নভেম্বরের মাঝামাঝি পাহাড় থেকে ফিরেছিলাম। সুটকেস খালি করতে না করতেই খবর এল উত্তরবঙ্গে ঠান্ডা ঢুকে গেছে। পাহাড় থেকে সমতল, জঙ্গল, চা বাগান সবখানেই শীতকে পাওয়া যাচ্ছে।
নভেম্বর মাসে পাহাড় ভ্রমণের গরম জামাকাপড় বাক্স বন্দিই ছিল, শীতের আতঙ্কে বৃথাই গরম জামা সেবার ব্যাগ ভর্তি করে নিয়েছিলাম। কালিম্পঙ, দার্জিলিং গরমে শীতের পোশাক পরতে দেয়নি। তাই খুব অতৃপ্ত ভ্রমণ হয়েছিল।
ডিসেম্বর মাসের গোড়ায়, পাহাড়ে শীত এসে গেছে জানতে পেরেই মনটা তাই ছটফট করে উঠল। কোনও পূর্ব পরিকল্পনা না করেই বেরিয়ে পড়লাম। কলকাতা থেকে সোজা মালবাজার, সেখান থেকে গরুবাথান উঠে একটা ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামে ডেরা বাঁধলাম। তিন হাজার ফুট উঁচুতে কুমাই পাহাড়ের গোর্খা হোমস্টে আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা। বিজয় থাপা, সেনাবাহিনীর চাকরিতে অবসর পাওয়ার পর, তাঁর নিজের বাড়িতে ৫ ঘরের একটা হোমস্টে চালাচ্ছেন ।
ছবির মতো সুন্দর এই কুমাই। হোমস্টের ব্যালকনিতে বসে তিন হাজার ফুট নিচ দিয়ে বয়ে চলা জলঢাকা, মূর্তি আর তিস্তার রূপ আমায় মুগ্ধ করে। আর মুগ্ধ করে চাপড়ামারি জঙ্গলের রূপ। কুমাইয়ের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তও খুব সুন্দর। হিল্লি পয়েন্ট আর গুদারে গাঁও থেকে বেশি সুন্দর লাগে।
আমরা বিকেলের দিকে গেছিলাম একটু মালবাজারে, টাকা তুলতে। কারণ কুমাই কেন, পাহাড়ে এটিএম খুব কম চোখে পড়েছে। সন্ধ্যার দিকে যখন চাপড়ামারি জঙ্গলের গেট পেরিয়ে কুনিয়া মোড়ের দিকে যাচ্ছি, তখন পথে দেখা এক বিশাল বাইসনের সঙ্গে। আমি এত বড় বাইসন এর আগে দেখিনি!
বছর দশেক আগে ঠিক এমনই একটা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। ভুটান থেকে ফেরার পথে এক দিনের জন্য আমার এক বন্ধু রামাইয়ের বাড়িতে উঠেছিলাম ওঁদের অনুরোধে। সন্ধ্যায় গেছিলাম হলং বাংলোতে খাবার খেতে। যাবার পথে হলং বাংলোর ঠিক ৩০০ মিটার আগে, এক বিশালাকার হাতির সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হয়। সরু রাস্তার দু’দিকে কাঁটাতার আর তারপর জঙ্গল। আর সামনে গজরাজ। পিছনে আঁকাবাঁকা রাস্তা। পালানোর কোনও পথ নেই।
মারুতি ৮০০-র স্টিয়ারিং আমার হাতে। পাশে রামাই, পিছনে দুই বন্ধুর স্ত্রীয়েরা বসে। হাতি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, আমার জীবনে এমন অভিজ্ঞতা সেই প্রথম। কী করব! রামাই আমায় গাড়ির হেড লাইট জ্বালিয়ে, হ্যাজার্ড লাইট জ্বালিয়ে, হর্ন চেপে ধরে, এক্সিলেটার চেপে রেখে গাড়িতে আওয়াজ করতে বলল। তারপর ওই অবস্থায় ধীরে ধীরে হাতির দিক এগোতে ইশারা করল। আমিও দম দেওয়া পুতুলের মতো রামাইয়ের নির্দেশ মেনে চললাম।
এই ভাবে দশ মিনিট আমাদের পথ আটকানোর পর সেই গজরাজ জঙ্গলে ঢুকে গেল। রামাই বাদে বাকি সবাই আমরা তখন আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেছি। তাই জঙ্গলে হাতির পাল্লায় পড়া আর গরুমারা জঙ্গলে বাইসন দ্বারা ঘেরাও হয়ে থাকার আতঙ্ক এখনও অনুভব করি।
আমি পুরুলিয়াতে হাতি দেখেছি, শালবনিতে হাতি দেখেছি, নেতারহাটের পথেও হাতি দেখেছি। হাতিকে বলা হয় আর্কিটেক্ট অফ ফরেস্ট কারণ জঙ্গলের বৃদ্ধিতে হাতির ভূমিকা অপরিহার্য। আর তাই প্রতিবছর সারাদেশ জুড়ে গজ উৎসব পালিত হয়।
গজ উৎসব এই বছর পশ্চিমবঙ্গে হচ্ছে। জানুয়ারি ২০২৫-এ শুরু হয়েছে উত্তরবঙ্গের লাটাগুড়িতে, তারপর সারা রাজ্যে এটি বিভিন্ন জেলায় হবে। শেষ হবে ফেব্রুয়ারি ২০২৬-এ। এই গজ উৎসব প্রতি বছর দেশের কোনও না কোনও রাজ্যে হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ বিভাগ, পরিবেশ ও বন মন্ত্রক দ্বারা এই উৎসব প্রতিবছর উদযাপন করা হয়।
ভারত সরকারের এই প্রোজেক্টের নাম ‘প্রোজেক্ট এলিফ্যান্ট’। এটা ৩০ বছরের একটা প্রোজেক্ট। এর মাধ্যমে, শুধু হাতি সংরক্ষণ করার প্রচেষ্টা নয়, মানুষের সঙ্গে হাতির নিবিড় সংযোগ স্থাপন করা, সাধারণ মানুষের মধ্যে হাতির প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি, হাতির আমাদের প্রকৃতির উপর যে-সব প্রভাব আছে সেই বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, হাতির জন্য সংরক্ষিত স্থান ও তাদের চলাচলের নিরাপদ অঞ্চল তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া, এই উৎসবের মূল লক্ষ্য।
যাই হোক এযাত্রায় আমাদের কুমাইতেই নিরালা যাপনের পরিকল্পনা। তাই আস্তানায় ফেরার পথে বাইসন দর্শনের ঘটনাটা বেশ নাড়িয়ে দিয়ে গেল। আমাদের কপাল ভালো যে, গাড়ির হেড লাইট আর হর্নের দাপটে সে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে গেল। আমরা জঙ্গলে আসি পাখি আর জন্তু জানোয়ার দেখতে। কিন্তু জঙ্গলে হাতি, বাইসনদের দর্শন যেন না হয়, আমি সেটাই চাই।