এমন কোনও পর্যটন স্থানের কথা শুনেছেন, যেখানে গাড়িতে চড়ে ঘোরার উপায় নেই ? সেটা কোনও ভাবেই নয়। ভাড়া করার গাড়ি নেই, নিজের গাড়ি নিয়ে এলেও নেই প্রবেশের অধিকার। পাবেন হাতে টানা বাগ্গি, টয়ট্রেন, আর পারবেন ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে। এতদিন এইভাবেই চলছিল, হালফিল সময়ে ই-রিক্সা অনুমোদন পেয়েছে শহরে ঢোকার।
মহারাষ্ট্রের কারজাত তালুকে রায়গড় জেলার এক দুষণমুক্ত হিল স্টেশনের নাম মাথেরান। রায়গড় জেলা মানে বন্য গাছগাছালিতে ভরা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। রায়গড় জেলা মানে জঙ্গল, পাহাড়, জলপ্রপাত, ঝিল আর অবশ্যই ফোর্ট। জায়গাটা একটু খাপছাড়া ভাবে অবস্থিত। সবদিক থেকে আসা যায় না।
মুম্বইয়ের কল্যাণ থেকে একটা রেল লাইন গেছে উল্লাসনগর, বদলাপুর হয়ে কারজাতের দিকে। সেখান থেকে চলে গেছে লোনাভলা হয়ে পুণে। ওই লাইনের একটি স্টেশনের নাম নেরাল। এখানে নেমে পড়ুন, পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আপনাকে মাথেরানে নিয়ে যাওয়ার জন্য টয় ট্রেন। আর তা যদি না চান, স্টেশনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে মারুতি ভ্যান, পৌঁছে দেবে হিল স্টেশনের কাছাকাছি। তবে ট্রেন শহরের ভিতর পর্যন্ত ঢোকে, টয়ট্রেনে সফর আরামদায়ক, মনোরম ও যুক্তিযুক্ত। পুণে বা মুম্বই যেদিক থেকেই হোক, চার চাকার গাড়ি নিয়ে আসতে পারেন। গাড়ি পার্ক করতে হবে শহরের প্রবেশদ্বারের বাইরে।
‘মাথেরান’ একটি মারাঠি শব্দ। আক্ষরিক অর্থ ‘কপালে জঙ্গল’। মাথেরান গেলে কপালে সত্যিই জঙ্গল আর জঙ্গল। রকমারি গাছগাছালিতে ভরা পাহাড়িভূমি। বাতাস শুদ্ধতাতে ভরা। শহরের চারিদিকে ছড়ানো ছেটানো মেঠো রাস্তা এদিক ওদিক ঘুরে পৌঁছে গেছে কোন খাইয়ের কাছে। যেতে যেতে রাস্তার দুপাশে পড়বে জঙ্গল, আর গা ছমছম করা নির্জনতা।
শহরটা অনেকটা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্ট মাস্টার’ গল্পে বর্ণিত জায়গার মতো। নির্জনতায় আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। আবার বিদেশি গল্পের অনুকরণে অ্যাডভেঞ্চার-যুক্ত পরিবেশেরও ছাপ আছে। আছে ছবির মতো সুন্দর টয় ট্রেন ও তার স্টেশন। আছে পুরনো দিনের ফিল্মে দেখা পোস্ট অফিস। গল্পের শহরের মতো গুটিকয়েক দোকান। আছে হলিউড ফিল্মের সাইড শটের মতো, পাশ দিয়ে বড় বড় ঘোড়ার রাজসিক শব্দ তুলে সদর্পে টগবগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যপট। সারা শহর পথচারীদের দাপটেই চলে।
হাঁটতে হাঁটতে মনে হবে এ এক সম্পূর্ণ আলাদা পর্যটন ভূমি। এখানে এলে এখানেই সময় কাটাতে হবে। সাইডলাইনের স্পট সিয়িং-এর চ্যাপ্টার কম।
‘মাথেরান’ যেতে কিছু প্রস্তুতি অবশ্যই নেবেন। চাই স্পোর্টস শু, হ্যাট আর রুমাল। পারলে মিনারেল ওয়াটার সঙ্গে নিন। আর নিন ড্রাই খাবার। কারণ শহরের ভিতর দাম একটু চড়া। বিভিন্ন মানের থাকার হোটেল আছে। রেসর্ট আছে। দরদাম খুব চলে। হোটেল থেকে বেরিয়ে আলাদা খাবার রেস্টুরেন্ট আছে।
মাথেরানে বেড়ানোর মতো অনেকগুলি স্পট বা পয়েন্ট আছে। তার লিস্ট আগে দিই। লুইসা পয়েন্ট, মাধবজি পয়েন্ট, খান্ডালা পয়েন্ট, কিং জর্জ পয়েন্ট, হার্ট পয়েন্ট, লিটল চক পয়েন্ট, পর্কুপাইন পয়েন্ট, প্যানোরামা পয়েন্ট, লর্ড পয়েন্ট, রামবাগ পয়েন্ট, হনিমুন হিল পয়েন্ট, বেলভেডেয়ার পয়েন্ট, আলেকজান্ডার পয়েন্ট, ইকো পয়েন্ট, ওয়ান ট্রি হিল পয়েন্ট এবং মাঙ্কি পয়েন্ট। সব দেখা সাধারণত সম্ভব হয় না।
সানরাইজ দেখতে হলে যেতে হবে রামবাগ পয়েন্ট। সানসেট দেখতে পর্কুপাইন পয়েন্ট। নির্জনে মনের মানুষের সঙ্গে পাহাড়ের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করতে হলে হনিমুন হিল পয়েন্ট। ভালো ফটোগ্রাফি করতে চাইলে আলেকজান্ডার পয়েন্ট। সারি সারি পর্বতের ভিড়ের দৃশ্য যদি মন কেড়ে নেয়, খান্ডালা পয়েন্টে। পর্বতের মাঝে লেক বা জলপ্রপাত দেখতে যেতে হবে কিং জর্জ পয়েন্টে। পাহাড়ের মাঝে প্রতিধ্বনি শুনতে ইকো পয়েন্ট। লুইসা পয়েন্ট অবশ্যই দেখবেন- অ্যাডভেঞ্চার আছে, এখানে এলেই প্যনোরামিক ভিউ অর্থাৎ চতুর্দিক দর্শন করতে পারবেন।
এছাড়া চারলোট্টে লেক ও দোধানি জলপ্রপাত অবশ্যই দেখবেন। দু’দণ্ড বসে জিরোতে মাধবজি পয়েন্ট উপযোগী। ইরসালগড় ফোর্ট দেখতে গিয়ে ট্রেকিং-এর অভিজ্ঞতা হবে। আর ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য চান্ডেরি কেভ এক অসামান্য রসদ। দুই থেকে তিনদিন হেঁটে, দৌড়ে আপনি ফিট, মনও চাঙ্গা।