• facebook
  • twitter
Thursday, 13 February, 2025

গান্ধীকে আমরা কোনোদিন বুঝতে চেষ্টা করিনি

রামচন্দ্র গুহ তাঁর গান্ধী জীবনীতে এক আশ্চর্য ঘটনার কথা উল্লেখ করেন

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট, দেশ স্বাধীন হওয়ার দিন পাঁচেক আগে, অর্থাৎ মৃত্যুর মাস পাঁচেক আগে মহাত্মা গান্ধী ‘হরিজন’ পত্রিকায় লিখছেন “সনাতন হিন্দু ধর্ম কূপমণ্ডুক নয়, তার বিস্তার সাগরের মত। যে নামেই ডাকা হোক সে সকল মানবজাতির সম্পদ।” গান্ধী একথা বলেছেন যখন দেশ ঘৃণা ও বিদ্বেষে ভেঙে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাচ্ছে।

তিন দশক আগে সগর্বে নিজেদের ‘হিন্দু’ বলে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। হিন্দু শব্দটি নিয়ে পরবর্তীকালে খানিক সমস্যায় পড়ে ‘সনাতন ধর্ম’ নামক একটি শব্দ উত্থাপন করা হল। আসলে হিন্দু ঠিক কী বা কারা এ নিয়ে সমাজে বিতর্ক আছে। ‘হিন্দু’ শব্দটি যে হাজার হাজার বছরের পুরাতন তা নয়। ৫১৫ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ পারস্যের রাজা দরায়ুস সিন্ধু উপত্যকাকে নিজের সাম্রাজ্যে যুক্ত করলে সিন্ধু শব্দটি ফার্সি ভাষায় হিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মোগল আমলে সেই স্থানটি হয়ে গিয়েছিল হিন্দুস্তান। উনবিংশ শতাব্দীতে হিন্দু শব্দটি অন্যদের থেকে – অর্থাৎ মুসলমান, খ্রিস্টান প্রভৃতি থেকে তফাত করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। বৃহত্তর অর্থে এই হিন্দুর মধ্যেই বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদিকে ভরে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। ইতিমধ্যে সমাজে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ঢেউ উঠেছে। হিন্দু বর্ণ ব্যবস্থার প্রধান বিরোধী ভীমরাও আম্বেদকর হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিয়ে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছেন এবং স্পষ্ট বলেছেন, যে এটি হিন্দুধর্মের কোন উপশাখা নয়। পরবর্তীকালে নব্য বৌদ্ধরা বৌদ্ধধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক একটি দর্শন হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ফলে যাঁরা হিন্দুধর্ম নিয়ে গর্বিত হচ্ছিলেন, তাঁদের নতুন একটি নাম আমদানি করতে হয়েছে, সেটি হল সনাতন ধর্ম।

গান্ধীর দর্শন, সত্য এবং অহিংসা যার ভিত্তি, তার সাথে কোনো ধর্মমতের সংঘাতের অবকাশ নেই। হিন্দুধর্মের প্রবল ব্যাপ্তি এবং ধারণক্ষমতা, যা শক হুন দল পাঠান মোগলকে এক দেহে নিতে পারে, হয়ত বা তা খণ্ডন করতেই উগ্র জাতীয়তাবাদী সহিংস বিদ্বেষমূলক সীমায়িত ধর্ম হিসাবে সনাতন ধর্মকে তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা। এটি এক ধরনের বিবর্তন। গান্ধী এখানেও বিপ্রতীপে।

সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি হল বর্ণব্যবস্থা এবং এই বর্ণব্যবস্থার প্রতি সমর্থনের কারণে গান্ধী তাঁর মহত্ত্ব সত্ত্বেও বারবার প্রশ্নের মুখে পড়েছেন তাঁর সময়ে এবং আধুনিককালেও। বর্ণাশ্রমের শ্রমবিভাগকে তিনি অস্বীকার করেননি, তার পক্ষে কথা বলেছেন। এই শ্রমবিভাগকে আম্বেদকর বলেছেন শ্রমিকের বিভাগ, যা জন্ম থেকে নির্ধারিত। মোহনদাস করমচাঁদের জন্ম হয়েছিল অত্যন্ত গোঁড়া হিন্দু একটি পরিবারে। পরম বৈষ্ণব হলেও সেখানে জাতপাত মানা হত, অস্পৃশ্যতাও ছিল।

তিনি ধার্মিক রক্ষণশীল এবং সামাজিক ক্ষেত্রে প্রায় সমস্ত প্রগতিশীল চিন্তার বিরোধী ছিলেন। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে দু-চার কথা বললেও জাতপাতের সঙ্গে প্রায় আপসই করে গেছেন সারাজীবন। মননের গভীরে তিনি বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির ঘোর বিরোধী। পরবর্তীকালে তাঁর জীবনের অন্যতম ব্রত হয়েছিল অস্পৃশ্যতা ধ্বংস করা। সবর্ণদের মধ্য থেকে গান্ধীর মত এমন প্রবল উদ্যোগ আর কেউ নিয়েছেন বলে জানা যায় না। গান্ধীর কারণে উচ্চবর্ণীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ একরকম বাধ্য হতেন শহরের প্রান্তে থাকা হরিজন বস্তিতে আসতে।

আমরা জানি, তাঁর আশ্রমে এই জাতপাত ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য তাঁকে অনেক লড়াই করতে হয়েছে, এমনকি নিজের পরিবারের বিরুদ্ধেও। সেই গল্পটি আমরা শুনেছি, যেখানে আশ্রমের মানুষজন গান্ধীকে বলেছিলেন অস্পৃশ্য পরিবেশকের কাছ থেকে তাঁরা অন্ন গ্রহণ করতে অপারগ। গান্ধী সেই পরিবেশককে সরিয়ে দেন। পরেরদিন তাকে দেখতে না পেয়ে খুশি হওয়া আশ্রমিকরা জানতে চেয়েছিলেন সে কোথায় গেল। গান্ধী তখন উত্তর দিয়েছিলেন, এখন থেকে পরিবেশন না করে সে রান্না করবে। এই জোর দেখানো গান্ধীর পক্ষেই সম্ভব ছিল। সকলেরই স্মরণে আছে, শান্তিনিকেতনেও ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য বর্ণের খাওয়ার ব্যবস্থা পৃথক ছিল। নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ শিক্ষকরা ব্রাহ্মণ ছাত্রদের সঙ্গে আলাদা বসে খেতেন। রবীন্দ্রনাথ যুক্তি দিয়ে এই অভ্যাস খণ্ডন করতে পারেননি। খিলাফত আন্দোলনের সময় গান্ধী যখন আলি ভাইদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে এলেন এবং দুই ভাইকে পাশে বসিয়ে সবার সাথে পংক্তিভোজন করলেন, তখন এক লহমায় এই ভেদাভেদ দূর হয়ে গেল। গান্ধীর সনাতন হিন্দুধর্ম ঐতিহাসিক নয়, গান্ধী হিন্দুধর্মের অস্পৃশ্যতার ইতিহাসকে অস্বীকার করেছেন।

সনাতন হিন্দুধর্মের সঙ্গে রাজনীতির মিশেলের অন্যতম কর্তা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদর সাভারকর। গান্ধীর কঠোর সমালোচক। অনেকের মতে গান্ধীভাবনার আকর পুস্তক ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ যে দুজনের কথোপকথনের মাধ্যমে গান্ধীর মতাদর্শ উঠে আসছে, তার একজন সাভারকর। গান্ধীর সাথে তাঁর অবস্থান দ্বান্দ্বিক। গীতা সাভারকরের কাছে ধর্মযুদ্ধের উদ্গাতা, যেখানে হিংসায় কোনো দোষ নেই, বরং তা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু গান্ধী গীতার দ্বন্দ্বকে দেখেন মানসিক স্তরে, শুভ-অশুভের দোলাচলে। কোনো অবস্থাতেই গান্ধী কাউকে আঘাত করবেন না। সাভারকর এই চূড়ান্ত অহিংসার বিরোধী। ভারতের ইতিহাসে সাভারকরের কাছে গৌরবের অধ্যায় সেই অংশগুলি, যেখানে হিন্দু রাজারা শক্তি প্রয়োগ করে ‘বিদেশী’-দের ঠেকিয়েছে। এই সনাতন হিন্দুধর্মে বিধর্মীর বিরুদ্ধে হিংসায় উন্মত্ত হওয়ায় দোষ নেই। তাই সাভারকরের ভারতীয় ইতিহাসে বহিরাগত না হয়েও মহামতি অশোকের স্থান নেই। তিনি পুষ্যমিত্র শুঙ্গের বৌদ্ধবিদ্বেষের পক্ষে, কারণ বৌদ্ধ রাজা রাষ্ট্র পরিচালনায় অযোগ্য।‌ অশোকের বৌদ্ধধর্ম তাঁর মতে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর, কারণ অহিংসার প্রচার সকলকে শক্তিহীন করে দেয়। ১৯৪০ সালে হিন্দু মহাসভার মাদুরাই অধিবেশনে সাভারকর বলছেন, সত্যাগ্রহ নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য নয়, কারণ জীবন বিপন্ন হলে অহিংসা নিরর্থক। আপেক্ষিক অহিংসার হয়ত গুণ আছে, কিন্তু চূড়ান্ত অহিংসা অপরাধ। তাই হিন্দুদের অস্ত্রশিক্ষা প্রয়োজন। গান্ধীর অহিংসা কি চূড়ান্ত? হয়ত সেটাই চাওয়া, কিন্তু গান্ধী বলেছেন দুর্বলতা ও হিংসার মধ্যে হিংসাকেই হয়ত শেষপর্যন্ত বাছতে হয়। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই গান্ধী হিংসাকে লালন করেন না। হিংস্র হওয়ার তালিম দিতে বলেন না।

আজ ২০২৪ সালে সেই তাঁকে সামনে রেখেই সারা ভারতের প্রগতিপন্থী মানুষ এবং সংগঠন ধর্মীয় কট্টরতা, ঘৃণাবিদ্বেষ, জাতিবাদের ভয়ঙ্কর মশলা, দেশজোড়া নারী নির্যাতনের মাতন, ধর্ষকদের গৈরিক নৃত্যনাট্য, এবং আদানি আম্বানিদের চুরি জোচ্চুরি ডাকাতির বিরুদ্ধে লড়াইতে নামছে। রাজ্যে রাজ্যে। কেননা, নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির দল ও শাসন এই জায়গায় আজকে দেশকে এনে দাঁড় করিয়েছে। এরা দেখাচ্ছে, কর্পোরেট বানিয়ারাজ এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের প্রয়োজনে আরও কত পেছনে, আরও কত অন্ধকারে দেশকে টেনে নামানো যায়।

যে গান্ধীকে গডসে এবং আরএসএস হিন্দুদের এক নম্বর শত্রু বলে দাগিয়ে দেন, সেই গান্ধী কিন্তু আজীবন হিন্দুসমাজে প্রোথিত থেকেছেন, নিজে ধর্মভীরু থেকেছেন, নিজেকে বার বার সনাতন হিন্দুত্বে বিশ্বাসী বলেছেন। এত বেশি বলেছেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে তথাকথিত সেকুলার মানুষরা— যাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতা, চিন্তাবিদ বা ইতিহাসবিদরা আছেন, এক দিকে লিবারালরা, অন্য দিকে মার্ক্সবাদীরা আছেন— এঁরা সবাই গান্ধীর সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতে চেয়েছেন। তাঁদের চোখে গান্ধী ‘বড় বেশি রকম হিন্দু’।

শুভের জন্য ধর্ম, আর ভক্তির জন্য ধর্ম, এই সীমারেখাটা গান্ধী নিজে বুঝতে পারতেন, কিন্তু সাধারণ ভাবে সব মানুষের কি পারার কথা সেটা? এ দেশের বিস্তৃত ধর্মমূর্ছিত সমাজে রামরাজ্য থেকে রামযাত্রা, সব তো একমাত্রিক অর্থেই বোঝা হয়। আর তাই গান্ধী রামভক্ত কি না, হলে কেমন ধরনের, সব গুলিয়ে দেওয়া হয়। যে সূক্ষ্মতার সঙ্গে তিনি হিন্দু, সনাতন, রাম এই সব ভাবনা বুঝতেন, আমজনতা তা পারে না, পারতে চায় না। তাই তাঁর কাজের বহিরঙ্গটিই জনচক্ষে ধরা পড়ে, অন্তরঙ্গ ভাবনা যায় হারিয়ে। এমনই হারিয়ে যায় যে, তাঁকেই শত্রু বানিয়ে হত্যা করা যায়।

গান্ধীকে আমরা কোনদিন বুঝতে চেষ্টা করিনি। জাতির জনক বলে পুজো করেছি নিশ্চয়ই। কিন্তু তিনি কী চেয়েছেন আমাদের কাছে। এই জরাজীর্ণ সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন চেয়েছেন। মানুষের মনের পরিবর্তন চেয়েছেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে হিংসার নৈরাজ্যের প্রাণহীন প্রতিযোগিতার অবসান চেয়েছেন। ধনীর ধনের অহঙ্কারের অবসান চেয়েছেন। উৎপাদনের কথা উঠলেই সমবন্টনের প্রস্তাব করেছেন। ধর্মের প্রশ্ন উঠলে সত্য তাঁর একমাত্র ঈশ্বর বার বার ঘোষণা করেছেন। যে ধর্মে মানুষের কল্যাণ নেই সে ধর্ম তাঁর হতে পারে না। শিক্ষার কথা উঠলেই ‘জাতীয় শিক্ষা’ তিনি চেয়েছেন। বিদেশী সংস্কৃতি নির্ভর ইংরেজি শিক্ষা আমাদের কোন হিতসাধন করতে পারে না। এই ছিল গান্ধীর আজীবনের বিশ্বাস।

তাঁর সৌভাগ্যই বলতে হবে, জাতীয় আন্দোলনের মধ্যে হিন্দু ধর্ম নিয়ে অনেক বাড়াবাড়ি করা সত্ত্বেও তিনি যে মনের গভীরে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী ছিলেন না, হিন্দুত্ববাদী ঘাতকদের হাতে নৃশংস মৃত্যুতে সেটা প্রমাণ করার সুযোগ পেলেন। সামনে থেকে দামোদরদাস-পূজ্য নাথুরাম আর গোপাল গডসে এবং পেছন থেকে দামোদরদাসের চিন্তাগুরু সাভারকর মিলেমিশে মোহনদাসকে শুধুই মারেনি, তাঁর সম্মানকে বাঁচিয়েও দিয়েছে।

রামচন্দ্র গুহ তাঁর গান্ধী জীবনীতে এক আশ্চর্য ঘটনার কথা উল্লেখ করেন। গান্ধীহত্যার কিছুদিন পরে দক্ষিণ ভারতের অপেক্ষাকৃত ছোট একটি শহরে তাঁর স্মরণসভায় মুসলিম লীগের একজন বলেছিলেন “মহাত্মা গান্ধী বিংশ শতাব্দীর খ্রিস্ট, যিনি আমাদের মত মুসলমানের জন্য প্রাণ দিলেন।” এই সেই সনাতন ধর্ম যেখানে সত্যই ঈশ্বর এবং অহিংসা পর্বতের মত শাশ্বত।গান্ধীর গোটা জীবন জুড়ে সেই সম্পদ পরিলক্ষিত। তার নাম ভালবাসা। আজকের ভারতে বুলডোজার চালিয়েও তাঁকে যে শেষপর্যন্ত ধ্বংস করা যাচ্ছে না, তার কারণ তিনিই সনাতন।