শোভনলাল চক্রবর্তী
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় হাজার হাজার শিল্প ও ব্যবসায়িক সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে খোদ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে অভিযোগ তুলেছিলেন। তাঁর জবাবে এবার কেন্দ্রীয় সরকারেরই পরিসংখ্যান তুলে ধরে তৃণমূল দাবি করল, ২০১১ সালের পর থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানায় পশ্চিমবঙ্গে নথিবদ্ধ শিল্প বা ব্যবসায়িক সংস্থার সংখ্যা ৮০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১১-র পরে মোট সংস্থার সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৩৭ হাজার ১৫৬টি। চলতি বছর ৩১ জুলাইয়ের হিসেব অনুযায়ী তা বেড়ে ২ লক্ষ ৫০ হাজার ছাপিয়ে গিয়েছে। এই হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ বিজেপি-শাসিত উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতের থেকেও এগিয়ে। তৃণমূল দাবি করেছে, কর্পোরেট সংস্থার হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ গোটা দেশের মধ্যে তৃতীয় স্থানে।
Advertisement
কারখানা পিছু গড় মুনাফার পরিমাণ ২০১১ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ৫৪৬ শতাংশ বেড়েছে। তৃণমূলের সংসদীয় দলের দফতরে তৃণমূলের রাজ্যসভার উপদলনেত্রী সাগরিকা ঘোষ ও লোকসভার উপদলনেত্রী শতাব্দী রায় সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, মোদী সরকার ভুল তথ্য দিয়ে সংসদকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। বাস্তবে ২০১১ থেকে ২০২৫— এই সময়ে পশ্চিমবঙ্গে ১ লক্ষেরও বেশি কোম্পানি নথিবদ্ধ হয়েছে। প্রায় ৮৩% বৃদ্ধি। প্রতি বছর গড়ে ৭,৫০০ সংস্থা নথিবদ্ধ হয়েছে। গত পাঁচ বছরে ৪০ হাজার কোম্পানি নথিবদ্ধ হয়েছে। মোদী–শাহ জুটি নানা অদ্ভুত তথ্য দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে নিশানা করার চেষ্টা করছে। এই নিয়ে বিতর্কের শুরু বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের সংসদে তোলা প্রশ্ন থেকে। তাঁর প্রশ্নের উত্তরে কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রক জানিয়েছিল, ২০১১ সাল থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬,৮৯৫টি সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়েছে। চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর— এই তিন মাসে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাততাড়ি গুটিয়েছে ২০৭টি সংস্থা। এর পরে তৃণমূলের কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগের জবাবে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন সংসদে বলেন, ২০১১-র ১ এপ্রিল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪৪৮টি শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত সংস্থা ও ৬,৪৪৭টি অনথিভুক্ত সংস্থা পশ্চিমবঙ্গ থেকে দফতর সরিয়ে অন্য রাজ্যে চলে গিয়েছে।
Advertisement
তৃণমূল পাল্টা দাবি তুলেছে, তাদের দলেরই সাংসদ বাপি হালদারের প্রশ্নের উত্তরে এর আগে কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গে নথিবদ্ধ সংস্থার বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধির হিসেব দিয়েছিল। এখন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে শিল্প বিরোধী হিসেবে তুলে ধরতে চাইছে। একশো দিনের কাজে পশ্চিমবঙ্গের বকেয়ার পরিমাণ ৫২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কলকাতা হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরেও কেন্দ্রীয় সরকার কাজ শুরু করেনি। এখন প্রকল্পের নিয়ম নতুন করে সাজানো হচ্ছে বলে যুক্তি দিচ্ছে। মোদী সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি মতো সংসদের দুই কক্ষে এসআইআর তথা নির্বাচনী সংস্কার নিয়ে আলোচনা করবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বন্দে মাতরম্ নিয়ে আলোচনার পরে এসআইআর নিয়ে সরকার আলোচনা থেকে পালাবে না বলেই তাঁরা আশা করছেন।তবে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। কুনাট্য অনেক সময়ই রঙ্গে পরিণত হয়। অনেক সময় আবার কুনাট্য হয়ে ওঠে তীব্র প্রতারণার উপর একটি পর্দার মতো, যার নেপথ্যে বাস্তব সত্য, তথ্য, হিসাব সবই উধাও করে দেওয়া যায়।
ভারতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিরোধী নেতাদের উদ্দেশে নাটক না করার ব্যঙ্গবঙ্কিম অনুরোধ জানিয়েছিলেন। অধিবেশন শুরু হতেই দেখা গেল, সেখানে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও নেতারা যা করছেন, তা কেবল নাটক নয়, প্রতারণা-মূলক কুনাট্য। বিষয়টি অতি গুরুতর, কেননা এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মল্লযুদ্ধের মোড়কে আসলে বঞ্চিত করা হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণকে। এই প্রসঙ্গে যে নামটি প্রথম ও প্রধান— তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। তাঁর আচরণ, বক্তব্য, তথ্য— সবই অতীব আপত্তিজনক। এত গুরুতর পদে আসীন কোনও ব্যক্তি যে এই ভাবে স্পষ্টত নিরপেক্ষতার দায় চুকিয়ে দলীয় সঙ্কীর্ণতায় অবগাহন করতে পারেন, প্রবল দর্পে উচ্চরবে ভুল তথ্য ও বিকৃত বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারেন, তা ভারতীয় গণতন্ত্রের মালিন্যময় ইতিহাসেও একটি বিশিষ্ট দৃষ্টান্ত হয়ে থাকার মতো। পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদরা তাঁর বিরুদ্ধতা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু নির্মলা সীতারামন তা শোনার ভব্যতা দেখাননি, কোনও কথাতেই পাত্তা না দিয়ে সরবে বক্তৃতা জারি রেখেছেন। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বিপুল পরিমাণ অর্থ আটকে রাখার ঘটনা এখন কেন্দ্রীয় সরকারও অস্বীকার করে না। ২০২২ সালের ৮ মার্চের হিসাবে মনরেগা প্রকল্পে তিন হাজার কোটির অধিক টাকা প্রাপ্য এই রাজ্যের, যা এখনও দেয়নি নরেন্দ্র মোদী সরকার। যুক্তরাষ্ট্রীয় ও গণতান্ত্রিক সমস্ত রীতিনীতি সমূলে অগ্রাহ্য করে রাজ্যের প্রাপ্য অর্থ আটকে রাখার এই রাজনৈতিক পরিকল্পনা, এক কথায়, ঘৃণ্য।
এ দিকে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন পেশ করেছেন সেই পরিচিত যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রীয় যোজনা রূপায়ণে কোনও স্বচ্ছতা নেই। ২০২২ সালের মার্চের পর একশো দিনের প্রকল্পে পশ্চিমবঙ্গে টাকার জোগান বন্ধ করে দেওয়ার কারণ— কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা মেনে চলেনি রাজ্য। কত টাকা কী ভাবে ব্যয় করা হয়েছে কিংবা হয়নি, তার চুলচেরা সংখ্যা নিয়ে অবশ্যই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে বিসংবাদ অনন্ত। কিন্তু আসল কথা হল, যদি ধরে নেওয়া যায় অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা থেকেছে, সে ক্ষেত্রেও কি এই ভাবে পাঠশালার দাপুটে গুরুমশাইয়ের মতো রাজ্যের বরাদ্দ এত বছর ধরে বন্ধ রাখা উচিত? পাঠশালার প্রসঙ্গ উঠল বলে বলা যায় যে, একুশ শতকের বিদ্যায়তনে শিক্ষকরাও ছাত্রছাত্রীদের উপর যথেচ্ছ শাস্তিমূলক ব্যবহার করতে পারেন না, পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে তার নিষ্পত্তিতে বাধ্য থাকেন। তা ছাড়া, এ কথা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবত অসম্ভব যে একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা চলেছে, বাকি সর্বত্র— বিজেপি-শাসিত রাজ্যে— সুশাসনের ঢল প্রবহমান।
মনরেগা ছাড়া অন্যান্য যোজনাতেও পরিস্থিতি সমান সর্বনাশা। যেমন, বিপর্যয় মোকাবিলা খাতে পশ্চিমবঙ্গের বকেয়া প্রায় সাড়ে তিপ্পান্ন হাজার কোটি টাকা। অথচ এ ক্ষেত্রেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বৈঠকে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা হল, পশ্চিমবঙ্গ রইল উপেক্ষিত। আরও একটি প্রশ্ন। যে অর্থ কেন্দ্র এই ভাবে আটকে রাখছে, তা কি কেন্দ্রীয় শাসকের দান বা ভিক্ষা? না কি, তা জনগণের জন্য ব্যয়েরই অর্থ? গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতে সেই অর্থ কি সম ভাবে সব রাজ্যের ‘প্রাপ্য’ হওয়ার কথা নয়? বিরোধীশাসিত রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের রেষারেষি বা তর্কাতর্কি এ দেশে নতুন নয়। কিন্তু রাজনৈতিক কুস্তিপ্যাঁচে বিরোধী রাজ্যের জনসমাজকে বছরের পর বছর বঞ্চিত রেখে সেখানকার শাসকের উপর চাপ তৈরি, এবং রাজ্যের জননির্বাচিত প্রতিনিধিদের অবজ্ঞার এই পন্থা— এক অদৃষ্টপূর্ব অন্যায়।রাজ্য প্রশাসন দাবি করেছে, এ পর্যন্ত দেড়শোরও বেশি কেন্দ্রীয় দল রাজ্যে পাঠিয়েছে কেন্দ্র। তারা যা চেয়েছে, সেই সব তথ্যই তাদের দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রের সুপারিশ অনুযায়ী, সব ধরনের সংশোধনমূলক পদক্ষেপও করেছে রাজ্য। রাজ্য এখন কেন্দ্রীয় দলের আসা নিয়ে অভ্যস্ত।কিছু খুঁজে না পেলেও কেন্দ্র দল পাঠায়। কিন্তু কাজের কাজ হয় না।একশো দিনের কাজের প্রকল্পে বরাদ্দ ছাড়ার নির্দেশ দেয় কলকাতা হাই কোর্ট। তাতে সেই বরাদ্দ চালু করার কথা কেন্দ্রের। কিন্তু এখনও কেন্দ্রের তরফে এ ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিত বা বার্তা রাজ্যের কাছে আসেনি বলেই প্রশাসনের দাবি।
হাই কোর্টের রায়ের পরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, যে দিন থেকে কেন্দ্র টাকা বন্ধ করেছে, তবে থেকে বকেয়া হিসাবে বরাদ্দ দিতে হবে। ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে এই প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ হওয়ার পর থেকে জবকার্ড থাকা শ্রমিকদের স্বার্থে ‘কর্মশ্রী’ প্রকল্প চালু করেছিল রাজ্য। তাতে এখনও পর্যন্ত প্রায় ১৬,৯১৯ কোটি টাকা নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করেছে রাজ্য। অন্য দিকে, একশো দিনের কাজে মোট বকেয়া রয়েছে প্রায় ৬৯১৯ কোটি টাকা। তার মধ্যে শ্রম-খাতে বকেয়া প্রায় ৩৭৩২ কোটি টাকা। রাজ্যের অভিযোগ ছিল, সব ধরনের পদক্ষেপ করার পরেও পশ্চিমবঙ্গের বরাদ্দ অন্য রাজ্যকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়নমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহানের সঙ্গে বৈঠকের জন্য একাধিক বার সময় চেয়েছিল রাজ্য। প্রতিশ্রুতি দিলেও, বৈঠকের সেই সময় এখনও মেলেনি। বৈঠকটি হলে রাজ্যের সব পদক্ষেপ ও অবস্থান হয়ত বুঝিয়ে বলা সম্ভব হত নতুন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে। কিন্তু তাঁরা সেসব কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে শুধুই মিথ্যা অপপ্রচার করছেন।
Advertisement



