বিমলকুমার শীট
ভারতের রাজনীতির পরিসরে বহুচর্চিত নাম রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটি শতবর্ষে পা দিয়েছে। ১৯২৫ সালে সংঘের প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ২৩ বছর স্বাধীনতা সংগ্রামের আবর্তে তার বেড়ে ওঠা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও আর এস এস কে নিয়ে চর্চার শেষ নেই। জাতীয় রাজ্য রাজনীতিতে জাতীয় কংগ্রেস আর এস এস এর প্রবল সমালোচক। কিন্তু কোন কোন সময় তাঁকে আর এস এস কে প্রশ্রয় দিতে দেখা গেছে।
১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ প্রতিষ্ঠা হলেও এর অনেক আগে থেকে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটেছিল। পাঞ্জাবে দয়ানন্দ সরস্বতীর আর্য সমাজ (১৮৭৫) হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানে সাহায্য করেছিল। ১৯০৬ সালে মুসলিম লিগ গঠনের অব্যবহিত পরে ১৯০৭ সালে লালা লাজপত রায় পাঞ্জাবে হিন্দু সভা গঠনে উল্লেখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেন। পাঞ্জাবে হিন্দু সভা গঠনে উল্লেখ্য ছিল শুদ্ধি সভা, আর্য সমাজ, সনাতন ধর্মসভা ইত্যাদি হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদী সংগঠনগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে হিন্দু স্বার্থ সুরক্ষিত করা। লাজপত রায় বিশ্বাস করতেন, হিন্দুরা নিজেরাই একটি ‘জাতি’, কারণ তারা নিজস্ব বিশেষ ধরনের একটি সভ্যতার প্রতিনিধিত্ব করে। পাঞ্জাবে হিন্দু সভার আদলে বিহার ও যুক্তপ্রদেশে হিন্দু সভা গঠিত হয়। ১৯১৫ সালে মদনমোহন মালব্য কুম্ভ মেলায় হিন্দু মহাসভা তৈরি করেন। এটি ছিল একটি সর্বভারতীয় সংগঠন এবং এর উদ্দেশ্য ছিল হিন্দুদের সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করা।
বিনায়ক দামোদর সাভারকর (১৮৮৩-১৯৬৬) ছিলেন ‘হিন্দুত্ব’ শব্দের প্রবক্তা। তিনি বলেছিলেন, হিন্দুস্থানের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুরা হিন্দু ধর্মের প্রচারের মাধ্যমেই একটি জাতীয় গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারে এবং এই প্রতিক্রিয়াই জাতীয়তবাদের জন্ম দেবে। হিন্দু পুনরুজ্জীবনবাদের সূচনা ১৯২২-১৯২৩ সাল নাগাদ। আর্যসমাজীরা ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’ প্রক্রিয়া দুটির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। মুসলমানদের ‘তবলিগ’ ও ‘তঞ্জিব’ ছিল আর্যসমাজীদের ‘শুদ্ধি’ ও ‘সংগঠন’এর প্রতিক্রিয়া। কেরালার মালাবার অঞ্চলে মোপালা কৃষক বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে আর্যসমাজীরা উপরোক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেন। তবে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার বিকাশে এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আর এস এস) প্রতিষ্ঠা। প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার সচেতন ভাবেই বিজয়া দশমীর দিনটিকে আর এস এস এর উদ্বোধনী দিন হিসাবে বেছে ছিলেন, কারণ এই দিনেই শুভ বনাম অশুভর মহাকাব্যিক সংগ্রামে রাম রাবনকে পরাস্ত করে ছিলেন। ১৯২৬ সালের রাম নবমীর দিনে এই সংগঠনটি নামকরণ হয়েছিল, কেননা ঐ দিনটি সাধারণ ভাবে রামের জন্মদিন হিসাবে ধরা হয়। একই দিনে তারা ‘ভাগওয়া ঝাণ্ডা’ বা গেরুয়া পতাকাকে গ্রহণ করে।
হেডগেওয়ার (১৮৮৯-১৯৪০) ও তাঁর সহযোগীরা বুঝিয়া ছিলেন যে, ‘বিদেশি’ মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের হাজার বছর ব্যাপী নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রামেই ভারত ইতিহাসের মূল নির্নায়ক। স্বৈরতন্তী মুসলমান শাসক বিরোধী ‘হিন্দু দেশপ্রেমকে’ কেন্দ্র করেই গড়ে উঠে ছিল। সমকালীন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নিয়ে স্বয়ং সেবকদের বিশেষ মাথাব্যথা ছিল না। স্বাধীনতা সংগ্রামে আর এস এস কর্মীদের অংশগ্রহণ প্রায় ছিল না বললেই চলে। ১৯২৮ সালে শ্রমিক, ছাত্র ও যুবকেরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে সাইমন কমিশন বিরোধী যে আন্দোলন সংগঠিত করে ছিলেন, তাতে আর এস এস কর্মীদের তরফ থেকে কোন সাড়া মেলেনি। ১৯৩০ সালে মার্চ মাসে গান্ধীজি তাঁর ঐতিহাসিক ডাণ্ডি যাত্রার মধ্য দিয়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। আর এস এস যথারীতি ভারতীয় রাজনীতির এই সব গুরুত্বপূর্ণ বিকাশ গুলির প্রতি চূড়ান্ত উদাসীনতা দেখিয়ে ছিল। ১৯৩০ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের সর্বত্র স্বাধীনতা দিবস পালন করার প্রস্তাব নিয়েছিল ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। এই প্রস্তাব সম্পর্কে আর এস এস প্রধান হেডগেওয়ার একটি সার্কুলার জারি করেন। ঐ সার্কুলারে স্পষ্ট ঘোষণা করে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসও আমাদের স্বাধীনতার লক্ষ্য গ্রহণ করেছে”। ঐ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় আর এস এস শাখাগুলিও ঐদিন স্বাধীনতা দিবস পালন করবে “জাতীয় পতাকা অর্থাৎ গেরুয়া ঝাণ্ডা পুজোর মাধ্যমে”। স্বয়ং সেবকেরা জাতীয় তেরঙা পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনের কথা ভাবেনি।
এক সময় স্বরাজ্য দল বিরোধী গোষ্ঠী ও হিন্দু মহাসভা একই সংগঠনে পরিণত হয়েছিল এবং এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন মদনমোহন মালব্য। তারই প্ররোচনায় চিত্তরঞ্জন দাশের Bengal Pact বা বাংলা চুক্তি বাতিল করা হয়। ১৯৪০ সালে আর এস এস সরসংঘচালক হিসাবে হেডওয়ারের স্থলভিষিক্ত হন এম এস গোলওয়ালকর। তাঁর নেতৃত্বাধীন আর এস এস ১৯৪০এর দশকে যাবতীয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম থেকে নিজেদের সচেতন ভাবেই সরিয়ে রেখেছিল। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন। আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সদস্যদের বিচার বিরোধী বিক্ষোভ (১৯৪৫-৪৬), বোম্বের নৌবিদ্রোহ ইত্যাদিতে আর এস এস এর অংশ গ্রহণ ছিল না। কিন্তু ১৯৪০ এর দশকে এই সংগঠনের শক্তি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ এর মধ্যে আর এস এস এর শাখার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। প্রায় প্রতিটি প্রদেশে শাখা সংগঠনগুলি ছড়িয়ে পড়েছিল। আর এস এস সর্বদাই ব্রিটিশ দ্বারা লাভবান হয়েছিল। মুসলিম লিগের কার্যাবলি আর এস এস এর কাজ অনেকটা সহজ করে দিয়েছিল। মুসলিম লিগের তিক্ত সাম্প্রদায়িক প্রচার ও পাকিস্তান দাবি এক বিরাট সংখ্যক হিন্দুকে সন্ত্রস্ত করেছিল।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও দেশভাগের বিনিময়ে ভারত স্বাধীন হয়। স্বাধীন ভারতও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পায়নি। কংগ্রেস নেতা বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৬-৪৭ সাল নাগাদ কিছুটা হলেও রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক সংঘের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েছিলেন। তিনি অভিযোগ করেন যে ভারতীয় মুসলমানরা সব সময় জাতীয়তাবাদী অবস্থান গ্রহণ করার বিষয়ে দ্বিধাগ্রস্ত। চলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে ছিল। ১৯৪৮ সালে লখনৌতে এক ভাষণে প্যাটেল স্বয়ং সেবকদের সতর্ক করেছিলেন এবং একই সঙ্গে ভাষণে তিনি বলেন, রাষ্ট্র কখনোই তাঁর কর্তৃত্ব আর এস এস এর ওপর চাপিয়ে দেবে না। গুজরাটে সোমনাথ মন্দিরের ভগ্নদশা দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন সরকারি অর্থে সোমনাথ মন্দির পুননির্মিত হবে। গান্ধী ও নেহরু এই সিদ্ধান্তে একমত হন নি।
তবে দেশ স্বাধীনতা লাভের পর কংগ্রেসের মধ্যে বহু নেতা, মন্ত্রী আর এস এস ও হিন্দু মহাসভার ‘উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী’ রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু কিন্তু আর এস এস কে প্রশ্রয় দিতে রাজি ছিলেন না। ১৯৪৮ সালের ৫ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রীদের কাছে লেখা চিঠিতে তিনি মন্তব্য করেন, সাম্প্রতিক কিছু ভয়াবহ ঘটনাবলিতে আর এস এস এর যুক্ত থাকার প্রমাণ সংগ্রহ করা হচ্ছে। আমরা যেন তাদের পবিত্র বাক্য বিভ্রান্ত না হই, কারণ তাদের কথা ও নীতির মধ্যে বিস্তর ফারাক।
গান্ধী হত্যার (১৯৪৮) কলঙ্ক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে প্রবল অস্বস্তিতে ফেলেছিল। তদানীন্তন আর এস এস প্রধান গোলওয়ালকর এই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন এবং ‘মহাত্মাজীর প্রতি সম্মান’ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে শাখার কাজকর্ম তেরো দিনের জন্য বন্ধ রাখেন। কিন্তু এতে গণবিক্ষোভ এড়ান গেল না। মহারাষ্ট্রে জনক্রোধ ব্রাহ্মণ্য তন্ত্র বিরোধী জঙ্গি আন্দোলনে রূপান্তরিত হল। ১৯৪৮ সালে ৪ ফেব্রয়ারি ভারত সরকার আর এস এসকে নিষিদ্ধ সংগঠন ঘোষণা করে। স্বয়ংসেবকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম চালানোর পরিবর্তে কংগ্রেস সরকার নিষিদ্ধ করণের রাজনীতির আশ্রয় নিল। ইতিমধ্যে তেলেঙ্গনার জঙ্গি কৃষক বিদ্রোহ ও জেল ফ্রন্ট খোলার মাধ্যমে বি টি রণদিভের নেতৃত্বে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির শহুরে অভ্যুত্থানের ডাক কেন্দ্রে কংগ্রেস সরকারকে বিপাকে ফেলে ছিল। এই পরিস্থিতিতে আর এস এস ও কংগ্রেস একটা পারস্পরিক সমঝোতায় বসে। উভয়ের কাছেই বিপদের প্রধান উৎস ছিল কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও কার্যকলাপ। ফলস্বরূপ ১৯৪৯ সালের ১২ জুলাই আর এস এস এর উপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হয়। ১৯৫০ এর দশকে আর এস এস কর্মসূচি মূলত সাংস্কৃতিক কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে গৃহীত হয়েছিল। তবে নির্বাচনে তাঁরা ভারতীয় জনসংঘকে পূর্ণ সহযোগিতা করে। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচার চালায় আর এস এস এবং ১৯৬৬-৬৭ সালে গো হত্যার বিরুদ্ধে প্রচার চালায়। ১৯৭৩ সালের গোলওয়ালকারের স্থলভিষিক্ত হয়ে আর এস এস প্রধান হন বালাসাহেব দেওরস। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে ইন্দিরা গান্ধী আর এস এস কে নিষিদ্ধ করেন এবং বালসাহেব দেওরস গ্রেপ্তার করা হয়। দেওরস জেল থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে কয়েকটি চিঠি লেখেন। আবেদন করেন এর এস এস ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার এবং বিনিময়ে ইন্দিরা সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জরুরি অবস্থার শেষ লগ্নে ইন্দিরা গান্ধী ও আর এস এস এর সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপন করতে চেয়ে ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। ১৯৮০এর দশক এই সমঝোতা স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ে।
১৯৮০র দশকের গোড়ার দিকে ইন্দিরা গান্ধী ও আর এস এস-এর মধ্যে গোপন বোঝাপড়া শুরু হয়। ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় ঐক্য ও অখণ্ডতার পক্ষে মারাত্মক প্রচার চালাতে থাকেন। ইন্দিরা কংগ্রেসের পক্ষ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছে সরাসরি আবেদন করা হয় যে, তাঁরা যেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (মুসলমান ও শিখ) থেকে উঠে আসা বিপদ থেকে ‘জাতিকে’ রক্ষা করার দায়িত্ব নেয়, কংগ্রেসের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি সম্ভব হিন্দু ভোট সংগ্রহ করা। আর এস এসও তাঁর যাবতীয় শক্তি একটা সংগঠনের পেছনে ক্ষয় করতে দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, এর ফলে স্বয়ং সেবকদের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্ক গড়ে উঠতে থাকে।