• facebook
  • twitter
Sunday, 20 July, 2025

সংস্কারমুখী নয় ভোটমুখী বাজেট

কেন্দ্রীয় বাজেটে ওষুধের দাম কমবে কি না, সে দিকে তামাম দেশবাসীর নজর ছিল

নিজস্ব গ্রাফিক্স চিত্র

জল্পনা ছিলো আকাশছোঁয়া। বাজেট পাশের আগে কাটাছেঁড়া, বিশ্লেষণ কম হয়নি। লোকসভা নির্বাচনের পর প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেটে প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ঝোড়ো ইনিংস খেলতে পারেন কিনা, সেই দিকেই তাকিয়ে ছিলেন অনেকেই। শনিবাসরীয় সকালে বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। যা নিয়ে এখন চর্চা দেশ জুড়ে। তবে অথনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বাজেট বিশ্লেষণ করে একটা কথাই জানাচ্ছেন, সংস্কারমুখী নয়, ভোটমুখী বাজেট পেশ করেছেন মোদী-নির্মলা জুটি। ১৯৯১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিং ও প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও যে সাহস দেখিয়েছিলেন তা দেখাতে পারলেন না তাঁরা।

এদিন বাজেটের শুরুতে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী তেলুগু কবি গুর্জরা আপ্পা রাওয়ের একটি কবিতা ব্যবহার করেছিলেন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘দেশ বলতে কেবল তার মাটি নয়, দেশ বলতে সেখানের বসবাসকারী মানুষ। সেই ভাবনাকে মাথায় রেখেই এবারের বাজেট পেশ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। নির্মলা সীতারামনের বাজেটের সারাংশ যদি তুলে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, চিকিৎসার ক্ষেত্রে ক্যান্সারের মতো মারণ রোগের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করা হয়েছে এবারের বাজেটে। এ বছরের কেন্দ্রীয় বাজেটে ওষুধের দাম কমবে কি না, সে দিকে তামাম দেশবাসীর নজর ছিল। মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের সেই আশা কিছুটা হলেও পূরণ হলো নির্মলার বাজেটে।

ক্যান্সার সহ একাধিক মারণরোগের ৩৬টি জীবনদায়ী ওষুধে ১০০ শতাংশ কর ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। এছাড়া ৬টি জীবনদায়ী ওষুধের উপরে শুল্ক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নির্মলা জানান, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের কথা মাথায় রেখেই কেন্দ্র এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো, বছরের শেষদিকে চোখের ছানি, অ্যাজমা, যক্ষ্মা, থ্যালাসেমিয়া-সহ আরও একাধিক ওষুধের দাম এক ধাক্কায় অনেকখানি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়েছিলো ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি।

স্বাভাবিকভাবে এই সিদ্ধান্তে বিপাকে পড়েছিলো আমজনতা। তবে এদিনের বাজেটে ওষুধে ১০০ শতাংশ কর ছাড়ে কমবে ওষুধের দাম। সুতরাং রোগীস্বার্থে এই ঘোষণা যে নিঃসন্দেহে অনেক বড় সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
এখানে শেষ নয়, ৩ বছরে মেডিক্যাল কলেজগুলিতে ১ লক্ষের বেশি আসন বৃদ্ধি করেছে কেন্দ্র। আগামী বছরে তা আরও ১৩০ শতাংশ বর্ধিত করে ১০ হাজার আসন যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। তা ছাড়া বিভিন্ন ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক কর্মীদেরও প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা-র আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা। এর ফলে দেশের প্রায় ১ কোটি চুক্তিভিত্তিক কর্মী উপকৃত হবেন বলে মনে করছেন তিনি।
এবারের বাজেটে বাড়তি বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে কৃষি, মহিলা এবং যুবসমাজকে। কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়ার আরও একটা কারণ হলো কয়েকমাস ধরে কৃষক আন্দোলন মোদী সরকারকে বারবার বিব্রত করেছে। এদিনের বাজেটে বড় ঘোষণা পিএম ধনধান্য কৃষি যোজনা। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মোট ১০০টি জেলার ১ কোটি ৭০ লক্ষ কৃষক এই প্রকল্পে উপকৃত হবেন। রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে মিলে ওই ১০০টি জেলায় কৃষি উন্নয়নে কাজ করবে কেন্দ্র। এছাড়াও পিএম ধনধান্য কৃষি যোজনা। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, মোট ১০০টি জেলার ১ কোটি ৭০ লক্ষ কৃষক এই প্রকল্পে উপকৃত হবেন। রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে মিলে ওই ১০০টি জেলায় কৃষি উন্নয়নে কাজ করবে কেন্দ্র। তবে কৃষক আন্দোলনের যে মূল দাবি কিষান সম্মান নিধি বাড়ানোর কোনো ঘোষণা এবারের বাজেটে করা হলো না। সার ও কীটনাশকে ভর্তুকি বাড়ানোর দাবিও দীর্ঘদিনের। কিন্তু নির্মলার বাজেটে এর কোনও ঘোষণাই নেই। ফলে বাজেটে কৃষকদের প্রাপ্তির চেয়ে অপ্রাপ্তির পরিমাণটাই বেশি।

এবারের বাজেটে এই বাজেটে মহিলাদের জন্য বিশেষ বিশেষ প্রকল্প এবং সুযোগসুবিধা এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। মহিলা উদ্যোগপতিদের আরও শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ২০২৫-২৬ আর্থিক বছরের বাজেটে যে নারীরা উদ্যোগপতি হয়ে সামনে আসতে চান, তাদের সহযোগিতা করা হবে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। সাধারণ মহিলা উদ্যোগপতিদের ৫ লক্ষ তফসিলি জাতি এবং তফসিলি উপজাতিভুক্ত মহিলারা ২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ পেতে পারেন।

বাজেটের আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বিমা ক্ষেত্রকে আরও বেশি চাঙ্গা করা। বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের দরজা পুরোপুরি খুলে দিলেন নির্মলা। এদিনের বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেছেন, বিমায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট বা এফডিআই) পরিমাণ ১০০ শতাংশ করা হবে। এত দিন পর্যন্ত বিমায় এফডিআইয়ের সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৭৪ শতাংশ। তবে এই ১০০ শতাংশ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ একটি শর্তও আরোপ করেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। তাঁর বক্তব্য, যে সমস্ত বিমা সংস্থা তাদের সম্পূর্ণ প্রিমিয়াম এ দেশে লগ্নি করবেন, তাঁদের ক্ষেত্রে বর্ধিত এফডিআইয়ের নিয়ম প্রযোজ্য হবে।

বাজেটে পর্যটন ক্ষেত্রকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে হোম স্টেগুলির শ্রীবৃদ্ধি মুদ্রা লোনের আওতায় আনা থেকে ৫০টি পর্যটন কেন্দ্রের উন্নয়ন, চিকিৎসা পর্যটন বা মেডিক্যাল টুরিজমে জোর দিয়েছেন নির্মলা সীতারামন। বাংলার বিভিন্ন পর্যটন স্থানে হোম স্টেগুলিতে বারবার জোর দেওয়ার কথা বলে থাকেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্য সরকারের তরফে হোম স্টে-র পরিকাঠামো বৃদ্ধিতে সাহায্যের কথাও বলেন। এবার কেন্দ্রও সেই পথেই হাঁটল।

ভারতীয় অর্থনীতির হালহকিকত যে বিশেষ সুবিধার নয়, সেটা বোঝা গিয়েছিল অর্থনৈতিক সমীক্ষার রিপোর্টেই। অর্থনৈতিক সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, আগামী বছরের সম্ভাব্য জিডিপি বৃদ্ধির হার ৬.৪ শতাংশ। ভারত সরকার ২০৪৭ সালের মধ্য বিকশিত ভারত হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার যে লক্ষ্যমাত্রা রেখেছে সেটা অর্জন করতে হলে অন্তত টানা ১০ বছর ৮ শতাংশের বেশি হারে জিডিপি বৃদ্ধি জরুরি। মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মধ্যবিত্তর সঞ্চয়ে হাত পড়ছে। দেশের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সঞ্চয় কমছে। ফলে অর্থনীতির জোগান এবং চাহিদার মধ্যে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পরিস্থিতি বদলাতে বাজেটে বড় ঘোষণা করতেই হত অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনকে।