আমার ঘর
কঙ্কণ নন্দী
সব কিছু সাজিয়ে রাখছি, শুধু ইচ্ছেগুলো বাদ
কেননা আমি জানি, যা হবার হবে। তবে
আমার ইচ্ছেমতো কিছুই হবে না।
নতুন নতুন কত বই, টিভি, সোফা, ফ্রিজ
কম্পিউটারে ভরে রাখা কত শত ছবি—
সব সাজিয়ে তুলছি। কেউ এলে চমকে যাবে
এত বেশি ধৈর্য ছিল—
এত বেশি প্রেম!
ইচ্ছেগুলোর বয়স বাড়লেও এখনও বেশ তাজা
যেন সদ্য টবে রাখা ফুল—
না, না প্লাস্টিক নয়।
তবু আমার এই সাজানো ঘরে ওগুলো রাখছি না।
কেউ এসে কোনোদিন যদি
সেই সব তুলে ফেলে দিয়ে
নতুন নতুন ইচ্ছেকে সাজায়।
আমার ইচ্ছে শুধু হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়াবে।
স্রোত
কল্যাণ গঙ্গোপাধ্যায়
সব বুঝেছি, এমন ভেবে বিজ্ঞ সেজে
নাড়াই টিকি, নড়ছে দাড়ি!
আসলটা কী বুঝতে বুঝতে,
জল গড়িয়ে রক্তনদী!
মেঝেটাকে ভাগ করেছি
যে যার মতো, সাড়ে তিন হাত
সমস্তক্ষণ জগঝম্প, খাবার কেড়ে
করছি মজুত, ঝোল টানছি নিজের কোলে!
কোন কাজে যে লাগবে এসব,
আকাশ যদি হাতছানি দেয়
পোশাক খুলে লজ্জানত শরীরটাকে
আগুন খাবে, নয়ত যাবে মাটির ভিতর!
সংগঠিত জনসভায়, ভাষণের সঙ্গে নাচন
কী কাজে আর লাগবে তখন?
যখন শরীর শুনবে না আর!
এসব কথা নতুন কিছু? তুমি আমি সবই জানি
তবু এখন ফিচলেমি নয়, এই কথাটি বোঝার জন্য
একটুও যে অবসর নেই!
এখন শুধু ভেসেই চলি, বোধহীন পরগাছার মতো
গড্ডালিকার স্রোতের টানে!
মহিমাময়
তৈমুর খান
মহিমাময়, সবই মহিমাময়
আলোর পানে চেয়ে চেয়ে
সবাই দেখি আলোর জন্ম দেয়
কার বাঁশিতে কখন সুর ওঠে
কেউ বুঝি না—
পয়ার ভেঙে অনেক পয়ার হয়
ঝরনা ভেঙে অনেক ঝরনার মেয়ে
আমরা শুধু পাঠশালাতে কলরব পাই
চলো উদাসীন, নতুন দিন দেখে আসি
কেমন বিপ্লব এসেছে, কেমন বিপ্লবী
আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ…
আর তার কুলকামিনী…
সাবধানে পা ফেলো, জলাশয়ে কুমির আছে
ঝরনাদের নতুন পোষা কুমির!
ভাসমান
উদয় সাহা
ধরলা সেতুর উপর থেকে দেখি। নীচে নদী। মেঠো পথ-দাগ। বেঁকে গেছে। অবতল। যতদূর চোখ। উড়ে যাচ্ছে নষ্ট বাদাম খোসার চিঠি। কাঙরাতলির বাঁকে পাতায় পাতায় ধুলোঘর৷ ঢাকা ডাকনাম। ডাকহরকরা বেপথু হলে আমরা পেরিয়ে যাই ঘেঁটুফুলের ব্যারিকেড। যত্নহীন রুক্ষ তুলসিমঞ্চের মতো একা পাঁচমাইল প্রাথমিক বিদ্যালয়। উজ্জ্বল নীল ফড়িং আকাশচারী হলে জলজ চাদরে নেমে আসে অপ্রিয় ঠিকানার হলদে আলো৷ তুমিও তো প্রেমিক হতে চেয়েছিলে বসন্ত সৈনিক; আলগোছে ভেসে থাকে চৈত্রের সর ও স্বর…
সুখ
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
হাত বাড়ালেই সুখের গল্পগুলি ছোট হয়ে যায়
পুরোনো ক্ষতস্থান থেকে প্রেম ঝরে পড়ে
সামাজিক রাত্রির ভেতর।
কী দারুণ জারণ ক্ষমতা নিয়ে জেগে আছো তুমি
কল্পনায় সেজে ওঠে তোমার শহর
পৃথিবী পিছনে ফেলে ভেঙেচুরে সব আড়ম্বর
ক্রমশ নতুন হয় অনায়ত্ত দিনরাত্রিগুলি
আবার নতুন করে জমে ওঠে গল্পের বহর…
অমলেন্দু বিশ্বাস
উপত্যকা জুড়ে সুশোভিত পাইন উইলো বৃক্ষ,
এভাবে রক্তের দাগ নিয়ে নত হবে
ভেবেছ কখনো! ঠিক নত নয়, শোকে মূহ্যমান,
হতচকিত নারীটি ব্রীড়া ভেঙে দ্রোহমুখ
শাঁখা ও সিঁদূরে মাথা ঠুকে জঙ্গি বধে
আওয়াজ তুলেছে বিশ্ব চরাচরে।
আমাদের বন্দুকের নল অভীষ্ট ট্রিগারে
হাত রেখে তন্নতন্ন খুঁজে যাচ্ছে
দুরূহ জঙ্গলে, গোপন শিবিরে।
ওই দ্যাখো জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে
আমাদের বীর জওয়ানেরা প্রস্তুত রেখেছে
কৌরব নিধনে। মাটির কসম খেয়ে
ঠিক ঠিক আক্রমণে ধ্বংসের ভিতরে
পুঁতে দেবে শান্তিবীজ ত্রিরঙা অক্ষরে।
পদ্মপাতার মতো রুটি
অরূপ দত্ত
সময় ধরে আমি পথ চিনে যাই
তা সম্ভবত ভ্রমণের জন্য নয়।
সুন্দর একটি স্বপ্নের খোঁজে
অপরূপ একটি রূপকথার খোঁজে,
যাদের জন্য কিছু করতে পারি না,
তাদের জন্য পদ্মপাতার মতো
রুটির খোঁজ করি।
আমার ভালোবাসা মাখিয়ে
তাদের পেট ভরে খাওয়াবো একদিন।
কবিতার দিন
রবীনা মিত্র
কবিতার পায়ের কাছে নতজানু বসে থাকার মতন দিন এলে ভাবি,
আজ আর সাদা পৃষ্ঠার উপর
উপুড় হয়ে ধুঁকবে না বাক্যহীন হাত৷
বারবার ক্ষতস্থান ঘেঁটে তুলে আনতে হবে না বেসামাল অক্ষরমালা…
রক্তে ভেজা মাংসপিণ্ডের মতন!
এমন কঠিন উপাসনার দিন এলে ভাবি,
কবিতার নিকোনো উঠোনে বসাবো পুজোর বেদী৷
যজ্ঞ হবে!
আগুনে পুড়বে শব্দের ভীরুতা, ভাষার কারাগার।
কবিতা-ঈশ্বরী,
এটুকু আশীর্বাদ রেখো মাথায়,
লেখার কাছে যেন আমৃত্যু সৎ থাকতে পারি।