গৌতম মণ্ডল
ভারত পাকিস্তানের সংঘাতের আবহকে কাজে লাগিয়ে গত ৯ মে বালচিস্তান লিবারেশন আর্মিসহ আরও কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন বালুচিস্তানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে দাবি করে। বিশিষ্ট বালুচ লেখক ও স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মুখ মীর ইয়াব বালোচ সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করেছেন: Balochistan gained independence from pakistan। শুধু তিনি ঘোষণাই করেছেন, তা নয়, বালুচিস্তানকে একটা স্বাধীন দেশের স্বীকৃতি চেয়ে ভারত এবং রাষ্ট্রসংঘের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। দিল্লিতে তাঁদের দূতাবাস খোলারও অনুমতি চেয়েছেন।
দীর্ঘদিন ধরেই স্বাধীনতাকামী বালুচদের কেউ কেউ ভারতীয় গণমাধ্যম এবং বুদ্ধিজীবীদের জানিয়েছেন, তাঁরা পাকিস্তানি নন, তাঁরা বালুচ এবং সংস্কৃতির দিক দিয়ে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয়দের বন্ধু। তাঁদের এই লড়াইয়ে তাঁরা ভারতীয়দের সমর্থন চান।
এখন প্রশ্ন, ভারত কী করবে? করা উচিত? এর উত্তরে আমরা যেতে চাইব ঠিকই, কিন্তু আমরা বালুচদের ইতিহাস ও পাশাপাশি একটু ভূগোলও জেনে নিতে চাইব।
বালুচিস্তান দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রদেশ। ভৌগোলিক দিক থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম এই প্রদেশটির আয়তন ৩,৪৭,১৯০ বর্গকিলোমিটার এবং এটি পাকিস্তানের মোট আয়তনের প্রায় ৪৮%। বালুচ জাতির লোকদের নামে এই অঞ্চলটির নামকরণ করা হয়েছে। এটি উত্তর-পূর্বে খাইবার পাখতুনখোয়া, পূর্বে পাঞ্জাব এবং দক্ষিণ-পূর্বে সিন্ধু পাকিস্তানের প্রদেশগুলির দ্বারা সীমাবদ্ধ। পশ্চিমে ইরান এবং উত্তরে আফগানিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমানা ভাগ করে এবং দক্ষিণে আরব সাগর দ্বারা আবদ্ধ। এখানের মানুষদের ভাষা প্রধানত বেলুচি, পুশতু এবং সিন্ধি। বালুচিস্তানের জনঘনত্ব খুব কম তবে মোট জনসংখ্যা প্রায় এক কোটি।
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সংস্কৃতির ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ ভ্রমণ, বাণিজ্য ও যুদ্ধবিজয়ের সূত্রে বালুচিস্তানে এসেছেন। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরোদোতুস এবং গ্রিক ভূগোলবিদ স্ত্রাবো তাঁদের রচনায় বালুচিস্তানের উল্লেখ করেছেন। তাঁরা এই অঞ্চলটিকে গেদ্রোসিয়া হিসেবে জানতেন। ম্যাসিডোনিয়ার প্রবল পরাক্রমশালী সম্রাট আলেকজান্ডার ৩৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বালুচিস্তান ও সংলগ্ন এলাকা বিজয় করেন। তবে এই বিজয়, বলা বাহুল্য, খুব সহজে হয়নি।
পরবর্তী শতকগুলিতে অঞ্চলটি পারস্য কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন শাসকের অধীন ছিল। সপ্তম শতকে আরবেরা বালুচিস্তান দখল করে। এরপর যথাক্রমে গাজনাভিদ, গোরি এবং মঙ্গোলেরা অঞ্চলটি শাসন করে। ১৬৬৬ সাল থেকে বেশ কিছুদিন বালুচিস্তান কালাত খানাতরা বংশপরম্পরায় এই দেশটি শাসন করেছে। এই বংশের শ্রেষ্ঠ শাসক ছিলেন
নাসির খান। তাঁর সময়ে বালুচিস্তানের শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নতি হয়েছে তা নয়, বালুচ সাম্রাজ্যের সীমানাও বেড়েছে। পরবর্তীকালে কিছুদিন এলাকাটি মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। পরে আবার এটি পারস্যের অধীনে আসে।
উনিশশো শতকের শুরুর দিকে বালুচিস্তান ব্রিটিশশাসিত ভারতের রাজনৈতিক প্রভাবের অধীন হয়। সেই সময় আঞ্চলিক শাসকেরা অঞ্চলটি শাসন করতেন। ১৮৭৭ সালে পাঁচটি জেলা নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের বেলুচিস্তান প্রদেশ গঠন করা হয়। তবে এই অঞ্চল দখল খুব সহজে হয়নি।
মূলত সুন্নি মুসলমান হলেও মহম্মদজাই, ভিটান্নিস, শিনোয়ারি, আফ্রিদি, মোহমন্দ, ওয়াজিরি, মাসুদ প্রভৃতি উপজাতিতে তাঁরা বিভক্ত, তবে তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় সামাজিক প্রথা ‘পাখতুনওয়ালি’। উপজাতিগুলির প্রধান গুণ স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা!
সীমান্ত প্রদেশগুলির মানুষের জননায়ক ছিলেন সীমান্ত গান্ধী খান আব্দুল গফফর খান। ভারতবর্ষের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব থাকলেও বালুচরা নিজেদের ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির বাহক ভাবতেই অধিক পছন্দ করতেন। ১৯২৮ সালের মে মাসে গফফর খান পাখতু ভাষায় ‘পাখতুন’ পত্রিকা প্রথম প্রকাশ করেন। সেখানে স্বাধীনচেতা মানসিকতার পাশাপাশি ধর্মীয় চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে জাতিসত্তা বিকাশের চর্চা হত।
সেই সময় খিলাফত আন্দোলন চলছে। কিন্তু একটা সময়ের পরে খিলাফত সম্মেলন থেকে সমর্থন তুলে নিলেন তাঁরা।
পরের বছরই সীমান্ত গান্ধী গড়ে তোলেন পাখতুনদের শক্তিশালী গণ সংগঠন ‘খুদা-ই-খিদমতগার’। যার মূলমন্ত্র ছিল: অহিংসাকে প্রতিষ্ঠিত করতেও অস্ত্রের প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে সমগ্র উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল জুড়ে স্বাধীনচেতা উপজাতির মানুষ এই মন্ত্রেই বিশ্বাস রাখেন। রুশ, তালিবান থেকে ব্রিটিশ, যারাই আসুক না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে সীমিত শক্তি নিয়ে কখনই তাঁরা স্বাধীনতার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করেননি। গফফর খানের ‘খুদা-ই-খিদমতগার’ সংস্থার অধীনে লালকোর্তা বাহিনী অখণ্ড ভারতেরই অংশ হিসেবে নিজেদের মনে করতেন। জাতীয় কংগ্রেস সম্মেলনে বারংবার সেই চিন্তা ব্যক্ত করেছেন তারা।
কলকাতার এলগিন রোডের বাসভবন থেকে মহানিষ্ক্রমণ করার পর গোমো থেকে পেশোয়ারে এসেছিলেন নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি মহম্মদ জিয়াউদ্দিন ছদ্মনামে সহচর আবিদ খানকে সঙ্গে নিয়ে এইসব অঞ্চলেও গুপ্তচরদের চোখে ধুলো দিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়েছিলেন। তিনি এই অঞ্চলে খুব জনপ্রিয়ও ছিলেন। শোনা যায়, শিক্ষিত বালুচ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কাছে আজও তিনি জনপ্রিয়।
১৯৪৭ সালে যখন ভারতে ক্ষমতা হস্তান্তরের সময় এল, সেসময়, ১৭ মে মাউন্টব্যাটেন সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। গান্ধীজিকে সেসময় তাঁরই মন্ত্রে দীক্ষিত সীমান্ত গান্ধী গফফর খান বলেন, ‘মহাত্মাজি, আপনারা এখন থেকে আমাদের পাকিস্তানি বলবেন? কংগ্রেসকেই তো আমরা আমাদের মঞ্চ মেনেছি, ভারতবর্ষ তো আমাদের দেশ। আজ আমরা পাকিস্তানি?
ভৌগোলিকভাবে দুটি ভূখণ্ড আলাদা হওয়ায় জওহরলাল নেহরু বালুচিস্তানকে ভারতের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি। জিন্নাও এব্যাপারে প্রথমদিকে উৎসাহ দেখাননি। ফলে একটা অংশ ব্রিটিশদের কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার পর প্রায় ২২৫ দিন স্বশাসিত ছিল। কিন্তু ১৯৪৮ সালে ২০ মার্চ পাকিস্তান অবশিষ্ট বালুচিস্তান দখল করে বসল। তৎকালীন সময়ে বালুচ নেতৃত্বের কাছে জিন্না প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বালুচদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাঁরা কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবেন না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। কিছুদিনের ভেতরেই বেরিয়ে আসে পাকিস্তানের দাঁত ও নখ।
বালুচিস্তান খনিজ সম্পদ ও প্রাকৃতিক গ্যাসে সমৃদ্ধ একটি প্রদেশ। পাকিস্তান সরকারের আয়ের একটা বড় উৎস ছিল বালুচিস্তান। কিন্তু বাজেটে সবচাইতে কম অর্থ বরাদ্দ হয় এই প্রদেশটির জন্য। আর এই প্রদেশটা যেহেতু পার্বত্যময়, সেহেতু চাষবাসও হয় কম। ফলে বালুচদের কাছে দারিদ্র্য ছিল নিত্যসঙ্গী। বালুচরা যেহেতু উগ্র ইসলামিক ও পাকিস্তানপন্থী নন সেহেতু তাঁদের প্রতি নেমে আসে অবর্ণনীয় অত্যাচার, খুন, অপহরণ। হাজার হাজার বালুচ মহিলাকে ধর্ষণ। বালুচদের মতামতকে কোনোরকম তোয়াক্কা না করে চীন-পাকিস্তান করিডর নির্মাণ করা হচ্ছে বালুচিস্তানের উপর দিয়ে। বালুচিস্তান মনে করে এটা বালুচিস্তানের সার্বভৌমত্বের উপর একটা আঘাত। এছাড়া গোটা বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের একমাত্র পরিচয়, এটি একটি জঙ্গি রাষ্ট্র। একজন বালুচ নিজে এসব কাজে যুক্ত নন, এমনকী পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিও তাঁদের কোনো অনুরাগ নেই। অথচ পাকিস্তানের প্রতি সমগ্র বিশ্বের যে ঘৃণা তা একজন বালুচকেও সহ্য করতে হয়।
খুব স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্তানের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কিছুদিন পর থেকেই বালুচদের মধ্যে শুরু হয় বিদ্রোহ। বিদ্রোহ দমন করতে পাকিস্তান শুরু করে দমনমূলক আচরণ। তবে বিগত দুই দশক ধরে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সমগ্র বালুচিস্তানজুড়ে সর্বাত্মক ও চরম আকার নেয়। তাঁদের আক্রমণের শিকার হয় মূলত পাকিস্তানের সেনা ও পুলিশ।
এই মুহূর্তে যা অবস্থা, তাতে বালুচিস্তানের ৭০% অংশ পাকিস্তানের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণমুক্ত। সর্বত্র উড়ছে স্বাধীন বালুচিস্তানের পতাকা। বালুচরা গাইছে তাঁদের জাতীয় সংগীত: ‘মা চোখি বালুজানি’। গানের ভিতর দিয়ে তাঁরা ঘোষণা করছেন: ‘নিপীড়নের দিন চিরতরে গিয়েছে চলে!/ আমরা অসহায়— দরিদ্রের রক্ষক, সন্ত্রাসের দুর্গ ধ্বংসকারী/আমরা বালোচের সন্তান!/ আমরা বালোচের সন্তান!’
বালুচদের সঙ্গে আমাদের সাংস্কৃতিক সম্পর্ক কয়েকদিনের নয়, কয়েক সহস্র বছরের। তাঁরা কখনই আমাদের শত্রু তো ভাবেইনি বরং উপযাচক হয়ে বলে এসেছেন তাঁরা ভারতবর্ষের বহুত্বকে বহন করে চলেছেন। এহেন একটি ভূখণ্ডের পাশে রাষ্ট্র হিসেবে ভারত এই মুহূর্তে কী করবে? উদাসীন থাকবে?
মনে রাখতে হবে, পাকিস্তান আমাদের এমনই একটি প্রতিবেশী দেশ যার একটিই কাজ, জঙ্গি সরবরাহ করা। আর এইসব জঙ্গিদের নিশ্চয়ই বন্যাদুর্গতদের ত্রাণ সরবরাহ করার কাজে ব্যবহার করা হয় না, নিশ্চিতভাবেই এদেরকে দিয়ে ভারতকে ক্ষতবিক্ষত করার কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এইরকম মারাত্মক বিপজ্জনক একটি রাষ্ট্রকে জব্দ করার একটাই উপায়, একে দুর্বল করে দেওয়া। আর একটা সুযোগ যখন এসেছে তখন আমেরিকা নাক গলানোর আগেই আমাদের উচিত ব্যবস্থা নেওয়া। কীভাবে?
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু দেশের বাইরে থেকে সিঙ্গাপুরে বসে একটা ভারত সরকার গঠন করেছিলেন, আজাদ হিন্দ সরকার, সেই সরকারকেও কিন্তু তৎকালীন সময়ে স্বীকৃতি দিয়েছিল বিশ্বের ন’টি দেশ। আমাদের কাছেও সম্ভবত বহু বছর পরে একটা সুবর্ণ সুযোগ এসেছে, খুব দ্রুত বালুচিস্তানকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এর ফলে বালুচদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন যেমন বাস্তবায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে আমরা একটা ভূমিকা রাখতে পারব, তেমনি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিও অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়বে।