফুল গাঁথল আমার জয়ের মালা’

গানগুলো গুনগুন করে গাইছিল সুরঞ্জনা৷ প্রথম গানটা কি অনুষ্ঠানের সঙ্গে মানানসই হবে— ‘কখন বসন্ত গেল এবার হল না গান৷’ বসন্তের সবে শুরু৷ তার এক অনুরাগী পুরুলিয়ার ছবি পাঠিয়েছে হোয়াটস্যাপে৷ রাস্তার দুধারে শুধু পলাশ আর পলাশ৷ একটা পাহাড়ের গায়েও পলাশের আগুন৷ যেন আগুন লেগেছে প্রকৃতিতে৷ পলাশের রং মানেই আগুনে–রং৷ এই পথ দিয়ে আগুনের মধ্যে ডুবে হেঁটে যাওয়া যায় মাইলের পর মাইল৷ গায়ে আগুনের এতটুকু স্পর্শ লাগবে না, বরং মন ভরে উঠবে এক অনাবিল আনন্দে৷
এখন ‘কখন বসন্ত গেল এবার হল না গান’ গাইলে শ্রোতারা কী বলবেন।

কিন্তু সে–কথা এখনই বলা যাবে না তমোনাশ গুপ্তকে৷ আজই প্রথম আলাপ, গায়ককে বুঝে নিতে সময় লাগবে৷
সুরঞ্জনা চোখ বুলিয়ে বলল, না, আলাদা৷ আমি যে–গানগুলো গাইছি তার সঙ্গে মিলছে না৷
—মিলছে না তমোনাশ আশ্বস্ত হল, বলল, না–মিললেই ভালো৷ আপনি যে–গান গাইবেন, সে–গান আমার গাওয়া ঠিক হবে না
সুরঞ্জনা বলল, রবীন্দ্রনাথ প্রতিটি ঋতু নিয়েও এত–এত গান লিখেছেন যে, মিলে যাওয়াটাই অসম্ভব৷ বসন্তের গান তো বহু৷
তমোনাশ চুপ করে থাকে৷ রবীন্দ্রনাথ কত গান লিখেছেন সে–বিষয়ে তার তেমন ধারণা নেই৷
—তা হলে দু’জনে একসঙ্গে যে–গান গাইব সেগুলো এমন গান ধরি যা আপনিও একক গাইছেন না, আমিও না৷
তমোনাশ বলল, আমাকে আপনি বলবেন ন৷ বয়সের হিসেব করে বলছি না, আপনি এখন আমার গুরু৷ আমার গান–শেখার বয়স খুব বেশি নয়।

সুরঞ্জনা হেসে বলল, ঠিক আছে, তুমিই বলব৷ তা হলে আলাদা গান নিয়ে দ্বৈতসংগীত শুরু করি৷ ‘ওরে বকুল পারুল, ওরে শালপিয়ালের বন’— এই গানে সুরকার বসন্তের বাহার রাগের সঙ্গে মিশিয়েছেন কীর্তন৷ তাল খেমটা৷ নাও ধরো—
সানগ্লাস পরা যুবক তাকিয়ে আছে সুরঞ্জনার দিকে৷ সুরঞ্জনার অবশ্য ভুল ভাঙে৷ তমোনাশ দেখতে পায় না, তার দিকে তাকিয়ে থাকার প্রশ্নই ওঠে না, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে কালো দুটি আয়তাকার কাচ নিবদ্ধ তার মুখের দিকে৷

গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরঞ্জনা শুরু করল:
ওরে বকুল, পারুল, ওরে শাল–পিয়ালের বন
কোনখানে আজ পাই
এমন মনের মতো ঠাঁই
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন।।
সুরঞ্জনা প্রথমে একা গাইল, তারপর তমোনাশ যোগ দিল তার সঙ্গে৷

অস্থায়ী অংশ শেষ করে সুরঞ্জনা বলল, বসন্তের শুরুতে প্রকৃতিতে এখন রঙিন ফুলের মেলা৷ কবি আহ্বান করছেন বকুল, পারুল, শাল–পিয়ালকে৷ বৃক্ষগুলির প্রতি ডাল এখন ফুলে–ফুলে ভর্তি৷ এত ফুলের সমাহার, কবি তার মধ্যে কোথায় ঠাঁই নেবেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না, কারণ তার সমস্ত মন দিয়ে এখন ভরিয়ে দিতে চাইছেন ফাল্গুনকে৷
সারা গগনতলে তুমুল রঙের কোলাহলে
মাতামাতির নেই যে বিরাম কোথাও অনুক্ষণ…

সারা পৃথিবীর এই তুমুল রঙের কোলাহলের মাতামাতির কোনও বিরাম নেই৷ বসন্ত হইহই করে এসে পড়েছে মানুষের জীবনে৷ প্রকৃতির এই রং এখন রাঙিয়ে দিচ্ছে মানুষের মন৷

সুরঞ্জনা দেখছে তমোনাশের গলায় এক আশ্চর্য উন্মাদনা৷ তমোনাশের গান এর অগে শুনেছে ইউ টিউব খুলে, তখন এত উৎফুল্ল লাগেনি তার কণ্ঠ৷ তবে কি সুরঞ্জনার আগমনে তার কণ্ঠে এনে দিয়েছে এক অপরিমেয় আনন্দের লহরী!
—তমোনাশ, একটু খেয়াল করে দেখো, রবীন্দ্রনাথ বসন্তের যে ফুলগুলোর কথা লিখেছেন তারা কিন্তু সেই অর্থে রঙিন নয়৷ বসন্তের গায়ে যারা আসল রং মাখায়, সেই পলাশ, শিমুল, অশোকের কথা লেখেননি, এমন কি কৃষ্ণচূড়ার কথাও নয়৷ কেন লেখেননি জানো?
তমোনাশের মুখে ম্লান হাসি, কেন?
—কারণ গবেষকরা বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ রংকানা ছিলেন, তিনি রং বুঝতে পারতেন না
তমোনাশের মুখে আরও ম্লান হাসি, বলল, সুরঞ্জনাদি, আমার কাছে সব ফুলের রংই এক৷ আমার জীবনে কোনও লাল নীল সবুজ নেই৷ শুধু কালো আর কালো৷

সুরঞ্জনা উপলব্ধি করল বিষয়টা৷ বুঝে লজ্জিত হল৷ তমোনাশের কাছে আজই প্রথম এসেছে৷ তার পৃথিবী যে সবার চেয়ে আলাদা, তা স্মরণে থাকছে না তার৷ বলল, তমোনাশ, আমার ভুল হয়েছে৷
—ভুল নয়, সুরঞ্জনাদি, আপনি আস্তে আস্তে বুঝে যাবেন, আমি এক অন্য পৃথিবীতে বাস করি৷
সুরঞ্জনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তার পরেও কী করে এত সুন্দর গান করো ঠিক আছে, এবার সঞ্চারী শুরু করো:
আকাশ নিবিড় করে
তোরা দাঁড়াস নে ভিড় করে
আমি চাই নে চাই নে চাই নে এমন
গন্ধরঙের বিপুল আয়োজন৷
—কবি বলছেন, ও বকুল, ও পারুল, আকাশ নিবিড় করে ভিড় করে দাঁড়িও না৷ এমন মাতাল করা গন্ধের, এমন বিপুল রঙের আয়োজন তিনি চান না৷ তিনি চান:
অকূল অবকাশে যেথায় স্বপ্নকমল ভাসে
দে আমারে একটি এমন গগন–জোড়া কোণ—
যেথায় ফাগুন ভরে দেব দিয়ে সকল মন,
দিয়ে আমার সকল মন।।

গানের আভোগে এসে কবি চাইছেন একটি অকূল অবকাশ, স্বপ্নকমল ভেসে বেড়াচ্ছে এমন একটি গগন–জোড়া কোণ, সেখানেই সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে ভরিয়ে দেবেন ফাল্গুনকে৷

গানটি শেষ হলে বহুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল তমোনাশ। তারপর বলল, সুরঞ্জনাদি, আমাকে এমন দরদ দিয়ে কেউ গান তুলে দেয়নি কখনও৷ অমিত স্যার গান তুলে দেন, যেটুকু শেখার তাঁর কাছ থেকেই শিখছি এ ক’বছর৷ কিন্তু আপনি যেমন গানের অর্থের গভীরে গিয়ে শেখালেন তা আমার কাছে অমূল্য৷

সুরঞ্জনা বলল, গানের অর্থ জানলেই তো যথার্থ মনোযোগ থাকবে গানের সুরে৷
—সুরঞ্জনাদি, শুনেছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছেন সুচিত্রা মিত্রের কাছে তাঁর রবীন্দ্রসংগীত শেখা৷ একবার আশুতোষ কলেজে ‘চিত্রাঙ্গদা’ মঞ্চস্থ হয়েছিল, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলেছেন, সেবার সুচিত্রা মিত্রের কাছে অর্জুনের গান শিখেই তিনি গান গেয়েছিলেন মঞ্চে অভিনয়ের সময়৷
—ওঁদের দু’জনের ডুয়েট খুব জনপ্রিয় ছিল সেসময়৷ রাজেন সরকারের ‘মহাশ্বেতা’ ছবিতে দু’জনে গেয়েছিলেন ‘আগুনের পরশমণি’ গানটা৷

তমোনাশ উৎসাহিত হয়ে বলল, এই গানটাও তো আমরা এদিন ডুয়েট গাইতে পারি? আমার সবচেয়ে প্রিয় গান৷
—না, তা কী করে হবে বসন্তপঞ্চমীর দিনে শুধুই বসন্তের গান৷ বরং অন্য কোনও অনুষ্ঠানে এই গানটা গাইব৷ অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গাইতে হবে এই গান৷ পরের কোনও দ্বৈত অনুষ্ঠানে৷

তমোনাশ দ্বিধা–দ্বিধা গলায় বলল, কী জানি আপনার সঙ্গে আর কোনও অনুষ্ঠানে আমাকে কি গাইতে দেবে?
সুরঞ্জনা হাসল, বলল, যদি বসন্তপঞ্চমীর অনুষ্ঠান সফল হয়, তা হলে নিশ্চয় আবার দু’জনকে এক আসরে কেউ না কেউ ডাকবে৷

সহসা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তমোনাশের অভিব্যক্তি, বলল, আমাকে সফল হতেই
হবে, সুরঞ্জনাদি৷

(ক্রমশ)

অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়

Advertisement