শ্রী সুকুমার সেন
পূর্ব প্রকাশিতর পর
‘থালা’ ‘ঘড়া’ ‘ঘটি’—কাঁসা ও পিতল দুয়েরই হয়। ‘থালা’ থালি এসেছে সংস্কৃত স্থালী, স্থালিক থেকে। গোড়ায় মানে ছিল মাটির পাত্র (তুলনীয় স্থল)। ‘ঘড়া’ এসেছে সংস্কৃত ‘ঘট+ক’ থেকে। ঘটি মানে ছোট ঘট) তৎসম ‘ঘট’ থেকে। এই অর্থে প্রাচীন বাংলায় ‘ঘডুলী’ শব্দ পাওয়া গেছে। সংস্কৃত ‘ঘটী’ থেকে এসেছে অঞ্চল বিশেষে প্রচলিত ঘটি অর্থে এবং সর্বত্র প্রচলিত সময়জ্ঞাপক যন্ত্র অর্থে। ক্ষীর্ণ ডমরু-মধ্য ঘটিকাপাত্রে বালি অথবা জল রেখে সেকালে সময় নির্ণয় করা হত। এরকম ঘটিকা তামারও হত। তাই ঘড়ির নামান্তর ছিল ‘তামি’ (তাম্রিকা থেকে) আধুনিক দম দেওয়া ঘড়ি অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে এদেশে অজ্ঞাত ছিল। ছোট কাঁসার থালা বা প্লেট হল কাঁসি। শব্দটি এসেছে ‘কাংস্য’ (মানে কাঁসা) থেকে। কাঁসি বাদ্যযন্ত্রও বটে, ঢোলের সঙ্গে বাজানো হয়। পূজায় আরতিতে বাজানো হয় ‘কাঁসর’, দোমড়া মুখ-উঁচু কানাওয়ালা কাঁসি। এও কাঁসার তৈরি। ঘণ্টা (সংস্কৃত শব্দ)-ও তাই। কাঁসরের সঙ্গে বাজানো হয়। ঘন্টা দুরকম—হাতুড়ি পেটা, কাঁসর বড়ো মোটা চাকতি, আর হাতে নাড়া। এ ঘণ্টা যে উল্টানো বাটি। ভিতরে একটি ঝোলানো ধাতুখন্ড আছে। হ্যা্ডেল ধরে নাড়লে বাজে। পেটা ঘন্টাকে ঘড়িও বলে। এ শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘ঘন্টিকা’ থেকে।
আমের পাক করা মিষ্ট মুখচার হল কাঁচা আম ও গুড়। কিঞ্চিৎ লংকা। এ মুখচারের নাম হল আমগুড় বা গুড়াম।
অনিষ্ট আর একটি মুখচার হল আমতেল। কাঁচা আম কেটে সর্ষের তেলে ভিজিয়ে রাখা। এই তেলে ভেজা আম অম্লব্যঞ্জনের কাজে লাগে আর এই তেলমাখা মুড়ি খেতে ভালো লাগে।
আমাদের দেশে আমের যে মুখচার আগে থেকে চলিত ছিল তার নাম আমচুর (অর্থাৎ আম্রচুট, আমচুড়)। কাঁচা আম সরু ফালি ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে রাখা। এই আংশুঁট দীর্ঘস্থায়ী ব্যঞ্জনের সামগ্রী ছিল।
আমের যে মুখচারটি এখন সর্বত্র সমাদৃত তা হল আমসত্ব। মিষ্টি আমের রস রোদে শুকিয়ে মোটা রুটির মতো করে রাখা। এর পুরোনো নাম হল আমোট। এ নাম আমি ছেলেবেলায় শুনেছি। শব্দটি এসেছে সংস্কৃত আনুমানিক ‘আম্র+পুষ্ট’ থেকে।
আম ছাড়া অন্য দু-একটি ফল নিয়েও মুখচার হয়। এ সব ফলের মধ্যে প্রধান হল তেঁতুল। এইবার বাসনকোসনের প্রসঙ্গ। শরা, খুরি, হোলা। শরা এসেছে সংস্কৃত ‘শরাব’ থেকে। হাঁড়ির মুখের তলার মতো, হাঁড়ির মুখে ঢাকনির মতো ব্যবহারের ও অন্যান্য কাজের জন্য। ‘খুরি’ খুব ছোট শরার মতো তবে তলা গোল নয় চেপটা।
(ক্রমশ)