বাংলাদেশ এখন পাকিস্তানের পুরনো ভাই। সেই পুরনো ভাইকে আবার ‘ফিরে পেতে’ পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার বাংলাদেশের ইউনূস সরকারের আমন্ত্রণে ঢাকা আসছেন আগামী মাসে। ফেব্রুয়ারির কোন তারিখে এই ‘মহামান্য অতিথি ঢাকায় পা রাখবেন, তা এখনও ঠিক হয়নি। এই দার সাহেব আবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিক সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রীও। পাক বিদেশমন্ত্রীর এই বাংলাদেশে আসার খবর উপমহাদেশের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। তাঁর সফর বাংলাদেশে পাকিস্তানের আধিপত্য বিস্তারে একটি প্রধান ভূমিকা নেবে। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি, জামায়েত ইসলামী, কট্টর মৌলবাদী সম্প্রদায় এবং পাকিস্তানপন্থীরা পাক বিদেশমন্ত্রীর আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে।
গত আগস্ট মাসে হাসিনা সরকারের পত্তনের পর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে জোয়ার এসেছে। পাকিস্তানও দেখেছে ভারতের অনুগত সরকারের পতনের পর এটাই বড় সুযোগ বাংলাদেশে তার আধিপত্য বিস্তার করা। যে পাকিস্তানী সৈন্য হাজার হাজার মুক্তি যোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে খুন করে স্বাধীনতার আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল, সেই পাক বিদেশমন্ত্রীকে ঢাকা সাদরে আমন্ত্রণ জানাল। ভাবা যায় না বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ কী করে এই অতিথিকে আমন্ত্রণ করার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন না। ইউনূস সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পাতার জন উঠেপড়ে লেগেছে। যে বাংলাদেশ সরকার গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেছিল, সেই পাকিস্তান এখন বাংলাদেশের বন্ধু হয়ে দাঁড়াল। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করে যদি বাংলাদেশ একটি ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়, তাহলে ভারতের পক্ষে তা হবে চরম অস্বস্তিকর। যদিও পাকিস্তানের আর্থিক শক্তি এত দুর্বল যে, তার পক্ষে বাংলাদেশের উন্নয়নে সাহায্য করা কঠিন। তবে বাংলাদেশে পাক সরকারের অনেক ‘বন্ধু’ থাকার ফলে তারা ভারত বিরোধিতায় উস্কানি দেবে সে ব্যাপারে কোনও সন্হে নেই। ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এক শ্রেণির মৌলবাদী এবং পাকিস্তানপন্থীরা চেষ্টা করে যাচ্ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে উন্নতি করা। কিন্তু হাসিনা সরকারের পাকিস্তান সম্পর্কে কঠোর মনোবাবের জন্য তাদের চেষ্টা সফল হয়নি। কিন্তু পাকিস্তানপন্থীরা ভিতরে ভিতরে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। কূটনৈতিক মহল বলছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট নাগরিক এবং কবি, সাহিত্যিকরা পাক বিদেশমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর বিরুদ্ধে তাঁদের মত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন, ইউনূস সরকারের এই কাজ অত্যন্ত গর্হিত। কারণ পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধ কালে সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে, তা তাঁরা ভুলতে পারবেন না। আর সেই সরকারের বিদেশমন্ত্রীকে ঢাকা সফরে আমন্ত্রণ জানানো অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। তাঁরা এখনও তা সমর্থন করবেন না।
উল্লেখ্য, কায়রোয় জি-৮ সংগঠনের শীর্ষ বৈঠকে যোগদান কালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের তদারকি সরকারের প্রধান ইউনূস খানের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা হয়। এই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে উন্নতি করা। অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে, পাক প্রধানমন্ত্রী ইউনূস খানকে পাক সফরে আমন্ত্রণ জানান। খান সাহেবও পাক প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সফরে আসতে অনুরোধ করেন। এরপর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে পাকিস্তানের নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা ও যোগসাজশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি দু’টি পাকিস্তানের জাহাজ নানা সামগ্রী নিয়ে করাচি বন্দর থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে এসে পৌঁছয়। জাহাজ দু’টিতে কী কী আছে, তা এখনও প্রকাশ পায়নি। কারণ ইউনূস খানেরসরকার জাহাজ দু’টিতে তল্লাশি চালাতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অনেকেরই অনুমান জাহাজ দু’টিতে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্রও রয়েছে।
সীমান্তে পাকিস্তানের সাহায্যপুষ্ট জঙ্গিদের নাশকতামূলক কাজের জন্য প্রতিবাদস্বরূপ ভারত হাত গুটিয়ে নেওয়ারক ফলে মার্চ সম্মেলন কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। পাক প্রধানমন্ত্রী ডা. ইউনূস খান দু’জনেই আবার মার্চ সম্মেলন হওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। পাক প্রধানমন্ত্রী ইউনূস খানকেআশ্বস্ত করে বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশের উন্নয়নে যথাসাধ্য সাহায্য করে চলবে।
বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পতনের পর চিন এ ব্যাপরে অনেকদিন চুপ করেছিল। কিন্তু তলে তলে চিন বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিল। চিন বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই তাকে নানাভাবে সাহায্য করে আসছে। সাহায্য করবে সমরাস্ত্র দিয়েও। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য চিন হাসিনা সরকারের আমলেও অনেক সাহায্য করেছে। সম্প্রতি চিনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের বিদেশ সচিবের সঙ্গে দেখা করে দুই দেশের সম্পর্ক যাতে আরও দৃঢ় হয়, তা নিয়ে আলোচনা করেছন। কিছুদিন আগে চিনের রাষ্ট্রদূত জামায়েত ইসলামী নেতাদের সঙ্গেও দেখা করে দুই দেশের সম্পর্কে উন্নতি সাধন নিয়ে কথাবার্তা চলেছে। বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি’র কয়েকজন নেতাও চিনে গিয়ে সে দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলে এসেছেন। শোনা গেল জামায়েত ইসলামীর কয়েকজন নেতাও শিগগিরই চিন সফরে যাবেন।
চিন ও পাকিস্তান যেভাবে উঠেপড়ে লেগেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁদের মৈত্রীর বন্ধন দৃঢ় করতে, তাতে ভারতের পক্ষে যথেষ্ট অশ্বস্তির কারণ রয়েছে। এ ব্যাপারে বিরোধীরা মোদী সরকারের বিদেশ নীতিকে দূষছেন। ওদিকে নেপালেও চিনের প্রাধান্য বেড়েই চলেছে। বিরোধীদের অভিযোগ একে একে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি ভারত বিরোধিতায় নামছে। তা বিশেষ উদ্বেগজনক।