• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

প্রহরশেষের রাঙা আলোয়

ধারাবাহিক উপন্যাস

কাল্পনিক চিত্র

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

১২.
তমোনাশ
বঁধূ, কোন আলো লাগল চোখে৷
সুরঞ্জনাদি, জন্মাবধি পাড়ি দিচ্ছিলাম একটা অন্ধকার সাগর৷ যতই এগোচ্ছিলাম সেই অন্ধকার সাগরের ঢেউ প্রবল নিঃশব্দে ভাঙছিল আমার শরীরের উপর৷ এক নাগাড়ে সেই ঢেউয়ের প্রক্ষেপণ আমাকে ক্লান্ত— ক্লান্ত করছিল৷ সামনে ছিল না কোনও দিশা৷ হঠাৎ সুমিতাভ আমার সামনে এঁকে দিয়েছে একটা আলোর রেখা৷ তোমার সাহচর্যে সেই রেখা এখন আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও আরও আলোর দিকে৷
সুরঞ্জনাদি, তুমিই সেই আলোকবর্তিকা, আমাকে নিয়ে যাচ্ছ এক অলোর সাগরের দিকে৷
দিন তিনেক আগে ফোন করেছিলেন ‘বহুবর্ণ’ সংস্থার কর্ণধার সুবর্ণ রায়, তাঁদের আয়োজনে ‘চিত্রাঙ্গদা’ নৃত্যনাট্য উপস্থাপিত হবে দক্ষিণ কলকাতার মধুসূদন মঞ্চে৷ সেই নৃত্যনাট্যে চিত্রাঙ্গদার ভূমিকায় গান গাইবেন সুরঞ্জনা বসু৷ তমোনাশ গুপ্তকে গাইতে হবে অর্জুনের গান৷
চমকে উঠেছিল তমোনাশ৷ তার খ্যাতি এখনও এমন চূড়ায় পৌঁছোয়নি, যার কারণে তার কাঁধে দেওয়া হচ্ছে এই বিশাল দায়িত্ব৷ সে এও উপলব্ধি করেছে, নিশ্চিতভাবে তার নাম সুপারিশ করেছে সুরঞ্জনাদি৷ সুবর্ণ রায় ফোন করার পর যখন তমোনাশ বেশ দোলাচলে, ফোন এসেছিল সুরঞ্জনাদির, তমোনাশ, তোমার দ্বিধা করার কিছু নেই৷ আমি দু’দিনেই গানগুলো তুলে দেব তোমার গলায়৷ আমি কাল সন্ধের পর তোমার ফ্ল্যাটে যাব।
সুরঞ্জনাদি এল সন্ধের ঠিক পর-পরই৷ তার শরীর থেকে বেরোচ্ছে হালকা কামিনী ফুলের গন্ধ। চেয়ারে বসেই বলল, সময় খুব কম৷ ওদের বলেছি দু’জনে দশটা গান গাইব৷ তাতেই ওরা খুব খুশি৷
তমোনাশ দ্বিধা-দ্বিধা গলায় বলল, এত তাড়াতাড়ি কি পারব, সুরঞ্জনাদি?
—যে গানগুলো বেছেছি, তার বেশিরভাগ চিত্রাঙ্গদার গান৷ অর্জুনের একক গান কম৷ একটা গান চিত্রাঙ্গদা ও অর্জুনের দ্বৈতকণ্ঠে৷
—আর বাকি সংলাপ?
—সেগুলো ওরা দুই বাচিকশিল্পীকে দায়িত্ব দিয়েছে৷
তমোনাশ হাঁফ ছেড়ে বলল, উফ্‌, তা হলে পারব৷
—তমোনাশ, শান্তিনিকেতনে যখন প্রথম এই নৃত্যনাট্য অভিনীত হয়েছিল, তখনও গানের ব্যবহার ছিল কম৷ চিত্রাঙ্গদা ও অর্জুনের সংলাপগুলি বলা হত আবৃত্তির ঢঙে৷ যাঁরা নৃত্যশিল্পী তাঁদেরও সেভাবেই নির্দেশ দিতেন নৃত্যনির্দেশক৷ পরবর্তীকালে সব সংলাপেই ব্যবহৃত হত গান৷
—আমার এত কম গানে সন্তুষ্ট হবেন শ্রোতারা?
—‘বহুবর্ণ’ সংস্থা আমাদের জুটিকে ব্যবহার করতে চাইছেন বলেই আবৃত্তির অংশ বেশি রেখেছেন৷
তমোনাশ বিষয়টা বুঝতে চাইল৷
—চিত্রাঙ্গদা প্রথমে লিখিত হয় নাট্যকাব্য হিসেবে৷ ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় এই নাট্যকাব্য৷ তার চুয়াল্লিশ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ তাকে রূপান্তরিত করেন নৃত্যনাট্যে৷ তারও একটা ইতিহাস আছে৷ ১৯৩০ সালে কবির সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণকালে বিখ্যাত জার্মান শিল্পী লাবাসের শিষ্য ইয়স-এর এক নৃত্যনাট্যের রূপায়নের সময় খণ্ড-খণ্ড নাচে কীভাবে রূপ দিতে পারে একটি নৃত্যনাট্য, তা অনুুুধাবন করেছিলেন প্রতিমা দেবী৷ শান্তিনিকেতনে ফিরে, তা নিয়ে আলোচনা করেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে৷ তখনই রবীন্দ্রনাথ নৃত্যনাট্য হিসেবে রচনা করেন চিত্রাঙ্গদাকে৷
তমোনাশ বিস্মিত হয়, সুরঞ্জনাদি, একটা মহান সৃষ্টির নেপথ্যে কী দারুণ যোগাযোগ।
—একটা ঐতিহ্যের সঙ্গে তোমার অংশগ্রহণ হতে যাচ্ছে, তার আগে কিছু ইতিহাস জেনে নেওয়াটাও প্রয়োজন৷ গত শতকের ষাটের দশকের মাঝামাঝি চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যর প্রথম যে রেকর্ডিং হয়েছিল, তাতে চিত্রাঙ্গদার গান সুচিত্রা মিত্রের গলায়, অর্জুনের গান দেবব্রত বিশ্বাসের গলায়৷ খুব হিট করেছিল সেই রেকর্ড৷ তারও প্রায় ছ-সাত বছর পরে যে রেকর্ডিং হয়েছিল তাতে চিত্রাঙ্গদার গান সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে হলেও অর্জুনের গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়৷
তমোনাশ শুনে বিভ্রান্ত হয়ে বলল, তাঁদের গান শোনার পর শ্রোতারা আর আমার গান শুনবেন?
—তাঁরা হলেন কিংবদন্তীপ্রতিম শিল্পী৷ তাঁদের গান রেকর্ডে বা ইউটিউবে বহুবার শুনেছেন সবাই৷ এত বছর পরে নতুন একটি জুটির গান কেমন হয়, সে-বিষয়ে আগ্রহ থাকবে এ-যুগের শ্রোতাদের৷ তোমার কণ্ঠস্বর তো এখনকার শ্রোতারা মেনে নিয়েছেন৷ আত্মবিশ্বাস নিয়ে গাইবে৷ দেখবে উচ্ছ্বসিত হয়ে হাততালি দেবেন শ্রোতারা৷
তমোনাশ নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে৷
—তমো, তোমাকে সংক্ষেপে চিত্রাঙ্গদার গল্পটা শুনিয়ে দি৷ সবটা শুনলে তুমি আস্তে আস্তে নৃত্যনাট্যর গভীরে ঢুকতে পারবে৷ মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন, তাঁদের বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে৷ তা সত্ত্বেও যখন রাজকুলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হল, রাজা তাকে পালন করলেন পুত্ররূপে৷ রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা৷ শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি৷ সেসময় অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করে ভ্রমণ করতে করতে এসেছেন মণিপুরে৷
প্রথম দৃশ্যে চিত্রাঙ্গদার শিকার আয়োজন৷ প্রথমেই গানের দৃশ্য:
গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বতশিখরে…
সেখানে বনপথে অর্জুন নিদ্রিত, চিত্রঙ্গদার সঙ্গীরা অর্জুনের নিদ্রাভঙ্গ করলে খুব ক্রুদ্ধ হন অর্জুন,  বললেন:
অহো কী দুঃসহ স্পর্ধা
অর্জুনে যে করে অশ্রদ্ধা
সে কোনখানে পাব আশ্রয়
চিত্রাঙ্গদা চমকে উঠে বলে: অর্জুন, তুমি অর্জুন
অর্জুন তখন ভীষণ ক্রুদ্ধ:
হাহাহাহা হাহাহাহা বালকের দল,
মা’র কোলে যাও চলে— নাই ভয়৷
অহো কী অদ্ভুত কৌতুক৷
অর্জুন ক্রুদ্ধ হয়ে প্রস্থান করলে চিত্রাঙ্গদা তখন বলছে:
      অর্জুন, তুমি অর্জুন৷
        ফিরে এসো, ফিরে এসো—
ক্ষমা দিয়ে কোরো না অসম্মান,
       যুদ্ধে করো আহ্বান৷
        বীর হাতে মৃত্যুর গৌরব
করি যেন অনুভব৷
চিত্রাঙ্গদা মার্জনা চাইলেও অর্জুন চলে যান সেখান থেকে৷ কিন্তু চিত্রাঙ্গদা তখন অর্জুনকে দেখে আত্মহারা, অর্জুনকেই চাইছে, অথচ অর্জুন—
চিত্রাঙ্গদা তখন সখীদের উদ্দেশে গাইছে সেই বিখ্যাত গান৷ সিন্ধ ভৈরবী রাগের এই গানটি চিত্রাঙ্গদার:
বঁধূ, কোন আলো লাগল চোখে৷
বুঝি দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যালোকে৷
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিনরাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে—
জন্ম–জনম গেল বিরহশোকে৷
চিত্রাঙ্গদা তখন অর্জুনের প্রেমে বিহ্বল৷ তার চোখে প্রেমের প্রথম আলো৷ অর্জুন, তুমি কোথায় ছিলে এতকাল, তোমারই প্রতীক্ষায় তো ছিলাম এতদিন৷ যুগ যুগ ধরে, দিনের পর দিন ছিলাম মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে৷ তোমার বিরহে কেটে গেল কত জন্ম৷
অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে,
সঙ্গীতশূন্য বিষণ্ণ মনে
সঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতি
পোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি৷
যে-কুঞ্জবনে মঞ্জরী এখনও ফুটে ওঠেনি, সেখানে সংগীতবিহীন হয়ে, সঙ্গীহীন হয়ে তার দুঃখের রাতগুলি কেটেছে বিষণ্ণ মনে৷ এই নির্জন একাকিত্বের মধ্যে কি কোনোদিন পোহাবে তার নিঃসঙ্গ রাত
সুন্দর হে, সুন্দর
বরমাল্যখানি তব আনো বহে, তুমি আনো বহে৷
অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে
হেরো লজ্জিত স্মিত মুখ শুভ আলোকে৷
চিত্রাঙ্গদা তখন সুন্দরকে বলছে, বয়ে আনো বরমাল্য, ঘুচিয়ে দাও আমার অবগুণ্ঠনের ছায়া, শুভ আলোকে দেখো আমার লজ্জা-লজ্জা মুখ৷
গান থামিয়ে সুরঞ্জনাদি বললেন, তমো, চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের মতো বীরকে একবার দেখেই প্রেমে পড়ে গেছে৷ কিন্তু অর্জুন তার বালকবেশ দেখে প্রত্যাখ্যান করেছেন সকৌতুকে৷ চিত্রাঙ্গদা প্রেম নিবেদন করতে গেলে অর্জুন অজুহাত দিলেন তাঁর ব্রহ্মচর্য ব্রতের৷ চিত্রাঙ্গদা ভাবল তার কুরূপের কারণেই অর্জুনের বীতরাগ৷ তখন সে শরণাপন্ন হল কামদেব মদনের৷ মদন তাকে সুরূপা করে দিতে তার সুন্দর রূপ দেখে অর্জুন প্রেমাসক্ত হয়ে পড়লেন চিত্রাঙ্গদার প্রতি৷
কিন্তু চিত্রাঙ্গদা সুরূপা হয়েছে মাত্র কিছুকালের জন্য৷ তাই অর্জুনকে সতর্ক করে দিয়ে বলল,
‘কিন্তু মনে রেখো,
কিংশুকদলের প্রান্তে এই-যে দুলিছে একটু শিশির তুমি যারে করেছ কামনা
সে এমনি শিশিরের কণা
নিমেষের সোহাগিনী৷’
ও অর্জুন, তুমি বাইরে থেকে আমার যে-রূপ দেখছো, আমার ভেতরটা তত সুন্দর নয়৷ তোমার সঙ্গে ছলনা করেছি আমি৷
তমোনাশ হঠাৎ বলল, সুরঞ্জনাদি, প্রেমের জন্য মানুষ অনেক কিছু করতে পারে৷
সুরঞ্জনাদি বলল, তা পারে৷ তবু কোথাও তো একটা সীমারেখা টানতে হয়৷ এ সব কথা এখন  থাক৷ অর্জুনের কয়েকটি একক গান আছে, তাদের মধ্যে একটি মিশ্র বেহাগ রাগে ‘তৃষ্ণার শান্তি…’, আর একটি আছে মিশ্র দেশ রাগাশ্রিত গান, অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদার দ্বৈতকণ্ঠে, ‘কেটেছে একেলা বিরহের বেলা’, এই দুটো গান আজ তুলে দিই তোমাকে৷ যদিও এই দুটো গানই আছে নৃত্যনাট্যের একেবারে শেষদিকে, কিন্তু সময় বেশি নেই৷ এসো—
তমোনাশ বলল, সুরঞ্জনাদি, আমি তো সুন্দরও দেখতে পাই না, অসুন্দরও না৷ আমার কাছে সুন্দর আর অসুন্দর সব এক৷
সুরঞ্জনাদি বলল, তমো, আলো আর অন্ধকার, দিন আর রাত্রি সমস্তটা নিয়েই তো জগৎ আর জীবন৷ তোমার চোখে দৃষ্টি নেই বলে সব এক৷ কিন্তু বাস্তবজীবনে সুন্দর আছে অসুন্দরও আছে৷ সবকিছু সুন্দর যেমন হয় না, সবকিছু অসুন্দর, তাও হয় না৷ সুন্দর–অসুন্দর নিয়েই তো পৃথিবী৷ তাই রসোত্তীর্ণ শিল্প সৃষ্টি করতে সুন্দর-অসুন্দর দুইই লাগবে৷ নন্দনতাত্ত্বিক বিচার যদি করো, সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অসুন্দর বা কুৎসিত বলে কিছু থাকে না। শিল্পীর তুলির আঁচড়ে বা কবির কলমে অসুন্দরও হয়ে ওঠে সুন্দর৷ ধরো:
তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি
তুমি এসো বিরহের সন্তাপভঞ্জন৷
দোলা দাও বক্ষে       এঁকে দাও চক্ষে
স্বপনের তুলি দিয়ে মাধুরীর অঞ্জন৷
—তমো, কবিতা হচ্ছে একটা ছবি৷ শব্দ দিয়ে রচিত ছবি৷ তেমনই গানের মধ্যে থাকে সংগীতময়তা ও চিত্রধর্মিতা৷ রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের গানের কথাও এই দুই উপাদানে ভরপুর৷
তমোনাশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে গানটা তুলে নিল বার দুই চেষ্টা করে৷ গান থামিয়ে বলল, রবীন্দ্রনাথের গান হচ্ছে এক ধরনের নেশা৷ তুমি সেই নেশা আরও গভীরভাব চারিয়ে দিচ্ছ প্রতিদিন৷
বলে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে চাইল সুরঞ্জনাদিকে, বলল, তুমি কোথায়, সুরঞ্জনাদি?
আজ সুরঞ্জনা বসে আছে একটু দূরে, বলল, তমো, রাত হয়ে এসেছে৷ আজ আমি উঠি৷ কাল আবার এই সময়ে আসব৷
তমোনাশের ভিতর কী এক অন্য ছটফটানি, বলল, আমি অপেক্ষা করব, সুরঞ্জনাদি৷
(ক্রমশ)         
অলঙ্করণ: সোময়েত্রী চট্টোপাধ্যায়     

Advertisement

Advertisement