• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

হাসিনার রায়ের আগে দেশে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা, আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

আতঙ্কে সাধারণ মানুষ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

সোমবার হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা। তার আগে, রবিবার ভোর থেকে অস্বাভাবিক নীরবতা ঘিরে রেখেছে গোটা বাংলাদেশকে। যে রাস্তাগুলি সাধারণত যানজট, হর্ন আর মানুষের কথাবার্তায় সরগরম থাকে, সেগুলিই এ দিন যেন এক অস্বাভাবিক নীরবতায় থমকে গিয়েছে। দোকানপাট দেরিতে খুলেছে, গণপরিবহণ চলেছে সতর্ক গতিতে, আর বহু মানুষই ঘর থেকে বেরোতে চাননি। দেশের উপর ঝুলে থাকা অনিশ্চয়তার মেঘ আরও ঘনীভূত হয়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে চলা মামলার রায় ঘোষণা করতে চলেছে। এর প্রতিবাদে এবং এই আদালতের কার্যক্রম বাতিলসহ বিভিন্ন দাবির কথা উল্লেখ করে রবিবার ও সোমবার ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে বাংলাদেশে দলীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ।

প্রসঙ্গত, গত বছরের জুলাই–আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের উপর যে সহিংসতার অভিযোগ তোলা হয়েছিল, সেই মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলাকে কেন্দ্র করেই দেশজুড়ে উত্তেজনা তুঙ্গে উঠেছে। সেদিন রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবিতে ছাত্রদের তীব্র আন্দোলনের জেরে দেশজুড়ে সংঘর্ষ ছড়িয়েছিল। যদিও হাসিনা বরাবরই সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবুও চূড়ান্ত রায় ঘোষণা নিয়ে দেশজুড়ে উদ্বেগ বেড়েছে।

Advertisement

রায় প্রকাশের আগে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নিরাপত্তা আঁটোসাঁটো করা হয়েছে। রাজধানীর রাস্তায় বেড়েছে পুলিশ টহল, একাধিক জায়গায় বসানো হয়েছে চেকপোস্ট। কঠোরভাবে নজরে রাখা হচ্ছে জনসমাগমের উপরে। তার মধ্যেই কয়েকটি এলাকায় অজ্ঞাত আতঙ্ক ছড়াতেই বাজি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গিয়েছে।

Advertisement

অন্তর্বর্তী সরকারের নিষেধাজ্ঞায় আওয়ামী লীগের সব কার্যকলাপ বন্ধ থাকায় দলের নেতারা এখন নিজেদের আত্মগোপন করে রেখে সামাজিক মাধ্যমে দেশবাসীকে বার্তা দিচ্ছেন। রায়ের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই অনলাইন প্রচার আরও বাড়েছে। দলটি দু’দিনের সর্বাত্মক বন্‌ধের ডাক দিয়েছে।

এদিকে দেশের অর্থনীতি যে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে, সেটাই ব্যবসায়ী মহলে আরও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-র সাবেক সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা কাজী মনিরুজ্জামান সরাসরি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি অত্যন্ত অস্বস্তিকর।’

তাঁর কথায়, ‘মানুষ ভয় পাচ্ছে। আমরা শুধু চাই শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, যেখানে নাগরিকরা নিরাপদে ভোট দিতে পারবেন। এখন দেশের ব্যবসা, সমাজ, আইনশৃঙ্খলা— সবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে।’

পোশাক শিল্পকে কেন্দ্র করে তাঁর উদ্বেগ আরও গভীর হয়েছে। এই শিল্পেই কোটি কোটি মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। তিনি সতর্ক করে বললেন, ‘অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে বিদেশি ক্রেতারা আস্থা হারাবেন। এই শিল্পই দেশের বেশিরভাগ বৈদেশিক মুদ্রা আনে। ক্ষতি হলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগবে।’

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তুলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তি চাই, রাজনৈতিক স্থিরতা চাই, আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে চাই। অঞ্চলটাকে শান্ত রাখতে হবে। আর বাংলাদেশকে নতুন আশার আলো দেখতে হবে।’

ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়েও স্পষ্ট কথা বলেন কাজী মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘১৯৭১-এ ভারত আমাদের সাহায্য করেছে। আমি নিজেও যোদ্ধা হিসেবে সেখানে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সম্পর্ক দৃঢ় রাখতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের পরিচয়ও সুরক্ষিত রাখতে হবে।’ রাষ্ট্রের ভেতর বিভাজনের বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট বার্তা, ‘আমি সংখ্যালঘু–সংখ্যাগুরুতে বিশ্বাস করি না। আমরা সবাই বাংলাদেশি— এটাই যথেষ্ট।’

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতার জেরে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতা হারায়। ওই বছর ৫ আগস্ট তিনি বাংলাদেশ ছাড়েন এবং নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, জুলাইয়ের সেই আন্দোলনে বাংলাদেশে প্রায় ১,৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, হাসিনা ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে একসময় যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিলেন, সেই ট্রাইব্যুনালই এবার তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। সেই রায় ঘোষণার আগে দেশজোড়া এই নীরবতার মধ্যেই যেন লুকিয়ে রয়েছে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা সহ একাধিক প্রশ্ন।

Advertisement