নেই আর চাই- এর চাপে যখন জীবন হাঁসফাঁস করতে থাকে, তখন ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে এমন কোনও জায়গায় যেখানে গেলে মনে হয় ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা’। এই আপ্তবাক্য স্মরণ করে স্রষ্টার নিপুণ সৃষ্টির মাঝে বারবার নিজেকে হারিয়ে ফেলার জন্য চলে যেতে চাই এমন কোনও জায়গায়, যেখানে এই দুয়েরই ভারসাম্য বজায় থাকে।
শিয়ালদহ থেকে দার্জিলিং মেলে চেপে সকাল ন’টা নাগাদ নামলাম নিউ জলপাইগুড়ি। স্টেশন থেকে বেরিয়ে একটা গাড়ি নিয়ে চললাম পাহাড়ের উদ্দেশে। শিলিগুড়ি শহর পেরোতে না পেরোতেই চিরচেনা রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই সবুজ চা-বাগানের ‘স্বাগতম’ সম্ভাষণ। চা-বাগানে বিভিন্ন বয়সি নারী-পুরুষ তাদের নিত্যদিনের কাজে মগ্ন। ছবির মতো সাজানো গোছানো একের পর এক গ্রাম পেরিয়ে যাওয়ার সময়, প্রকৃতি যেন মনকে নিয়ে যায় দূরের কোনও এক কল্পলোকে।
ভোরের প্রথম আলোয় ডাকছে পাহাড়, এসো মোর কোলে। সবুজের বনজ গন্ধ মেখে, বড়দিঘি টি-এস্টেটের ছায়ায়, মায়ায়, টিয়াবনের পাখির ডাকে সাড়া দিয়ে অবশেষে চলে এল গরুবাথানের পথ। দু’দিকে বিস্তীর্ণ ঢেউখেলানো চা-বাগানের সবুজ আর মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে চলা মসৃণ পথ দেখে চিরদিনই মনে হয়, ‘এই পথ যদি না শেষ হয়…’।
এই পথ ধরে ফাগু টি-এস্টেট ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ির চাকাও গড়াতে শুরু করল। উত্তরের বন্ধু তিস্তা বিদায় জানিয়ে ততক্ষণে আমাদের সঙ্গী হয়েছে চেল নদী। অনেকটা পথ পেরিয়ে এবার ধীরে ধীরে গাড়ির গতি ঊর্ধ্বমুখী। চারিদিকে যতদূর চোখ যায় সবুজ চা-বাগান। শুরু হয়ে গেল পাহাড়। চেল নদীর ধারা জলতরঙ্গের মিঠে সুরে, কানে কানে বলতে থাকে, ‘এখানে একটু থামো, বিশ্রাম নাও আর আমাকে একটু ভালো করে দেখে যাও’। তার এই ক্রমাগত আবদারে অবশেষে ছোট্ট মতো একটি বাজার দেখে ক্ষণিক চা-পানের বিরতি নেওয়ার জন্য নামলাম। জায়গার নাম পাপরখেতি। প্রথম দেখাতেই ভালো লেগে গেল।
শিলিগুড়ি থেকে ৯০ কিলোমিটার আর নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাপরখেতি। আপার ফাগু টি-এস্টেট থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এই জায়গায় চেল নদীর উপর ব্রিজ রয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে উইকেন্ড টুর বা লং ড্রাইভের জন্য একদম আদর্শ এই পাপরখেতি এবং সংলগ্ন অঞ্চল। পাহাড়ি পথের ধারে ছোট-বড় পাথরের বুকের ওপর দিয়ে রিনিঝিনি সুরের ছন্দ তুলে বয়ে চলেছে চেল নদী।
পথের পাশে এক অতিকায় পাথরের উপর ছোট্ট একচিলতে মন্দির, মহাদেব আর পবননন্দন হনুমানজির। চারিদিকে রঙ-বেরঙের পতাকার ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘন অরণ্যর সবুজ কনট্রাস্ট যেন কোনও এক শিল্পীর তুলিতে আঁকা অদ্ভুত কোলাজ। পাথরের পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে পাথুরে পথ। এই পথ একেবারে গিয়ে শেষ হয়েছে চেল নদীর বুকে। এতটাই সুন্দর যে, ৮ থেকে ৮০ সকলেই বয়স ভুলে সেই পথ ধরে চলে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠবেন, উচ্ছ্বল নদীর সঙ্গে নিবিড় সখ্যতা গড়ে তোলার জন্য। কিন্তু তার আগে রাতের ট্রেন জার্নি আর বেশ কয়েক ঘন্টার পথশ্রমে ক্লান্ত আমরা, রাস্তার ধারে গড়ে ওঠা ছোট্ট নেপালি খাবারের দোকানে গরম গরম মোমো, ম্যাগি, চা-কফি সহযোগে উদরপূর্তি উৎসব উদযাপন করার প্রয়োজন অনুভব করলাম।
যে-দোকানে বসেছিলাম সেখান থেকেই নিচে দিয়ে বয়ে যাওয়া চেল নদীর অপরূপ শোভা আর কান-জুড়ানো কলতান- দুই-ই উপভোগ করতে লাগলাম। নেপালি দোকানের মালকিনের নিজের হাতে পরিবেশিত ডোলো লঙ্কার ঝালঝাল চাটনির সঙ্গে, গরম গরম ধোঁয়া ওঠা মোমো, সঙ্গে হিমেল বাতাস আর সামনে একখণ্ড পাহাড়। পাহাড়ে বেড়াতে এসে এর থেকে সেরা কম্বিনেশন বোধহয় আর হয় না! টেবিলে পড়তে না পড়তেই ক্ষুধার্ত উদরে একের পর এক চালান হতে থাকল সেই লোভনীয় খাদ্যবস্তুগুলো।
বড় পাথরটার পাশ দিয়েই নেমে গিয়েছে এবড়োখেবড়ো পথ। আসলে পথ না বলে কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা নুড়ি পাথরের সমষ্টি বললেও চলে। অসাবধানতাবশত পা ফেললেই দুর্ঘটনা একদম নিশ্চিত। খুব সন্তর্পণে এ পাথর ও পাথর ডিঙিয়ে পৌঁছে গেলাম একদম নদীর কিনারায়। এখানে সে স্রোতস্বিনী। উচ্ছল কিশোরীর মতোই প্রাণবন্ত হয়ে, প্রিয় মিলনের অভিসারে ছুটে চলেছে। সবুজ পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসছে ছোট্ট ছোট্ট জলধারা। বর্ষার বারিধারায় পুষ্ট, আবেগে উচ্ছল। ছোট-বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে তারাও চঞ্চল হয়ে উঠে নদীর স্রোতে মিলিত হয়ে ভেসে যাচ্ছে। সেই জলধারার শরীরে সূর্যের আলো পড়ে সৃষ্টি করেছে রামধনু।
নদীর জল দেখলেই উদ্বেল হয়ে ওঠে আমার মনের কোণে চুপটি করে লুকিয়ে থাকা একটি শিশু। একটা পাথরের ওপর বসে শীতল জলে পা ডুবিয়ে গল্প করতে লাগলাম তার সঙ্গে। একসঙ্গে বেড়াতে আসা সঙ্গীদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ চলল ফটোসেশন। এমন পরিবেশে যতবার গিয়েছি দেখেছি এখানে এসে নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়া যায়। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে নিক্তি দিয়ে মাপা রোজকার সময় আর দিনগত পাপক্ষয়ের ডেবিট-ক্রেডিটের ব্যালান্স। জীবনটাকে আবার নতুন করে রিওয়াইন্ড করে নিতে ইচ্ছে হয়। সেই জন্যই তো প্রতিবার এখানে আসা। মনখারাপের বাটখারাগুলো সযত্নে রেখে তার কাছে থেকে বিশুদ্ধ অক্সিজেন নিয়ে নতুন করে আবার ফিরে যাওয়া। কারণ প্রকৃতি শুধু দিতেই জানে আর আমরা নাগরিক সভ্যতার মানুষগুলো শুধু নিতেই জানি। কিছু দেওয়ার বদলে ‘সভ্য জাতি’-র নিদর্শন হিসেবে তার বুকে রেখে যাই গাদা গাদা প্লাস্টিকের প্যাকেট আর আমোদ প্রমোদ উদযাপিত হওয়ার পর কিছু খালি বোতল, ক্যান।
কয়েকটি পরিবারকে দেখলাম রীতিমতো খাবার-দাবার তৈরির আসর জমিয়ে ফেলেছে। আসলে এখানকার প্রকৃতিই এমন যে, বারোমাসই চড়ুইভাতির সিজন। তাই সমতলের মানুষদের মতো এখানে শীতের আগমন বার্তার অপেক্ষায় কেউ থাকে না। শুধু মনের ইচ্ছেটাই বড় কথা। কয়েক ঘণ্টা সময় কাটানো বা পিকনিকের জন্য আদর্শ। তবে আনন্দ-উৎসবের পর পরিবেশের কথা মাথায় রাখলে ভালো হয়।
নদীর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে উঠে এলাম উপরে। এখান থেকে মাত্র ৩০ কিমি দূরেই অবস্থিত লাভা। এই পথ ধরেই সেখানে যেতে হয়। এবার সিঁড়ি বেয়ে বড় পাথরের ওপরে উঠতে ইচ্ছে হল সকলের। ওপরের পাথরের চাতালে এসে দাঁড়াতেই সবাই বাকরুদ্ধ! একি দৃশ্য সামনে! দিগন্ত জুড়ে শুধু একের পর এক সবুজ পাহাড় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যেন আমাদের গার্ড অফ অনার দিচ্ছে! তাদের সবুজ শরীর চিরে চলে গেছে আঁকাবাঁকা পথ আর সেই পথের ধারে উঁকি দিচ্ছে পাইন, ধুপি আর জুনিপারের সারি। হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসতেই দেখলাম মেঘপিয়ন যেন তার ব্যাগের ভেতর থেকে দিস্তা দিস্তা মেঘ ছড়িয়ে দিচ্ছে আর তা দেখে মনখারাপ করে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলো।
জানি না কতক্ষণ সেই অলৌকিক দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ যেন অন্য কোনও মায়ার পৃথিবী। আবার একটু বাদেই দেখলাম বাউন্ডুলে মেঘের দল সরে যেতেই সবুজের গায়ে ঝলমলে রোদের আলোর প্রতিফলন। আসলে পাহাড়ের প্রতিটি কোণায় কোণায় প্রকৃতির ম্যাজিক চলে।
ওদিকে গাড়ির ড্রাইভার দাদা ক্রমাগত হর্ন দিয়ে জানান দিচ্ছেন, এখানে আমাদের বিরতি যাপনের সময় শেষ। মুঠোফোনে যতটুকু সম্ভব কিছু দৃশ্য বন্দি করে উঠে পড়লাম গাড়িতে। তবে ওই যন্ত্রের ক্ষমতা আর কতটুকু! দু’চোখের লেন্সের মাধ্যমে মনের গ্যালারিতে যা ধরে রাখলাম তা সারাজীবন অক্ষয় হয়ে থাকবে। এবার যেতে হবে আমাদের প্রধান গন্তব্য কাফের গাঁওয়ে। অভিসারিণী চেল নদী আর মেঘ-বৃষ্টি-কুয়াশার-পাহাড়কে কথা দিলাম আবার কোনও এক মনখারাপের মুহূর্তে চলে আসব। কিংবা সে যদি কখনও মেঘপিয়নের মাধ্যমে ডাক পাঠায়, তাই আমার ঠিকানাটাও রেখে গেলাম এখানে।
কীভাবে যাবেন: শিলিগুড়ি, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে গরুবাথান হয়ে সরাসরি এখানে আসা যায়।
কোথায় থাকবেন: লাভা, লোলেগাঁও, রিশপ যাওয়ার পথেই পড়ে এই জায়গা। তাই এগুলোর যে-কোনও একটি জায়গায় থাকা যায়।