• facebook
  • twitter
Thursday, 14 August, 2025

এবারের কান উৎসব ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি

আর ক’ঘণ্টা বাদেই (আজ সন্ধ্যায়) কানটন, ম্যারিয়ট, ক্যানবেরা, মার্তিনেজ হোটেল ও কান উপসাগরের বিচ সেজে উঠবে হলিউডি গ্ল্যামারের চোখ ধাঁধানো বিচ্ছুরণে। সঙ্গে থাকবে ছবিও।

ফাইল চিত্র

নির্মল ধর

কান ফিল্ম উৎসবের সঙ্গে হলিউডের আশনাই নতুন নয়। হলিউডি তারকারা প্রতি বছরই কোনও না কোনও প্রসাধনীর ‘মুখ ও মুখোশ’ হয়ে পালাসের লাল কার্পেটে মার্জার গতিতে হেঁটে কানকে যেন ধন্য করেন। প্রাপ্তি হিসেবে কান-এ পুরস্কৃত ছবিগুলো ‘অস্কার’ পুরস্কারেও বিভিন্ন বিভাগে শুধু মনোনয়ন পায় না, সম্মান জেতেও। সাম্প্রতিক উদাহরণ, গত বছরই শন্ বেকারের ‘আনোরা’ পাম দ্য ওর পাওয়ার পর সেরা ছবির পুরস্কার জিতল অস্কার অনুষ্ঠানে। তার আগে কোরিয়ার ছবি বং জন হু’র ‘প্যারাসাইটিস’ কান-এ পাম দ্য ওর এবং অস্কার-এ সেরা ছবি সহ একাধিক পুরস্কার এনেছে। বেশ ক’বছর আগে কোহন ভাইদের (জোয়েল ও ইথান) ছবি ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ডমেন’-এর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছিল। কান-এর সেরা এবং অস্কার-এও সেরা দ্বিমুকুট উঠেছিল ওই ছবির মাথায়!

সুতরাং কান্ উৎসব এখন হলিউডি ফিল্ম ব্যবসায়ীদের কাছে অনেকটাই অস্কারের ড্রেস রিহার্সালের মতো। আবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরে ভেনিসের লিডোতে আলফোনসো কুয়ারোঁর ‘রোমা’ ছবির সোনার সিংহ প্রাপ্তির ক’মাস বাদেই তাঁর হাতেও তুলে দিয়েছিল অস্কার মূর্তি। এমনকি ছবির নতুন নায়িকা ইয়ালিৎজা আপারিচিও’র হাতে উঠেছিল সেরা অভিনেত্রীর অস্কার সম্মান। সুতরাং ইউরোপের তিনটি বড় মাপ ও মানের ফিল্ম উৎসব বার্লিন, কান এবং ভেনিসের প্রতিই নজর থাকে অস্কার আয়োজকদেরও। এই সত্যটা কেউই অস্বীকার করবে না।

আর ক’ঘণ্টা বাদেই (আজ সন্ধ্যায়) কানটন, ম্যারিয়ট, ক্যানবেরা, মার্তিনেজ হোটেল ও কান উপসাগরের বিচ সেজে উঠবে হলিউডি গ্ল্যামারের চোখ ধাঁধানো বিচ্ছুরণে। সঙ্গে থাকবে ছবিও। এ বছর ’পাম দ্য ওর’-এর জন্য লড়াইয়ে নামছে মোট উনিশটি ছবি। যার মধ্যে থাকছে ওয়েস এন্ডারসনের ব্ল্যাক কমেডি ‘দ্য ফোনোসিয়ান স্কিম’ (টম হাংকস –স্কারলেট জনসন), অ্যারি অ্যাস্টরের সমসাময়িক ওয়েসটার্ন ব্ল্যাক কমেডি — জোয়াকিম ফোনিক্স ও এম্মা স্টোন অভিনীত ‘এডিংটন’, মহিলা পরিচালক কেইলি রাইথহার্ডের একটু ধীরগতির ক্রাইম থ্রিলার ‘দ্য মাস্টারমাইন্ড’। প্রতিযোগিতায় না থেকেও আস্ছে টম ক্রুজের নতুন ব্লক বাস্টার ‘মিশন ইম্পসিবল – দ্য ফাইনাল রেকনিং’, কেভিন কস্টনারের ব্যবসায়িক ফর্মুলায় বানানো ওয়েস্টার্ন হরাইজন : অ্যান আমেরিকান সাগা’। অবশ্য স্পাইক লী’র ছবি ‘হায়েস্ট টু লোয়েস্ট’ নামের ছবিটি প্রতিযোগিতা বিভাগেই থাকছে। ছবির মূল অভিনেতা ড্যানজেল ওয়াশিংটনও মার্জার সরণিতে বেড়াবেন। যদিও ছবিটি জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোশাওয়ার ‘হাই অ্যান্ড লো’ (১৯৬৩) ছবির প্রতি নাকি এক ধরনের ট্রিবিউট! অথচ বলা হচ্ছে ছবিটা ক্রাইম থ্রিলার। দেখা যাবে কেমন সম্মান জানালেন তরুণ লী প্রবীণ জাপানী মায়েন্ত্রোকে! মহিলা পরিচালকের ছবি এবছর সাকুল্যে ছয়টি। কেইলি ছাড়া জায়গা পেয়েছেন ফরাসি জুলিয়া দ্যুক্যোরন্যু।

তাঁর ‘অ্যালফা’ নামের ছবিতে অভিনয় করেছেন দুই প্যারিসবাসী ইরানি শিল্পী গোলাশেফতে ফরহানি ও তাহার রহিম। আমেরিকান পরিচালক রিচার্ড লিংকলেটার— সেই ষাটের দশকের ফরাসি কাল্ট ফিল্ম জঁ লুক গোদারের ‘ব্রেথলেস’ নির্মাণের ইতিহাস নিয়ে বানিয়েছেন ফরাসি সিনেমা ‘ন্যুভেল ভগ’। এই ছবিতে গোদার, ছবির দুই প্রধান শিল্পী জঁ পল বেলেমোঁদা এবং জঁ সিবর্গ-এর চরিত্রে দেখা যাবে তিন নতুন মুখ যথাক্রমে গুইলাউমে (গোদার), অউদ্রে দ্যুলি (বেলমেঁদো) এবং জোয়ি দেউৎসকে (জঁ সিবর্গ)। এবং প্রতিযোগিতা বিভাগে আরও একটি ছবি সবার নজর কাড়বে জাফর পানাহির ‘এ সিম্পল অ্যাক্সিডেন্ট’। যদিও বলা হচ্ছে ছবিটি ডকুমেন্টারি, অর্থাৎ তথ্যচিত্র, কিন্তু উৎসবের অন্দরমহলের খবর— ছবির জন্য সেরা অভিনেতা, অভিনেত্রী এবং পরিচালকের পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়েও চলছে আলোচনা। এবং পানাহির তথ্যচিত্র নেহাৎ সরল সহজ-চিত্র হবে না! উৎসবের অন্যতম কর্তা থিয়ের ফের্ম্যো সব ছবি সম্পর্কেই অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে এখনও আছেন!

কান উৎসবের দ্বিতীয় সেরা বিভাগটি হল ‘ক্রিটিকস উইক’। ফরাসি সমালোচকরাই ছবিগুলো বাছেন। পরিচালকের একমাত্র প্রথম বা দ্বিতীয় ছবি এখানে জায়গা পায়। এবার পেয়েছে দশটি ছবি। বিশ্ব সিনেমায় ‘নতুন মুখ’ খুঁজতে চাইলে এই বিভাগটির দিকে নজর রাখা জরুরি! এবার এখানে ঠাঁই হয়েছে তাইওয়ানের পরিচালক শিহ-চিং-সোউ, যিনি বেশ ক’বছর ধরেই ‘আনোরা’র পরিচালক শন বেকারের সহযোগী। শন্ সিহা-র এই ছবির প্রযোজকও। থাইল্যান্ড থেকে এবার অপিচ্যাৎপং বীরশেথাকুলের পরিবর্তে আসছে রাতচাপুম বুনবানচাচোক। তাঁর দ্বিতীয় ফিচার ছবি ‘এ হাউজফুল ঘোস্ট’। প্রয়াত স্ত্রীর আত্মা শ্রাদ্ধের দিনেই নিজের বাড়িতে উপস্থিত হয় বাড়ির ভ্যাকুয়ম ক্লিনারের চেহারা নিয়ে। স্বামীর সঙ্গে সেই প্রেতিনীর প্রেম নিয়ে আধিভৌতিক ঢংয়ে এক সুর-রিয়্যাল গল্প! এই বিভাগেই কিন্তু দেখার মতো আারও দু’টি ছবি হচ্ছে চেচেন পরিচালকের (ডেনি ওমুর) ‘ইমাগো’, বেলজিয়ামের (লরা ওয়ান্ডেল) ‘ড্যান্ডিলিয়নস ওডিসি’।

আর ‘এ সার্টেন রিগার্ড’ সেকশনে থাকছে একমাত্র ভারতীয় ছবি নীরজ খাওয়ানের ‘হোমবাউন্ড’! ক’বছর আগেই নীরজের প্রথম ছবি ‘মশান’ একই বিভাগে দেখানো হয়েছিল। গত বছর এই বিভাগেই পায়েল কাপাডিয়ার ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ লাইট’ শুধু পুরস্কৃতই হয়নি, দারুণ প্রশংসিতও হয়েছিল সারা পৃথিবীজুড়ে ছোট-বড় বিভিন্ন উৎসবে। নীরজ দ্বিতীয়বার কান যাচ্ছেন ‘হোমবাউন্ড’ নিয়ে। এবারও তিনি শুধু লাল কার্পেটে হাঁটবেন, নাকি কোনও পুরস্কার নিয়ে পালার-এর মঞ্চে দাঁড়াবেন সেটার জন্যই অপেক্ষা। তবে এই বিভাগে তাঁর প্রতিযোগীর অভাব নেই! স্কারলেট জনসন (এলিনর দ্য গ্রেট), মোস্তাফা মোরাদ (আইসা কান্ট ফ্লাই), অভিনেতা হ্যারিস ডিকিনসনের ‘আর্চিন’ খুব সহজে কাউকে জায়গা ছাড়বে বলে মনে হয় না! তবে এখন ‘উৎসব’ মানেই তো ‘খেলা হবে’ টাইপ? টাকা, না রাজনীতি, নাকি অন্য কোনও নীতির খেলা!?

হাতের মুঠোয় হৃদপিণ্ড নিয়ে
ফরাসি ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা গ্রুপ। অ্যাসোসিয়েশন নামের (L’ACID) সংস্থাটি গত নয়/দশ বছর ধরেই জাঁকজমকপূর্ণ। বিশ্বজুড়ে ঝড়তোলা কান উৎসবের মূল আঙিনার পাশেই বিশ/তিরিশটি অন্যতর ভাবনার সিনেমা নিয়ে প্রায় এক সমান্তরাল উৎসবের আয়োজন করে চলেছে। এবারেও ব্যতিক্রম ঘটছে না। তবে সবচাইতে বেশি আলোচনার কেন্দ্র হতে পারে এই ‘এসিড’ বিভাগের শেষ সন্ধ্যার ছবিটি। এবং ছবিটিকে উৎসবের শেষ সন্ধ্যায় রাখার কারণও রাজনৈতিক বইকি! নাম: ‘পুট ইওর সোল ইন ইওর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক’। পরিচালক জন্মসূত্রে ইরানি হলেও প্যারিস বাসিন্দা সেপিদেহ ফারসি! তিনি তাঁর প্যালেস্টাইনি বন্ধু তরুণী ফতমা-র মাধ্যমে গত দেড় বছর ধরে প্যালেস্টাইন দেশটার গাজা শহরটিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রত্যক্ষ সামরিক মদতে ইজরায়েল প্রায় বাহান্ন শিশু সহ হাজার মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা বাস্তব চিত্র তুলে এনেছে। আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখনও কোনও মতে দাঁড়িয়ে থাকা দেড়খানা হাসপাতাল এবং প্যালেস্টাইনিদের গাজা ছাড়া করার জন্য বিধ্বংসী এক পক্ষের লড়াই চলছে। ফারসি সেই ফুটেজ সংগ্রহ করে ছবিটি তৈরি করেছেন। প্যালেস্টাইনি হামাসের একমাত্র দোষ ছিল তাঁরা এক বছর আগে অতর্কিত মিসাইল আক্রমণে ১২০০ ইজরায়েলি হত্যা করে এবং ২১৫ জন ইজরায়েলিকে পণবন্দী করে নিয়ে যায়।

আর তরুণী ফতমা গাজায় বসে করতেন কী— ক্ষতবিক্ষত গাজা শহরে বসেই ইজরায়েলি দানবিক হানার ছবি তুলতেন, আহতদের সেবা করতেন, মুর্মূষুদের আহার, জল ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন। এবং মিশর প্যালেস্টাইন সীমান্ত শহর রাফায় সোপিদেহ’র কাছে মেইল করে পাঠিয়ে দিতেন তাঁর তোলা সেইসব জীবন্ত, জ্বলন্ত বাস্তবের ‘ফুটেজ’। যা এতদিন প্রায় প্যালেস্টাইনের বাইরে আসতেও পারেনি। এবং সেগুলো জুড়ে জুড়েই সেপিদেহ বানিয়েছেন ‘পুট ইওর সোল অন ইওর হ্যান্ড অ্যান্ড ওয়াক’ নামের ছবিটি।’ কান উৎসবের ‘অ্যাসিড’ বিভাগের সিপাদেহ’র ছবিটি নির্বাচিত হয়েছে খবরটা আর শুনে যেতে পারেননি ফতেমা। ঠিক আগের দিনই ইজরায়েল তাঁর বাসস্থানে বোমা নির্বিচারে বর্ষণ করে শুধু তাঁকে নয়, ফতেমার পরিবারের উপস্থিত নয়জন সদস্যও মারা যায় তৎক্ষণাৎ। হিটলারের পর জাতিবিদ্বেষ যুদ্ধে এমন নৃশংসতা বিশ্ব আর দেখেনি। বারোশো মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে পুরো দেশটাকেই মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা এবং সেটিকে আমেরিকার জন্য ‘প্রমোদ শহর’ গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর এমন পাশবিক হিংস্র বর্বরোচিত অসম লড়াইয়ের বিরুদ্ধে এখনও সারা বিশ্ব নীরব দর্শক। দেখা যাক সেপিদেহ’র এই ছবি কান-এ মানুষের ঘৃণা নয়, চক্ষুলজ্জার পর্দাটুকু অন্তত উন্মোচন করতে পারে কিনা।

একটু আগেই ফিল্ম উৎসবে রাজনীতির কথা বলছিলাম না! সেপিদেহ ফারসি’র এই ছবি উৎসবের শুরুতে বা মধ্যপর্বে দেখালে হলিউডের ‘গোঁসা’ হতে পারে জেনেই বোধ হয় এমন ব্যবস্থা ! এই ছবিতে গাজার ধ্বংসলীলার যে ছবি দেখবেন দর্শক, সেখানে ফিল্মি শুটিংয়ের কোনও কারসাজি নেই! একেবারে গ্রাউন্ড জিরোতে দাঁড়িয়ে ফতিমার ছবি ইজরায়েল সামরিক বাহিনীর পাশবিক আক্রমণের ‘দলিল’ হয়ে থাকবে বলেই মনে করছেন সব্বাই।

এবং একই সঙ্গে ইরানি পরিচালক জাফর পানাহি’র ‘এ সিম্পল অ্যাক্সিডেন্ট’ উন্মুক্ত করবে ইরান সরকারের মুখোশ। তাই ৭৫তম কান ফিল্ম উৎসব এবার আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং ব্যবসার এক ‘মোল্টিং পট’ হতে চলেছে— তা নিয়ে কোনও দ্বিধা বা সন্দেহ নেই।

আর আগামী মার্চের অস্কার আসরে কী ঘটবে তা অনাগত ভবিষ্যতের গর্ভেই আপাতত থাক।