• facebook
  • twitter
Friday, 5 December, 2025

ডিএ মামলায় কর্মীপক্ষের ‘জয়’ সম্পর্কে আমরা কেন এত আশাবাদী?

আইএনটিইউসি-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত রমেন পান্ডে আমাদের সঙ্গে সর্দার আমজাদ আলির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন৷

প্রতীকী চিত্র

শ্যামল কুমার মিত্র

যে কোন ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের পক্ষে সব থেকে গৌরবের বিষয়, দল-মত-সংগঠন নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ যৌথ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার/মালিককে ন্যায্য দাবি পূরণে বাধ্য করা৷ বর্তমান ফ্যাসিস্ত ও আদ্যন্ত শ্রমিক-কর্মচারী বিদ্বেষী সরকারের তৈরি হিমশীতল আতঙ্কের আবহে আইনের সাহায্যে দাবি পূরণের প্রয়াস নিতান্তই একটি ‘কৌশলগত অবস্থান’ মাত্র৷ কর্মচারীদের বহুমাত্রিক সমস্যা ও দাবি পূরণে সর্বক্ষেত্রে আদালত নির্ভরতার মনোভাব বিপজ্জনক৷ মূলত ৩ টি উদ্দেশ্যে আমরা ডিএ মামলা করেছিলাম৷ (১) আইনি ভাবে All India Consumar Price Index অনুসারে কর্মীদের ডিএ-র ‘অধিকার’ প্রতিষ্ঠা করা৷ (২) বহুধাবিভক্ত কর্মীসমাজকে ডিএ-র মত কমন দাবিতে একাত্ম করে তোলা৷ (৩) রাজ্য সরকার, শাসক দল এবং কর্মীসমাজকে এই বার্তা দেওয়া যে” রাজরোষ যতই তীব্র হোক না কেন, প্রয়োজনে রাজরোষ উপেক্ষা করে সরকারের কর্মীবিদ্বেষী নীতি ও কর্মসূচির বিরুদ্ধে দৃঢ় এবং সাহসী অবস্থান নিতে জানে কর্মীসমাজ৷” কেন আমাদের বিশ্বাস ছিল যে ‘বিচারের বিষয়’ হিসাবে AICPI অনুসারে ডিএ-র দাবি আদালত গ্রাহ্য হবে? ০১.০৪.১৯৭৯ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন্দ্রীয় (কেন্দ্র AICPI অনুসারে ডিএ দেয়) হারে ডিএ দেওয়ার নীতি কার্যকর করেছে (অর্থ দপ্তরের অর্ডার নম্বর: 13600 F. dt.18.12.1987)৷ দিল্লি ও চেন্নাইয়ে (পূর্বতন মাদ্রাজ) ১৯৯৪ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত এ রাজ্যের রাজ্য সরকারি কর্মীদের কেন্দ্র ও তামিলনাড়ু সরকারের হারে (উভয় ক্ষেত্রেই AICPI অনুসারে ডিএ দেওয়া হয়) ডিএ দেন রাজ্য সরকার (অর্থ দপ্তরের অর্ডার নম্বর: 10683 F dt.10.11.1994)৷ সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারা অনুসারে রাজ্য সরকার কর্মীদের কর্মস্থল ভেদে বেতনের অংশ ডিএ প্রদানের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন হার কার্যকর করার বৈষম্য করতে পারেন না৷ পূর্বতন বাম সরকার অর্থসঙ্কটের কারন দেখিয়ে ৫ কিস্তি ডিএ-র টাকা ৩ বছরের জন্য শর্তসাপেক্ষে প্রভিডেন্ট ফান্ডে রাখার সিদ্ধান্ত নেন৷ এর বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয় (তখন স্যাট গঠিত হয়নি)৷ আদালত রায় দেন, ‘যেহেতু দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধি জনিত মুদ্রাস্ফীতির তাৎক্ষণিক মোকাবিলার প্রয়োজনে ডিএ দেওয়া হয়,তাই বর্তমান মূল্যবৃদ্ধি মোকাবিলায় ৩ বছর পরে সুদসহ ডিএ-র অর্থ পেলে মূল উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়৷ যে সব কর্মী বেতনের সঙ্গে বর্তমান ৫ কিস্তি ডিএ পেতে চান,তাদের তা দিতে হবে৷’ তৎকালীন সরকার এই রায় মেনে নেন৷ অর্থাৎ এই রায়ে স্পষ্ট ডিএ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত— এমনটাই মনে করেন আদালত৷ সুপ্রিম কোর্টের ডিএ সম্পর্কিত একাধিক রায়ে ‘ডিএ-কে কর্মীদের অধিকার’ বলা হয়নি৷ আবার একাধিক রায়ে ডিএ-কে কর্মীদের অধিকারের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে৷ কেন এই বৈপরীত্য? ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর বেশ ক’বছর সুপ্রিম কোর্ট তথা এ দেশের বিচার ব্যবস্থা ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলের অধীনে ঔপনিবেশিক নীতিতে পরিচালিত হয়েছে৷ সেই সময়কালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বিদেশী শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতায় কর্মী বিরোধিতার প্রকাশ ঘটেছে৷ এই সব রায়, স্বাধীন ভারতে যে দিন থেকে দেশীয় বিচার ব্যবস্থা ‘ভারতীয় ন্যায় সংহিতা’ অনুসারে চলতে শুরু করেছে, স্বাধীন ভারত সরকারের সংবিধান ও আইন মেনে, সেদিন থেকে ওই সব রায় গুরুত্বহীন এবং সেগুলিকে প্রিসিডেন্ট হিসাবে প্রদর্শন গ্রহনযোগ্য হতে পারে না৷ সর্দার আমজাদ আলি ও বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের এ বক্তব্য কলকাতা হাইকোর্ট গ্রহণ করেছেন৷ ন্যায় সংহিতার অধীন সুপ্রিম রায়ই বিবেচ্য৷

Advertisement

এবার দেখা যাক সংবিধানের ৩০৯ নম্বর ধারা কি বলে, ‘Article 309 of the Indian Constitution empowers Parliament and State Legislatures to pass laws governing the recruitment and conditions of service for public servants.It also allows the President (for union services) and Governors (for state services) to make rules for these aspects until specific legislation is enacted.These rules are subject to the provisions of any subsequent Act of the Legislature.’ অর্থাৎ সরকারি কর্মীদের নিয়োগ ও চাকরি শর্তাবলী সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন সংবিধানের ৩০৯ নম্বর ধারা অনুসারে সংসদ/বিধানসভার উপর ন্যস্ত৷ আরও সুনির্দিষ্ট আকারে বললে, কেন্দ্র/রাজ্য সরকার সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মীদের নিয়োগ ও চাকুরি শর্তাবলী (বেতন-ভাতাসহ) সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার অধিকারী৷ ৩০৯ নম্বর ধারা মোতাবেক বেতন-ভাতা সংক্রান্ত রুলস (এ ক্ষেত্রে ‘রোপা-২০০৯’) তৈরি করেছিলেন পূর্বতন বাম সরকারের অর্থমন্ত্রী ড. অসীম দাশগুপ্ত৷ এই ‘রোপা ২০০৯’-এ ড. দাশগুপ্ত AICPI অনুসারে বছরে ২ বার ডিএ দেওয়ার সুনির্দিষ্ট সংস্থান রেখেছিলেন৷

Advertisement

সরকারে শাসক দলের পরিবর্তন হতেই পারে, কিন্তু সরকার একটি নিরবচ্ছিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান (Contineuing Constitutional Body)৷ ‘রোপা’য় দেওয়া সরকারি প্রতিশ্রুতি সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি (Constitutional Commitment) যা পরবর্তী শাসকদল সাংবিধানিক ও আইনি ভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না৷ এ পর্যন্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট, নিছক অ্যাডভেঞ্চার হিসাবে কর্মীস্বার্থ নিয়ে আমরা ‘জুয়া’ খেলি নি, রীতিমত মামলার ইতিবাচক পরিণতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েই আমরা স্যাটে ৩ টি দাবিতে মামলা করেছি: (১) ‘রোপা–২০০৯’ অনুসারে বকেয়া ৩৪% (মোট বকেয়া ছিল ৫০%, পূর্বতন সরকার ১৬% ডিএ-র সংস্থান রেখে গিয়েছিলেন, তাই ৩৪%) ডিএ প্রদান,(২) ডিএ ঘোষণার সূচক হিসাবে AICPI-কে মান্যতা দিতে হবে, (৩) দিল্লি, চেন্নাই-এ কর্মরত রাজ্যকর্মীদের ভিন্ন হারে ডিএ দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করতে হবে৷ আমরা সরকার সমর্থক সংগঠন বাদে সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মীসংগঠনের (স্যাটের মামলা বলে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী, অন্যান্য রাজ্য কর্মীসংগঠনকে মামলায় যুক্ত হওয়ার প্রস্তাবের বাস্তবতা ছিল না) সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার প্রক্রিয়া চালিয়েছি একসঙ্গে মামলা করার প্রত্যাশায়৷ কিন্তু ১টি বাদে কোনও সংগঠন মামলা করতে রাজি হয়নি৷ ২০১৭ সালে, মামলা যখন হাইকোর্টে এল, তখন শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও অন্যান্য রাজ্যকর্মীদের সংগঠনগুলি এই মামলায় যুক্ত হতেই পারতেন, কিন্তু তা হয়নি৷

‘রোপা-২০০৯’-এর বকেয়া ডিএ যে আদায়যোগ্য, সেই কথাটা মামলার সঙ্গে যুক্ত সংগঠন ৩টি বাদে কেউ বিশ্বাসই করেন নি, তাই মামলার সঙ্গে যুক্ত সংগঠন ৩টি বাদে কোনও সংগঠনের দাবিসনদে এই দাবিটিই নেই৷ বস্তুত ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল পর্যন্ত কোনও সংগঠন এই মামলায় যুক্ত হতে চায়নি৷ ২০২২ সালের ১৩ এপ্রিল ১টি রাজ্য সরকারি কর্মী সংগঠন এই মামলায় যুক্ত হয়৷ সংগ্রামী যৌথ মঞ্চের ঘোষিত অবস্থান ছিল,”‘রোপা–২০০৯’-এর মামলায় তারা যুক্ত হবেন না, ‘রোপা-২০১৯’-এর বকেয়া ডিএ-র দাবিতে তারা আন্দোলন করবেন৷ কিন্তু গত ২৫.০৩.২০২৫ এ তারা অবস্থান বদল করে সুপ্রিম কোর্টে মামলায় যুক্ত হওয়ার আবেদন জানান৷ সুপ্রিম কোর্ট মঞ্চকে মামলায় যুক্ত হওয়ার অনুমতি দেয়নি, তবে মামলায় তাদের বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়েছেন৷ মামলার জন্য আইনজীবী প্রয়োজন৷ কিন্তু একাধিক প্রথিতযশা আইনজীবী রাজরোষে পড়ার আতঙ্কে মামলা নিতেই রাজি হলেন না৷ স্যাটের একজন প্রখ্যাত আইনজীবী আমাদের বেশ কয়েকমাস ঘুরিয়ে বললেন, ‘আমার উপর চাপ আছে, আপনাদের মামলা নিতে পারব না৷’ এই ভদ্রলোক পরে স্যাটে সরকারপক্ষের হয়ে সওয়াল করেছিলেন৷

আইএনটিইউসি-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার তৎকালীন সভাপতি প্রয়াত রমেন পান্ডে আমাদের সঙ্গে সর্দার আমজাদ আলির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন৷ তিনি মামলা নেন৷ স্যাটে আমাদের পিটিশন দাখিল করেন, শুরু হয় ‘কনফেডারেশন অফ স্টেট গভ. এমপ্লয়িজ অ্যান্ড আদার্স–ভার্সেস–স্টেট অফ ও.বে. অ্যান্ড আদার্স’ (ডিএ মামলা) মামলার পথ চলা শুরু৷ যে কোনও মামলায় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ হল মামলার পিটিশন রচনা৷ সর্দার আমজাদ আলি যে অননুকরণীয় পেশাদারি দক্ষতা, মেধা, দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং কর্মীসমাজের প্রতি আন্তরিক দরদের সংমিশ্রণে এই মামলার পিটিশন তৈরি করেছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট নয়৷ তাঁকে সহায়তা করেছিলেন আইনজীবী মাসুম আলি সর্দার, প্রবীর চ্যাটার্জি এবং অবশ্যই প্রয়াত রমেন পান্ডে৷ তাঁর তৈরি ‘পিটিশন’ নামক মামলার নিশ্ছিদ্র স্ট্রাকচারাল ফাউন্ডেশন ভেদ করে আজ পর্যন্ত কোনও কালনাগিনী কর্মীস্বার্থকে দংশন করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে এমনটা আমরা বিশ্বাস করি না৷ অনেক বিদগ্ধ মানুষ সমাজ মাধ্যমে লিখছেন মামলায় সংবিধানের ৩১১ নম্বর ধারার উল্লেখ রাখা উচিত ছিল আমাদের৷” Article 311:The primary goal of Article 311 is to safeguard the independence and security of tenure for civil servants, preventing them from arbitrary or unjust disciplinary actions. It ensures fairness and adheres to the principles of natural justice in disciplinary proceedings against govt.employees. “ডিএ মামলার সঙ্গে এই ৩১১ নম্বর ধারার কী সংযোগ, তা আমাদের বোধগম্য হয়নি৷ স্যাটের মাননীয় বিচারপতি অমিত তালুকদার ও এ.কে.চন্দের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিলেন, “As it is found by the Tribunal no one can have any legal right for staking a claim for DA, payment of the same being in the sole discretionary realm of the Employer. “রাজ্য সরকারের বক্তব্যই উঠে এল স্যাটের রায়ে৷ এই রায়,আক্ষরিক অর্থে, কর্মীসংগঠনগুলি এবং কর্মীসমাজের চোখে আমাদের এবং কনফেডারেশনকে ‘ভিলেন’ বানিয়ে দিল৷ বলা হতে থাকল, যাও সরকার বছরে ১টা ডিএ দিত, সেটাও আর দেবে না স্যাটের রায় দেখিয়ে৷ কনফেডারেশন স্রেফ হটকারি সিদ্ধান্তে মামলা করে কর্মীদের চরম সর্বনাশ করল৷ কিন্তু আমরা ওই দুই বিচারপতিকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম, কারণ বছরের পর বছর মামলা ঝুলিয়ে না রেখে তাঁরা ১টি মাত্র শুনানিতেই আমাদের হাইকোর্টে যাওয়ার সুযোগ করে দিলেন৷ সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুসারে আমরা মামলায় বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যকে যুক্ত করার প্রয়োজনে আবার কর্মীসংগঠনগুলির কাছে মামলায় ‘Add Party’ হওয়ার জন্য আবেদন করলাম, কোন সংগঠন রাজি হলেন না৷ এগিয়ে এলেন অর্থ দপ্তরের (প্রয়াত) সহকর্মী স্বপন দে৷স্বপনদার আইনজীবী হিসাবে আমরা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে মামলায় যুক্ত করলাম৷ স্বপনদার অকাল প্রয়ানের পর তাঁর স্ত্রী এই মামলায় স্বপনদার পরিবর্ত হিসাবে যুক্ত হন৷ বৃহত্তর কর্মীস্বার্থে রাজরোষ উপেক্ষা করে যে অসম সাহসিকতায় এঁনারা দু’জন ব্যক্তি মানুষ অনবদ্য ভূমিকা নিয়েছেন, তার জন্য কোনও প্রশংসাই যথেষ্ট হতে পারে না৷ স্বপনদারা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন,তাই ফ্যাসিস্ত শাসকের বিরুদ্ধে ‘কন্ঠস্বর’ ছিল, আছে এবং থাকবে৷ এর পরেরটার সবটাই ‘ইতিহাস’৷ সর্দার আমজাদ আলি ও বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য জুটি কলকাতা হাইকোর্ট ও স্যাটে পাঁচ পাঁচটি ‘জয়’ কর্মী সমাজকে উপহার দিলেন৷

গত ৩১ আগষ্ট ঐতিহাসিক রায় হল,”DA is a legally enforceable right of the Employees.” মাঝে (প্রয়াত) রমাপ্রসাদ সরকার কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির বেঞ্চে একটি জনস্বার্থ মামলা করলেন৷ বিষয়: শ্রমিক-কর্মীদের ৯৮% এরও বেশি হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, অথবা বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত৷ তাদের তো মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না৷ তাহলে কেন শুধু সরকারি কর্মীদের ডিএ-র নামে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে? তিনি তাঁর মত করে যুক্তি, তথ্য সাজিয়ে ছিলেন৷ স্বয়ং আমজাদ আলি বলেছিলেন, “রমা বেশ গুছিয়ে পিটিশনটা করেছে৷” ওই সময় আশা করেছিলাম, সব কর্মী সংগঠন এবার এই মামলায় যুক্ত হবেন, কারণ শিয়রে বিপদ৷ কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি৷ বাস্তবে মামলার সঙ্গে যুক্ত ৩টি সংগঠন বাদে কোনও সংগঠনই সরাসরি এই মামলা বা এ সংক্রান্ত অন্য মামলায় অংশ হতে চাননি৷ মাননীয় প্রধান বিচারপতির বেঞ্চ এই মামলা খারিজ করে দেন৷ মামলা থেকে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে সরিয়ে দেওয়ার একটা চক্রান্ত হয়৷ সময়মত খবর পেয়ে, আদালত কর্মীদের সহায়তায় সে চক্রান্ত রুখে দিতে সফল হই৷ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমজাদ আলি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন—এই গুজব ছড়িয়ে তাঁর বিরুদ্ধে সমাজমাধ্যমে পরিকল্পিত ভাবে প্রকাশ অযোগ্য ভাষায় কুৎসা করতে শুরু করে কিছু না-মানুষ৷ লেখা হয়, আমজাদ আলি ডিএ মামলাটা তৃণমূলের স্বার্থে নষ্ট করে দেবেন৷ কুৎসার মাত্রা এমন স্তরে পৌঁছায় যে বর্ষীয়ান আইনজীবী স্বেচ্ছায় মামলা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন৷ কুৎসাকারীদের উদ্দেশ্য সফল হয়৷ কিন্তু ডিএ মামলা কর্মীপক্ষের এমন একজন আইনজীবীকে হারায়, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম, অসাধারণ মেধা, অননুকরণীয় সওয়ালে এবং সর্বোপরি একজন প্রকৃত কর্মীদরদীর ভূমিকায় আমাদের পাঁচ পাঁচটি ‘জয়’ উপহার দিয়েছেন,ষষ্ঠ ‘জয়’-এর ভিত্তিটা তৈরি করে দিয়েছেন৷ আরো অনেক প্রয়াস হয়েছে মামলার ক্ষতি করার৷ আমাদের রসদ যোগানে প্রতিবন্ধকতা তৈরির লক্ষ্যে, মামলার জন্য ১০ টাকা করে অনুদান প্রার্থনার আবেদন সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়৷ আমরা মিডিয়ায় ঘোষণা করতে বাধ্য হই, “সুপ্রিম কোর্টে মামলা চলছে, বিপুল খরচ, মাত্র ১০ টাকার ভিক্ষা পাঠিয়ে ‘লড়াই’টাকে অসম্মান করবেন না৷ ৩১ আগস্ট, ২০১৮ রায় হল, “DA is a legally enforceable right of the employees.” ২০ মে,২০২২ রায় হল,”DA is a legally enforceable fundamental right of the Employees.” এই রায়ের বিরুদ্ধে সরকার সুপ্রিম কোর্টে এসএলপি দাখিল করেছেন৷ ২০২২ সালের ২৮-এ নভেম্বর থেকে ২৪ মার্চ, ২০২৫ পর্যন্ত মামলা ‘তারিখ-পে-তারিখ’ সংস্কৃতির খপ্পরে পড়েছে৷ যে কোনও কারণে হোক, জাস্টিস দীনেশ মাহেশ্বরী এবং জাস্টিস হৃষিকেশ রায়ের বেঞ্চ মামলা শুনতেই চাননি৷ যদিও এই সময় ১টি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন জাস্টিস দীনেশ মাহেশ্বরীর বেঞ্চ, “২০১৮ সালে রায় (৩১ আগস্ট কলকাতা হাইকোর্টের রায়, DA is a legally enforceable right of the Employees) হয়েছে, যে রায় রাজ্য সরকার আজও চ্যালেঞ্জ করেনি, উল্টে সেই রায়ের প্রেক্ষিতে ওই হাইকোর্টে রিভিউ পিটিশন করে রায়কে legality দিয়ে দিয়েছে রাজ্য, এতদিন পরে এসএলপি কেন?” জাস্টিস দীপঙ্কর দত্ত সমাজমাধ্যমে কর্মীদের একাংশের অতি সক্রিয়তার মত অজুহাত দেখিয়ে মামলা থেকে সরে গেলেন৷ গত ১৪ এবং ১৬ মে, ২০২৫ জাস্টিস সঞ্জয় কারোল এবং সন্দীপ মেহতার বেঞ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলা শুনলেন৷ এই বেঞ্চ যে অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশ দিলেন তার ১ নম্বর অনুচ্ছেদ, “We are of the considered view that the prtitioner–State should release at least 25% of the amount due and payable to all the Employees in terms of impungned judgement dt.22.05.2022 passed by the High Court at Calcutta in WPST No. 102/2020 titled “The State of W.B. and ors–vs–Confederation Of State Govt. Employees,WB and ors.” and order dt.22.09.2022 in RVW No.159/2022 dt.22.09.2022 in CAN No.1/2022, wihin a period of six weeks from today.”

নির্দেশের এই অংশে কলকাতা হাইকোর্টের গত২২.০৫.২০২২ তারিখের রায়ের স্পষ্ট মান্যতা রয়েছে৷ ২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে,”—Whether or not the right to receive DA is a fundamental right is an issue,amongst others, this Court is called upon to consider.” নির্দেশের এই অংশ থেকে স্পষ্ট, সুপ্রিম কোর্টের ‘zone of consideration’-এ আছে ডিএ কর্মীদের ‘fundamental right’ কিনা৷ অর্থাৎ, “DA is a legally enforceable right of the Employees”— এই রায় সুপ্রিম কোর্টের ‘zone of consideration’-এ নেই৷ তার মানে এই রায় সুপ্রিম মান্যতা অর্জন করেছে৷ খুব বেশি হলে, আমাদের ‘fundamental right’ শব্দযুগলের সঙ্গে compromise করলেও করতে হতে পারে৷ অনেকের প্রশ্ন সরকার এই নির্দেশ না মানায় আমরা যে আদালত অবমাননার মামলা করেছিলাম, সেই মামলার কি হল? এখনো ৩টি রেসপন্ডেন্ট সংগঠনের করা আদালত অবমাননার মামলা সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে ‘pending’ হিসাবে দেখান আছে৷ কবে শুনানি হবে বা আদৌ হবে কিনা— এ সম্পর্কে কোনও তথ্য নেই৷ যখন মূল মামলার শুনানি আটকে থাকে, তখন মামলার সঙ্গে যুক্ত ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষকে সাময়িক রিলিফ দেওয়ার জন্য অন্তবর্তী আদেশে বকেয়া ডিএ-র ২৫% দেওয়ার কথা বলেছিলেন আদালত৷ যখন মূল মামলার শুনানি শুরু হয়ে গেছে, তখন অন্তর্বর্তী নির্দেশ, সম্ভবত, গুরুত্ব হারিয়েছে৷ গত ৪,৫,৬,৭ আগস্ট জাস্টিস সঞ্জয় কারোল ও জাস্টিস পি কে মিশ্রের বেঞ্চ মূল মামলার শুনানি করেন৷ সুপ্রিম কোর্টে অন্য সব মামলার শুনানি স্থগিত করে ডিএ মামলার এই ম্যারাথন শুনানি কার্যত নজিরবিহীন৷ এই বেঞ্চ যে মামলাটিকে গুরুত্ব দিয়েছেন এবং দ্রুত শেষ করতে চাইছেন, তা স্পষ্ট৷ সরকার পক্ষের সাবমিশন শেষ হওয়ার পর কর্মীপক্ষের হয়ে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য যখন সওয়াল করতে উঠলেন, জাস্টিস সঞ্জয় কারোল বললেন, “Mr. Bhattacharyya, it is your baby. You know better. We are with your baby.” স্যাটে মামলার শুরু থেকে সুপ্রিম কোর্টে সর্বমোট ২৮টি শুনানির সবকটিতে যে ২ সিনিয়র অ্যাডভোকেট প্রতিদিন ছিলেন, তাঁরা হলেন সর্দার আমজাদ আলি (সেপ্টেম্বর–২০২১ পর্যন্ত) এবং বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য( মামলায় যুক্ত হওয়ার পর থেকে)৷ ফলে, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য ডিএ মামলার নাড়ি, নক্ষত্র সব জানেন৷ বিকাশ বাবু সুপ্রিম কোর্টের ২৮টি শুনানির দিনের ২৫টিতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন, ৩ দিন শারীরিক কারণে অন-লাইনে ছিলেন৷ আমাদের অন্য সিনিয়র অ্যাডভোকেট রইফ রউম সুপ্রিম কোর্টে প্রতিটা শুনানিতে থাকলেও, স্যাটে ও হাইকোর্টে ছিলেন না৷

ফলে, আক্ষরিক অর্থে, ডিএ মামলা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের ‘baby’৷ ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ জাস্টিস সঞ্জয় কারোল ও পি কে মিশ্রের বেঞ্চ যে নির্দেশ দেন তার ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, “Let the petitioners file their fresh written submissions, comprehensive in nature, dealing with all aspects argued before us,within a period of two weeks. Respondents shall comprehensively respond to the same, within a period of one week.” নির্দেশ অনুসারে রাজ্য সরকার ১০৭ পাতার ‘written submission’ জমা দেন৷ এই ধরনের মামলায় রায় তৈরিতে সহায়তার প্রয়োজনে সব পক্ষকে ‘written submission’ দিতে বলা হয়, তা সংক্ষিপ্ত আকারের হয়৷ ১০৭ পাতার ‘written submission’ বেশ অস্বাভাবিক৷ এই সাবমিশনে সরকারপক্ষ স্বীকার করে নিয়েছেন ভারতের ২৮টি রাজ্য এবং ৭টি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলের মধ্যে ১৬টি রাজ্য ও ৭টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল সরকার AICPI অনুসারে কর্মীদের ডিএ দেন৷ যে ১২টি রাজ্য AICPI অনুসারে ডিএ দেন না বলে অভিমত রাজ্য সরকারের, তার মধ্যে সিকিম- ৫৩%, ছত্তিশগড়-৫৫% (রাজ্য ৫৩%-এর ভুল তথ্য দিয়েছেন), মেঘালয়-৪৯%, কর্ণাটক-৪২.৫০%, মণিপুর ও মিজোরাম ৩৯% হারে ডিএ দিচ্ছে, অর্থাৎ এই ৬টি রাজ্য কম বেশি AICPI অনুসারেই ডিএ দিচ্ছে, কিন্তু কিছুটা পিছিয়ে আছে মাত্র৷ বাকি ৫টি রাজ্য ৩০%-এর বেশি হারে ডিএ দিচ্ছে৷ কেরলের বেতন কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ ভিন্ন, ডিএ প্রদানের নিজস্ব মান্যতাপ্রাপ্ত যুক্তিগ্রাহ্য সূচক রয়েছে৷ তাই অন্য রাজ্যের সঙ্গে কেরলের তুলনা চলে না৷ পশ্চিমবঙ্গে ডিএ মাত্র ১৮%৷

এই তথ্য রাজ্য সরকারের পক্ষে লজ্জার৷ সুপ্রিম কোর্টে এই ‘লজ্জা’র তথ্য তুলে ধরার জন্য রাজ্যের আইনজীবীরা ধন্যবাদার্হ৷ কিন্তু সংবিধানের ৩০৯ নম্বর ধারা অনুসারে কেন্দ্র/অন্য রাজ্য কত ডিএ দেয় তা পশ্চিমবঙ্গের কর্মীদের ডিএ-র মামলায় অপ্রাসঙ্গিক৷ কপিল সিব্বালজি ২৮টি রাজ্য সরকারকে এই মামলায় যুক্ত করে মামলাটিকে অনন্তকালের জন্য বিলম্বিত করতে চেয়েছিলেন যা আদালত খারিজ করে দিয়েছে৷ বাকি সব চর্বিতচর্বন, যে বিষয়গুলি স্যাট, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে ইতিমধ্যেই খারিজ হয়ে গিয়েছে৷ কনফেডারেশনের পক্ষ থেকে আমরা ১১ পাতার সাবমিশন জমা দিয়েছি। সুপ্রিম কোর্টে গত ১৪, ১৬ মে, ৪, ৫, ৬, ৭ আগস্ট এবং ৮ সেপ্টেম্বর,২০২৫ মাননীয় বিচারপতি সঞ্জয় কারোল, সন্দীপ মেহতা এবং পি কে মিশ্র যে সব পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা আমাদের দাবির আইনগ্রাহ্যতার পক্ষে৷ সরকার পক্ষ যুক্তি, তথ্য, আইন তুলে ধরে আমাদের দাবির আইনগ্রাহ্যতার দাবি উড়িয়ে দিতে ব্যর্থ৷ সুপ্রিম কোর্টে ‘on merit’ বিচার হবে ধরে নিয়ে আমরা বলতেই পারি, স্যাট, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট (অন্তর্বর্তী নির্দেশ) মিলিয়ে সাত সাতটি ‘জয়’ আমরা পেয়েছি, অষ্টম এবং অন্তিম ‘জয়’ শুধু সময়ের অপেক্ষা৷

Advertisement