প্রবীর ঘোষাল
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখিয়ে দেওয়া পথেই একের পর এক রাজ্য জয় করছে বিজেপি-র নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট। মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা, দিল্লি এবং ওড়িশার পর বিহার। মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বাংলাবাসীকে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়ে চলেছেন মমতা। তাঁর একের পর এক উন্নয়ন এবং জনকল্যাণমূলক প্রকল্প এখন বিভিন্ন রাজ্যে ভোটের ময়দানে বিজেপি তথা এনডিএ-র মস্ত বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রে তারা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে চলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারও বাধ্য হয়েছে এইসব প্রকল্প অনুসরণ করতে।
মহারাষ্ট্র থেকে বিহার পর্যন্ত নির্বাচনী ফলাফল বুঝিয়ে দিচ্ছে, মমতার অস্ত্রই বিজয়ীদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে। বিহারের কথাই ধরা যাক। এবারে এই পড়শি রাজ্যে ভোটের হার সর্বাধিক। বিশেষ করে মহিলারা যেভাবে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিয়েছেন, সেটা বিহারের নির্বাচনী ইতিহাসে সর্বকালীন রেকর্ড। ৭০ শতাংশের বেশি মহিলা এবারের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো মহিলাদের আর্থিক সহায়তা প্রকল্প এক্ষেত্রে নীতীশকুমারকে মুখ্যমন্ত্রীর মসনদে প্রত্যাবর্তনে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে। একেবারে ভোটের মুখে এই নভেম্বরের গোড়ায় বিহারে প্রায় দেড় কোটি মহিলার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১০ হাজার টাকা করে ঢুকেছে। অনেকেই অবশ্য মন্তব্য করেছেন, ‘এ তো সরকারি ভোট কেনা!’
Advertisement
এমনিতে ক্ষমতায় এসে বিহারে মদ নিষিদ্ধ করে মহিলাদের একটা সহানুভূতি পেয়ে আসছেন নীতীশকুমার। যদিও চোরাপথে চোলাই মদে রাজ্যটি এখনও ভেসে যাচ্ছে। ভোটের মুখে ‘অপরিণত রাজনীতিবিদ’ তেজস্বী যাদব ঘোষণা করে বসেন, তাঁদের জোট ক্ষমতায় এসেই, আবার মদ বিক্রি চালু হবে। এটা যে বিহারের মহিলারা ভালোভাবে নেননি, ফলাফলই তার প্রমাণ।
Advertisement
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের ব-কলমে সিপিএমের ‘অরাজক শাসন’ ৩৪ বছর ধরে রাজ্যবাসী দেখেছে। ঠিক তেমনই বিহারে একটানা লালু-রাবড়ির দীর্ঘ রাজত্বে ‘জঙ্গলরাজ’ মানুষের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছে। নীতীশকুমারের সরকার রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সহ উন্নয়নের পাশাপাশি বিহারে অনেকটাই সুশাসন ফিরিয়ে এনেছে। ফলে, ভোটের বাজারে তেজস্বীর মধ্যে লালুপ্রসাদের রাজত্বের কালোদিনগুলির ছায়া বিহারী ভোটারদের একটা অংশকে প্রভাবিত করেছে। এখানে যেমন ভোট এলে, সিপিএম যত লাফালাফি করে, ততই মানুষের মনে অতীতের বিভীষিকার রক্তাক্ত অধ্যায়গুলি জীবন্ত হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
পশ্চিমবঙ্গেও উন্নয়নের পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন মমতা। বিহারে বিরোধীরা ধারাবাহিক সরকার-বিরোধী কোনও আন্দোলন করতে পারেনি। কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী-তেজস্বী যাদবদের পদযাত্রা মানুষের মনে দাগ কাটেনি। তাছাড়া, ‘সার’ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস বাংলায় যেভাবে মাটি কামড়ে পড়ে আছে, বিহারে তো ভোটার তালিকা সংশোধনের সময় বিরোধীদের খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
লাগোয়া রাজ্যের ভোটের হাওয়া দেখে বঙ্গ বিজেপির বড়-মেজো-সেজো নেতা-নেত্রীরা মেতে উঠেছেন। ঠিক এমন ছবি আমরা ২০১৮ সালেও দেখেছি। সেবার লোকসভা নির্বাচনে ৪২টির মধ্যে এ রাজ্যে ১৮টি আসন পায় গেরুয়া শিবির। তাতেই দলের মধ্যে রাজ্যপাটে বসার স্বপ্নে ছোট-বড় সব নেতা-নেত্রী বিভোর হয়ে যান। অনেকেই মন্ত্রী হবেন ভেবে, ভোটে দাঁড়াতে মরিয়াভাবে মাঠে নামেন। বিজেপির মধ্যে বিধানসভার নির্বাচনে দলীয় টিকিট পাওয়া নিয়ে কদর্য কাজিয়া দেখা যায়। মানুষ বোঝে, রাজ্য শাসন করার মতো পরিণত নয় তারা। ফলে, বিধানসভা ভোটে পদ্মফুলের ভয়ঙ্কর ভরাডুবি হয়।
এবারও সেই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। এমনিতে গেরুয়া শিবিরের অনেকেরই বিশ্বাস, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ মুখে যাই বলুন, তাঁরা বাংলার পরিবর্তনের আশা আর করেন না। কারণ শমীক ভট্টাচার্য সভাপতি হওয়ার পর কয়েকজন কেটে গেলেও এখনও দলের রাজ্য কমিটি তৈরি হয়নি কেন, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে। জেলাতেও একই অবস্থা। ঘরোয়া কাজিয়ায় বিপর্যস্ত দল। ভোটার তালিকা সংশোধনের কাজেও রাজ্যের অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিজেপির নেতা-কর্মীদের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যদি রাজ্যে পরিবর্তন চাইতেন, তাহলে কি গেরুয়া শিবিরের এই দুর্দশার পরিস্থিতির বদলে চেষ্টা হত না?
সুতরাং, রাজনৈতিক মহল মনে করছে, বিহারের ফল উন্নয়ন এবং সুশাসনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যেটা এ রাজ্যে জোড়াফুলের আসল মন্ত্র। তৃণমূল কংগ্রেসের ভোটব্যাঙ্ক বাংলায় ভাঙতে গেলে, বিজেপিকে যেভাবে লড়তে হবে, তার কোনও লক্ষণই এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রীও বসে নেই। রাজ্য চষে বেড়াচ্ছেন মমতা। আর সংগঠনের দুর্বলতা মেরামতিতে দলের সেকেন্ড-ইন কমান্ড অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সদা তৎপর।
Advertisement



