• facebook
  • twitter
Tuesday, 29 July, 2025

শেষ হল রোহিত-বিরাট পর্ব, একটি বিদায়ী টেস্টের সুযোগ দেওয়া যেত না দু’জনকে?

বার্ষিক চুক্তিতে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলিকে গ্রেড এ প্লাস-এ রেখেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বছরে তাঁদের ৭ কোটি টাকা করে দেবে বিসিসিআই।

শোভনলাল চক্রবর্তী

আইপিএলের মাঝেই একটি বিজ্ঞাপনে রোহিত শর্মাকে দেখা যায়, সকলকে মিউচুয়াল ফান্ড নিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। ঝুঁকি নিতে বলছেন। কিন্তু বাস্তবে ঝুঁকি নিলেন না রোহিত। আইপিএলের মাঝেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন তিনি। টেস্ট ক্রিকেটে রোহিতকে নিয়ে গত বছর ধরে লাগাতার সমালোচনা হয়েছে। শোনা যাচ্ছিল, ইংল্যান্ড সিরিজে অধিনায়কত্ব যেতে পারে তাঁর। সেই সিদ্ধান্তের আগেই টেস্ট থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। রোহিত বুঝিয়ে দিলেন, তাঁর এই সিদ্ধান্ত ‘সহি হ্যায়’। শেষটা কি এমন হওয়ার কথা ছিল? না। এক বছরও হয়নি ভারতের ক্রিকেটভক্তদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন তিনি। ১৩ বছরের খরা কেটেছিল। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। গত মার্চে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। বার বার নক আউটে গিয়ে হারার যন্ত্রণা সহ্য করতে করতে কোথাও যেন বিশ্বাসটাই চলে গিয়েছিল যে ভারত আইসিসি ট্রফি জিততে পারবে। সেই বিশ্বাসটা আবার সকলকে করতে শিখিয়েছিলেন তিনি। শুধু বিশ্বাস নয়, শুধু স্বপ্ন দেখা নয়, তাকে বাস্তবেও পরিণত করেছিলেন। ২০২৪ সালের ২৯ জুন আসমুদ্র হিমাচল আনন্দ করেছিল। সেই আনন্দের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। চার মাস আগে আরও এক বার দেশবাসীর মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন। অথচ এক বছর যেতে না যেতেই সবটা কেমন বদলে গেল। আইপিএলের মাঝেই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন তিনি।

বিশ্বকাপ জেতার পরেই অবসর নিয়েছিলেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। হাতে রইল শুধু এক দিনের আন্তর্জাতিক। যে মানুষটা ক্রিকেটভক্তদের এতটা আনন্দ দিয়েছিলেন, সেই মানুষটাই বিশ্বজয়ের পর সমালোচনায় বিদ্ধ। কারণ, অস্ট্রেলিয়া সফরে পরপর ম্যাচে ব্যার্থতা। হারের লজ্জা। সেই লজ্জা মাথায় নিয়েই টেস্ট ক্রিকেট থেকে সরে গেলেন তিনি। রোহিত গুরুনাথ শর্মা। ভারতের লাল বলের ক্রিকেটে শেষ হয়ে গেল ‘হিটম্যান’ যুগ। তবে শেষটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। মাথা উঁচু করে যাঁর ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর কথা ছিল, তিনি বিদায় জানালেন মাথা নিচু করে।

এক বছর আগের সেই দিনটা এখনও জ্বলজ্বল করে ভারতের ক্রিকেটভক্তদের মনে। হার্দিক পাণ্ডিয়া শেষ বলটা করার পরেই কভার এলাকায় দাঁড়িয়ে থাকা রোহিত হাঁটু মুড়ে বসে পড়লেন। চুমু খেলেন ঘাসে। মাঠে তিন-চার বার চাপড় মারলেন। তারপর হাঁটু মুড়েই দু’হাত তুললেন আকাশে। ততক্ষণে বাকি সতীর্থেরা এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন। ২০২৩ সালে দেশের মাটিতে যেটা করতে পারেননি সেটাই রোহিত করে দেখালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের বার্বাডোজে। বিশ্বকাপ জিতে মাঠেই পুঁতে দিলেন জাতীয় পতাকা। পিচে গিয়ে মাটি খুঁটে খেলেন। যে পিচ তাঁকে এত সম্মান দিয়েছে, সেই পিচের স্বাদ নিতে চেয়েছিলেন রোহিত। চোখে জলের পাশপাশি মুখে ছিল সেই অমলিন হাসি। হিটম্যানের হাসি। পরে বিশ্বকাপ ট্রফি নেওয়ার সময়ও লিয়োনেল মেসির কায়দায় হাঁটলেন রোহিত। জানিয়ে দিলেন, আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নিচ্ছেন। সেই ঘোষণার সময়েও তাঁর মুখে ছিল চওড়া হাসি। সেই হাসিই মিলিয়ে গেল এক বছরে। ভারতের ক্রিকেট খেলার ধরন বদলে ফেলেছিলেন রোহিত। ধোনি বারবার বলেন একটি প্রসেস-এর কথা। সেখানে হার-জিতের থেকেও খেলার ধরন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একটি নির্দিষ্ট ধরন নিয়ে এগোলে ধীরে ধীরে তা রপ্ত করা যায়। সেই প্রসেস-এর উপর জোর দিয়েছিলেন রোহিতও। ২০২৩ সালে দেশের মাটিতে এক দিনের বিশ্বকাপে তা দেখা গিয়েছে। আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলেছে ভারত। সেই ক্ষেত্রেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন রোহিত। কোনও ম্যাচে ব্যক্তিগত মাইলফলকের কথা ভাবেননি। শুরু থেকে ব্যাট চালিয়েছেন। বাকিদের জন্য ভিত তৈরি করে দিয়েছেন। কিন্তু ফাইনালে তাল কেটেছে। সেই হারের পরেও খেলার ধরন বদলাননি রোহিত। পরের বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তা দেখা গিয়েছে। রোহিতের এই ধরনটির প্রশংসা করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। তার সুফল পেয়েছেন রোহিত। খরা কাটিয়ে দেশকে দিয়েছেন বিশ্বকাপ। সেই ধরনটাই যেন কাল হয়েছে রোহিতের। আসলে ভারতের মাটিতে যে ভাবে খেলা যায়, সেই একই ভাবে যে অস্ট্রেলিয়ায় খেলা যায় না, সেটা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন রোহিত। তার খেসারত দিতে হয়েছিল। ডিফেন্সটাই যেন হারিয়ে গিয়েছিল তাঁর। বার বার শুরুতেই আউট। তার খেসারত দিতে হয়েছিল দলকেও। রোহিতকে খেলাতে বাদ পড়তে হয়েছিল শুভমন গিলকে। ব্যাটিং অর্ডারে নামতে হয়েছিল লোকেশ রাহুলকে। তার পরেও রোহিত সাফল্য পাননি।

দেওয়াল লিখন যেন দেখতে পাচ্ছিলেন রোহিত। সেই কারণে সাংবাদিক বৈঠকে নিজের খেলার সমালোচনা করছিলেন। খারাপ পারফরম্যান্সের প্রভাব পড়েছিল রোহিতের অধিনায়কত্বেও। মাঠের মধ্যে সেই হাসি-ঠাট্টা উধাও হয়ে যাচ্ছিল। বদলে আসছিল বিরক্তি। সতীর্থদের ধমক বাড়ছিল। ভুল করছিলেন রোহিত। বাড়ছিল সমালোচনা। বাড়ছিল লজ্জা। আর হয়তো নিতে পারছিলেন না তিনি। মাঝের আইপিএল সেই লজ্জা হয়তো অনেককেই ভুলিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বোঝা গেল ভোলেননি রোহিত। অস্ট্রেলিয়া সফরে কোচ গৌতম গম্ভীরকেও পাশে পাননি রোহিত। সিডনিতে শেষ টেস্টের আগে সাংবাদিক বৈঠকে গম্ভীর স্পষ্ট করেননি যে, রোহিত খেলবেন কি না। তখন দেখে মনে হচ্ছিল, রোহিত নন, গম্ভীরই দল চালাচ্ছেন। অনুশীলনেও দেখা গিয়েছিল, নিজের পরিচিত জায়গা স্লিপে ছিলেন না রোহিত। দলের সহ-অধিনায়ক জসপ্রীত বুমরাহের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলতে দেখা গিয়েছিল অজিত আগরকর ও গম্ভীরকে। ব্যাট করতেও শুরুতে নামেননি তিনি। সিডনিতে বাদই পড়তে হয়েছিল রোহিতকে। তখনই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেটা সত্যি হল চার মাস পর। টেস্ট শেষে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন ভারত অধিনায়ক। অবসর নিলেন টেস্ট থেকে। শেষ হয়ে গেল একটা যুগ। টেস্টে ৪,৩০১ রান, এক দিনের ক্রিকেটে ১১,১৬৮ রান ও টি-টোয়েন্টিতে ৪,২৩১ রান করেছেন রোহিত। তিন ফরম্যাট মিলিয়ে ১০৮টি অর্ধশতরান ও ৪৯টি শতরান করেছেন। তাঁর কৃতিত্বও কম নয়। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সর্বাধিক রানের মালিক তিনি। এক দিনের ক্রিকেটে তাঁর তিনটি দ্বিশতরান রয়েছে, যা আর কারও নেই। ৫০ ওভারের ক্রিকেটে একটি ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ২৬৪ রানও তাঁর দখলে। এক বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি পাঁচটি শতরান করেছেন রোহিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মেরেছেন। আক্ষরিক অর্থেই হিটম্যান হয়ে উঠেছেন বোরিভলির গলিতে ঠাকুমার সেলাই করা ৪৫ নম্বর গেঞ্জি পরে খেলা ছেলেটা। পরে সেই ৪৫ নম্বর জার্সি পরেই মাঠ কাঁপিয়েছেন রোহিত। তবে ব্যাটার রোহিতকেও যেন কোথাও ছাপিয়ে গিয়েছেন অধিনায়ক রোহিত। তাঁর নেতৃত্বের হাতেখড়ি মুম্বই ক্রিকেটে। অজিত আগরকর অবসর নেওয়ার পর রোহিতকে অধিনায়ক করা হয়। তার পরে আইপিএল। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সকে পাঁচ বার চ্যাম্পিয়ন করেছেন। পরে সেই রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন ধোনি। বিরাট কোহলির পরে তাই রোহিত ছাড়া আর কারও কথা ভাবেননি নির্বাচকেরা। তাঁদের ভাবনা যে ঠিক ছিল, তা প্রমাণ করেছেন রোহিত।

শোনা যাচ্ছে যে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলি নাকি একই দিনে অবসর নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রোহিতকে বাধা না দিলেও কোহলিকে সেই সময় আটকে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। রোহিত অবসর নিয়েছিলেন ৭ মে। তার আগের দিন রাতেই ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হয়েছিল। সেই কারণেই বোর্ডের তরফে কোহলিকে অবসর ঘোষণা থেকে বিরত রাখা হয়েছিল বলে জানা গিয়েছে। ১৪ বছরের টেস্ট কেরিয়ারে ১২৩টি ম্যাচে ৯২৩০ রান করেছেন কোহলি। গড় ৪৬.৮৫। এখন থেকে শুধু এক দিনের ক্রিকেট খেলবেন কোহলি। ৭ মে রোহিত অবসর ঘোষণা করেছিলেন। সে দিনই সমাজমাধ্যমে অবসর ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কোহলিও। কিন্তু খবরে প্রকাশ যে, কোহলিকে কিছু দিন অপেক্ষা করে যাওয়ার উপদেশ দিয়েছিল বোর্ড। সেই সময় ভারত-পাকিস্তান সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছিল। সেই কারণেই কোহলিকে অপেক্ষা করতে বলা হয়েছিল। বোর্ডকে আরও আগে অবসর নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন কোহলি, সেই সময় যদিও বোর্ড তাঁকে আরও ভাবার উপদেশ দেয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর কোহলি বোর্ডকে জানান যে, তিনি সমাজমাধ্যমে অবসর ঘোষণা করতে চলেছেন। পরিবারের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর জন্যই টেস্ট ক্রিকেট থেকে কোহলি অবসর নিয়েছেন বলে জানা গিয়েছে। শেষ কয়েক বছরে কোহলিকে বেশ কয়েক বার পরিবারের জন্য ইংল্যান্ড যেতে দেখা গিয়েছে। বছরের বেশিরভাগ সময় স্ত্রী অনুষ্কা শর্মা এবং কোহলির সন্তানেরা ইংল্যান্ডেই থাকেন। সেই কারণে বারবার সেই দেশে গিয়েছেন কোহলি। সমাজমাধ্যমে কোহলি লিখেছিলেন, ‘১৪ বছর আগে প্রথম টেস্ট ক্রিকেটের নীল ব্যাগি টুপি পরেছিলাম। সত্যি বলতে তখন জানতাম না, ক্রিকেটের এই ফরম্যাট আমাকে কতটা এগিয়ে নিয়ে যাবে। কল্পনাও করিনি। এই ফরম্যাট আমার পরীক্ষা নিয়েছে। আমাকে তৈরি করেছে। আমাকে শিক্ষা দিয়েছে। সারা জীবন এই শিক্ষা বহন করব।’ তিনি আরও লিখেছিলেন, ‘সাদা পোশাকে খেলার মধ্যে কিছু ব্যক্তিগত গভীর বিষয় থাকে। শান্ত পরিবেশ, দীর্ঘ সময় খেলা, ছোট ছোট মুহূর্তগুলো কেউ দেখতে পায় না। তবে এগুলো চিরকাল আমার সঙ্গে থাকবে।’

কোহলি জানিয়েছেন অবসরের সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ ছিল না। তিনি লিখেছিলেন, ‘ক্রিকেটের এই ফরম্যাট থেকে সরে যাওয়া সহজ নয়। তবু সিদ্ধান্তটা ঠিক মনে হচ্ছে। আমার সব কিছু এই ফরম্যাটের জন্য দিয়েছি। যা আশা করেছিলাম, তার থেকে অনেক বেশি ফিরে পেয়েছি।’ শেষে লিখেছিলেন, ‘কৃতজ্ঞতায় ভরা হৃদয় নিয়ে বিদায় নিচ্ছি। যাদের সঙ্গে মাঠ ভাগ করে নিয়েছি এবং এই যাত্রাপথে যাদের সাহায্য পেয়েছি, সকলের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। সবসময় হাসি মুখে নিজের টেস্ট জীবনের দিকে ফিরে দেখব। ২৬৯ নম্বর টুপির যাত্রা শেষ হল।’ লেখার শেষে কোহলি দিয়েছিলেন ভালবাসার ইমোজি। ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকদের তালিকায় চতুর্থ স্থানে থামলেন বিরাট কোহলি। এগিয়ে শুধুমাত্র সচিন তেন্ডুলকর, রাহুল দ্রাবিড়, সুনীল গাওস্কর। এই ক্রমাঙ্কই কোহলির অবদানের নির্দেশক। ‘দশ হাজার ক্লাব’-এর সদস্য হতে পারলেন না, গত পাঁচ বছর নিষ্প্রভ থাকায় কেরিয়ার কাঙ্ক্ষিত শৃঙ্গেও পৌঁছল না। কিন্তু, ১২৩ টেস্ট, ৯২৩০ রান, ৩০টি সেঞ্চুরির হিসাবতত্ত্বে বিরাট কোহলিকে পুরোটা ধরা মুশকিল। তাঁরই কথায়, সচিন আড়াই দশক দেশকে বহন করেছিলেন। আর কোহলিকে বইতে হয়েছে স্বয়ং তেন্ডুলকরের উত্তরাধিকারী হয়ে ওঠার ভার। বিশেষত ২০১৪-১৯ পর্বে কোহলি দেখিয়েছেন, পরিশ্রমের ছাঁচে প্রতিভাকে মেলে কীভাবে ধাপে ধাপে প্রজন্ম-সেরার বিগ্রহ গড়া যায় এবং পাল্টে দিয়েছিলেন ভারতের ক্রিকেটের চেহারাটা।

তাঁর আবির্ভাব আইপিএল-লগ্নে। ২০০৮-এই অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক হিসাবে আলোয় আসা, ঠিক যে বছর ক্রিকেট হয়ে উঠল নির্ভেজাল বিনোদন— বলিউডের ধুন্ধুমার ছবিকে প্রতিযোগিতায় টেক্কা দিতে সক্ষম এক মহা-উদ্‌যাপন। বিরাট এই সময়েরই প্রতিভূ। তাঁর চরিত্রেও আইপিএল-রঙেরই বিচ্ছুরণ আর নাটকীয়তা দর্শনীয়। কিন্তু, যখন কিংবদন্তিরাও টেস্টের পরিশ্রমকে পাশ কাটিয়ে খ্যাতির কুড়ি ওভারের শর্টকাট বেছে নিচ্ছেন, ঠিক তখনই তিনি বলে দিয়েছিলেন কেন পাঁচ দিন খেলাই তাঁর মোক্ষ, আর কী ভাবে সেখানে খেলোয়াড়ের অগ্নিপরীক্ষা হয়। সেই অটল বিশ্বাসই অদম্য প্রাণশক্তি হয়ে তাঁর সঙ্গে জগিং করতে করতে ছুটত ক্রিজ়ে, চোখের অগ্নিগোলক থেকে বিচ্ছুরিত হত মুঠোয় হ্যান্ডল ধরে ব্যাট ঘোরানোর পরিচিত স্টান্সে, তুলির টানের মতো নিখুঁত ড্রাইভে লাল গোলক পেরিয়ে যেত বাউন্ডারি। অন্য দিকে, অধিনায়ক কোহলি স্পিন-নির্ভর দেশকে হঠাৎ পরিণত করলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ-সম ভয়ঙ্কর পেস-ব্যাটারিতে। ‘দেশের বাঘ’ তকমা ঝেড়ে টিম ইন্ডিয়া সাগরপারেও অপরাজেয় হল। অস্ট্রেলিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কঠিন পিচে কোহলির দাপট মাঝেমাঝে স্বয়ং সচিনকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। এমনকি, যে দিন রান পাননি, সে দিনও তাঁর শরীরী ভাষ্যেই উদ্ভ্রান্ত বিপক্ষ। ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার পরও শর্ট লেগ থেকে উদ্দীপ্ত করেছেন বোলারদের।

কোহলির আমলে ভারতীয় ক্রিকেটের যে পর্বান্তর হল, তা তাঁর পূর্বসূরিদের তুলনায় চরিত্রে পৃথক। গত আড়াই দশকে ভারতীয় ক্রিকেট তিন অতি তাৎপর্যপূর্ণ অধিনায়ককে দেখেছে— উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত কিছু খেলোয়াড়ের সমষ্টিকে প্রথম একটি যূথবদ্ধ দল হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। মহেন্দ্র সিং ধোনি সে দলে এনে দিয়েছিলেন কাউকে পরোয়া না করা তারুণ্যের স্পর্ধা। আর, বিরাট কোহলি ভারতীয় দলকে পরিণত করেছেন এক অপরাজেয় শক্তিতে। ব্যাটার হিসাবে যতখানি, অধিনায়ক হিসাবে ভারতীয় ক্রিকেটে কোহলির গুরুত্ব সম্ভবত তার চেয়েও বেশি। সত্তরের দশকের ক্লাইভ লয়েড বা নব্বইয়ের দশকের স্টিভ ওয়র সঙ্গে তাঁর তুলনা করা চলে কি না, সে প্রশ্নটি ক্রিকেট ইতিহাসবিদদের জন্য থাকুক। তবে, বিরাট কোহলি খেলা ছাড়ার মুহূর্তেও প্রমাণ রাখলেন তাঁর নিখুঁত টাইমিং ক্ষমতার— কখন ছাড়লে লোকে বলে ‘এখনই কেন’, আর কত দিন জায়গা ধরে থাকলে প্রশ্ন ওঠে ‘এখনও নয় কেন’, তা বুঝতে তিনি ভুল করেননি।

বার্ষিক চুক্তিতে রোহিত শর্মা এবং বিরাট কোহলিকে গ্রেড এ প্লাস-এ রেখেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড। বছরে তাঁদের ৭ কোটি টাকা করে দেবে বিসিসিআই। টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট থেকে অবসর নিলেও কমছে না টাকা। জানিয়ে দিয়েছেন বোর্ড সচিব। রোহিত এবং কোহলি টেস্ট থেকে অবসর ঘোষণা করার আগেই বোর্ড বার্ষিক চুক্তি ঘোষণা করেছিল। ফলে এখন অবসর নিলেও তাঁদের সেই চুক্তিতে কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। সচিব জানান যে বিরাট এবং রোহিতের সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল সেটাই থাকছে। টি-টোয়েন্টি এবং টেস্ট থেকে অবসর নিলেও কোনও চুক্তি বদল হচ্ছে না। ওরা ভারতীয় ক্রিকেটের অংশ। যে সুযোগ সুবিধা ওরা পাচ্ছে, সেটাই পাবে। অতি উত্তম। কিন্তু যে দুজন ভারতীয় ক্রিকেটকে এত দিলেন, তাঁদের জন্য একটি বিদায়ী টেস্টের ব্যবস্থা করা গেল না? বোর্ডের ভাবনা চিন্তা করা উচিত এই বিষয়ে।