• facebook
  • twitter
Thursday, 21 August, 2025

রাজ্যে সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে আরএসএস, বিজেপি-র আদৌ লাভ হবে কি?

শৃঙ্খলাপরায়ণ দল হিসেবে যতই পরিচিতি থাকুক, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে সমস্যা হল, তীব্র গোষ্ঠী কোন্দল, যা কখনও কখনও একেবারে প্রকাশ্যে এসে পড়ে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পুলক মিত্র

সবকিছু ঠিকঠাক চললে, আর এক বছর পরেই রাজ্যে বিধানসভার নির্বাচন হতে চলেছে। তবে ইতিমধ্যেই রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। ওয়াকফ সংশোধনী আইনকে ঘিরে হিংসা ছড়িয়েছে মুর্শিদাবাদ, মালদহে। অশান্তির আগুন ছড়িয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়েও। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামাতে হয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনীও।

ইতিমধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে জোরকদমে ময়দানে নেমে পড়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। প্রতিনিয়ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করছেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু ভোটযুদ্ধে বিজেপির সাফল্যের সম্ভাবনা আদৌ আছে কি? রাজনৈতিক মহলে এ নিয়ে প্রতিনিয়ত চর্চা চলছে।

২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বিজেপির ক্ষমতা দখলের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ৭৭টির বেশি আসনে জিততে পারেনি নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের দল। অন্যদিকে, রেকর্ড সংখ্যক ২১৩টি আসনে জিতে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস।

২০১৯-এর লোকসভার ভোটে বিজেপি বাংলায় পেয়েছিল ১৮টি আসন। ২০২৪-এর লোকসভার নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা ২৫ ছাড়িয়ে যাবে বলে বিভিন্ন সমীক্ষায় ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আগের জেতা আসনগুলি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয় এই দল। তাদের আসন কমে দাঁড়ায় ১২তে। অন্যদিকে, তৃণমূলের আসন সংখ্যা ২২ থেকে বেড়ে পৌঁছে যায় ২৯-এ। অর্থাৎ লোকসভা হোক বা বিধানসভা হোক, তৃণমূলের ভোটের হার এবং আসন সংখ্যা, দুই-ই বেড়েছে।
এই অবস্থায় ২০২৬-এর নির্বাচনকে সামনে রেখে বিজেপির হয়ে ময়দানে নেমে পড়েছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ বা আরএসএস। আগামী বছরের সেপ্টেম্বরে এই সংগঠনের শতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মনে করছেন, আরএসএসের সাহায্য ছাড়া বিজেপির একার পক্ষে তৃণমূলের মতো শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই করা কঠিন।
২৯৪ আসনের বিধানসভায় তাদের দখলে রয়েছে ২৫ শতাংশ আসন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহের মতো নেতারা তো রয়েছেনই। তাঁদের সঙ্গে দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, বর্তমান সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারীর এবং আরও কয়েকজন সাংসদ রয়েছেন, যাঁদের ওপর নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে।

শৃঙ্খলাপরায়ণ দল হিসেবে যতই পরিচিতি থাকুক, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সবচেয়ে সমস্যা হল, তীব্র গোষ্ঠী কোন্দল, যা কখনও কখনও একেবারে প্রকাশ্যে এসে পড়ে। দিলীপ ঘোষের সঙ্গে শুভেন্দুর সম্পর্ক, বলতে গেলে, আদায় কাঁচকলায়। সুকান্ত মজুমদারের সঙ্গেও শুভেন্দুর বোঝাপড়া খুব একটা মসৃণ নয়। দলের এক সময়ের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা এখন কার্যত কোণঠাসা। অর্থাৎ বিজেপির ভিতরের চেহারাটা বেশ নড়বড়ে।

তাই শুধুমাত্র দলের নেতাদের ওপর ভর না করে, আরএসএসকে কাজে লাগাতে চাইছেন বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এই মুহূর্তে বিজেপির লক্ষ্য হল, অন্ততঃ আরও ৫ শতাংশ হিন্দু ভোট নিজেদের পক্ষ টানা। এই লক্ষ্য সফল হলে, তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলা যাবে, এমনটাই মনে করেছেন গেরুয়া শিবিরের শীর্ষ নেতারা।

গত লোকসভা নির্বাচনে আসন সংখ্যা কমলেও, বিজেপির পক্ষে ভোটের হার ছিল ৩৯ শতাংশ। ২০২৪-এর নির্বাচনেও আরএসএস তৎপর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রাজ্য বিজেপির নেতৃত্বের সঙ্গে সমন্বয়ে ঘাটতি থেকে গিয়েছিল, যার পুনরাবৃত্তি আগামী বিধানসভা নির্বাচনে চাইছেন না দলের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ।

আগামী বিধানসভা নির্বাচনের আগে আরএসএসের শাখার সংখ্যা ১০০ শতাংশ বাড়ানোর, অর্থাৎ ৬ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১২ হাজার করার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমানের তালিত-এ সভা করে গিয়েছেন আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে আরএসএসে যোগদানের আর্জি জানান, যা অতীতে কখনও হয়নি।

পাশাপাশি আরএসএসকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব, যেমন রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী, জন্মাষ্টমী এবং অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের কর্মসূচি নিয়েছিল বিজেপি। এই ধরনের কর্মসূচি আরও হিন্দু ভোট টানতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন আরএসএসের শীর্ষ নেতারা।

২০২৪-এর জুলাইয়ে শেখ হাসিনা সরকারকে গদিচ্যুত করার পর থেকে বাংলাদেশে একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও আক্রান্ত হচ্ছেন হিন্দুরা। এর প্রভাব এই রাজ্যেও পড়তে শুরু করেছে।
আরএসএস এই প্রভাবকে কাজে লাগাতে চাইছে। ২১-২৩ মার্চ বেঙ্গালুরুতে আরএসএস-এর বার্ষিক প্রতিনিধি সভায় বাংলাদেশের অত্যাচারিত হিন্দুদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বাংলাদেশের হিন্দুরা এখন যে দুর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গের ভোটে তার প্রতিফলন দেখা যাবে।

হিন্দুরা আরও বেশি সংখ্যায় বিজেপির দিকে ঝুঁকবেন, এমনটাই আশা বিজেপি নেতাদের। সংখ্যালঘুদের প্রতি তৃণমূল সরকারের ‘নরম’ অবস্থানকে বিজেপি জোরালোভাবে তুলে ধরতে চায়। পাশাপাশি কম হলেও, সংখ্যালঘুদের একাংশের ভোট নিজেদের দিকে টানতে চাইছে বিজেপি। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, শুধুমাত্র হিন্দু ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে বিজেপির পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া কঠিন। প্রথমত, মমতার মতো জনপ্রিয় নেত্রীর মোকাবিলায় গেরুয়া শিবিরে তেমন কোনও গ্রহণযোগ্য মুখ নেই। দ্বিতীয়ত, মমতার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হল, তাঁর বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক প্রকল্প। এর মধ্যে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে, কন্যাশ্রী, স্বাস্থ্য সাথীর মতো প্রকল্প। তাই মমতার মোকাবিলা করতে হলে, বিজেপি-কেও পাল্টা জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের দিকে নজর দিতে হবে, এমনটাই মত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের।