• facebook
  • twitter
Sunday, 7 December, 2025

মন্দিরের পর এবার ধর্মধ্বজা

ভারতের মানুষের কাছে প্রকৃত লড়াই জীবনের বাস্তব সমস্যার বিরুদ্ধে যেখানে কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতা ও দুর্নীতি দেশের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আবার রামমন্দির। রামকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ মানুষের ধর্মবিশ্বাসকে রাজনীতি ও প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত করার উগ্র চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সঙ্ঘ পরিবার। সম্প্রতি অযোধ্যায় রামমন্দিরে ধ্বজারোহণ অনুষ্ঠানে সেই প্রক্রিয়া সুদৃঢ় করতে দেখা গিয়েছে।

রাম এবং অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণ বিজেপির সর্বাধিক লাভজনক প্রচারণা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা দলটিকে ভারতের সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ধরনের রাজনৈতিক কর্তৃত্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বহু মানুষের আরাধ্য এবং ঐশ্বরিক গুণ যুক্ত হিসাবে বিবেচিত রাম, তুলসীদাসের রামচরিতমানসের মাধ্যমে শত শত বছর ধরে হিন্দু পরিবারগুলির মধ্যে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত এক পুরাণ চরিত্র। ভারতের দুই মহাকাব্যের একটি হল রামায়ণ, যেখানে রামকে মর্যাদা পুরুষোত্তম হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, সেই বিশ্বাস বা লক্ষ লক্ষ মানুষের ব্যক্তিগত আস্থা নিয়ে কারোরই আপত্তি থাকতে পারে না।

Advertisement

কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন ধর্মীয় বিশ্বাসকে রাজনীতি ও শাসনের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টা হয়। নবনির্মিত রামমন্দিরে ২৫ নভেম্বরের কর্মসূচিতে এই প্রক্রিয়াকে আরও সুদৃঢ় করতে নতুন আক্রমণ শোনা গেল। অনুষ্ঠানে মন্দিরের ওপর ধর্মধ্বজা প্রতিষ্ঠা করা হয়, আর এটিকে দেশের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের প্রতীক হিসাবে তুলে ধরা হয়।

Advertisement

বিজেপি কেন্দ্রীয় সরকারে ক্ষমতায় আসার পর এগারো বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। অন্যান্য নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেও দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতা বিস্তারের পাশাপাশি দেশের অধিকাংশ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, সাংসদ, নির্বাচন কমিশন এবং বিচার ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি— ভারতীয় জাতীয় সত্তার তাৎপর্য নতুনভাবে ব্যাখ্যার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এই ধর্মধ্বজারোহণ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং আরএসএস প্রধান মোহন ভগবতের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে স্পষ্ট বোঝা যাবে যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ সমগ্র ভারতীয় অতীত, রাম-কাহিনির মধ্যে সঙ্কুচিত করার সচেতন প্রয়াস চলছে। মোদী ঘোষণা করেন, ‘আজ ভগবান শ্রীরামের জন্মভূমির অসীম শক্তি, শ্রীরাম পরিবারের ঐশ্বরিক মহিমা এই সর্বাধিক পবিত্র এবং মহত্তম মন্দিরে, ধর্মধ্বজার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেল।’ এই ধর্মধ্বজা শুধু একটি পতাকা নয়, এটি ভারতীয় সভ্যতার পুনর্জাগরণের পতাকা। এর গেরুয়া রং, তাতে অঙ্কিত সূর্যবংশের প্রতীক, ‘ওঁ’- এর চিহ্ন এবং খোদাই করা কোবিদার বৃক্ষ-সবই রামরাজ্যের গৌরবের প্রতীক। এই পতাকা এক সংকল্প। এই পতাকা সাফল্য। এই পতাকা সংগ্রাম থেকে সৃষ্টির ইতিহাস।

ভারতসহ বিশ্বের অনেক স্থানে ধর্ম ও রাজনীতি একে অপরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখে। এবং গণতন্ত্র টিঁকে থাকে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য শাসনের নীতিতে। এখানে, দেবত্বের প্রশ্নে প্রবেশের প্রয়োজন নেই— কারণ এই দেশে বহু ধর্মবিশ্বাস রয়েছে, যেগুলি এই দেবত্ব ও শাসনের পরস্পরকে পরিপূরক ভাবার প্রবণতায় সমানভাবে অনুপ্রাণিত নাও হতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলির কর্তব্য হলো— শ্রেণি, জাত, ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের কল্যাণে সুস্পষ্ট নীতি ও বাস্তবায়ণযোগ্য পদক্ষেপ প্রস্তাব করা। জবাবদিহিতার নীতিতেই সে সব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয় এবং সরকারকে তার ভিত্তিতেই মূল্যায়ণ করা হয়।

কিন্তু অযোধ্যায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর ভাষণের শৈলী থেকে মনে হয়, এই পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর নেই। ভাষণে মোদী বলেন, এই ধর্মধ্বজা আমাদের সংকল্প করাবে— ‘নাহি দরিদ্র কাউ দুখী না দিল’— অর্থাৎ আমরা এমন এক সমাজ গড়ে তুলবো যেখানে দারিদ্র নেই, কেউ দুঃখী বা অসহায় নয়।’ কিন্তু কিভাবে দারিদ্র, দুঃখ বা অসহায়ত্ব দূর হবে, সেটি ব্যাখ্যা করা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব ছিল। রামও ধর্মধ্বজার প্রশস্তি করে তা অবশ্যই সম্ভব নয়। ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, দারিদ্র ও বেকারত্বের মধ্যে এমন লক্ষ্য কীভাবে অর্জিত হবে, তার জবাব সরকারকেই দিতে হবে।

ভারতের মানুষের কাছে প্রকৃত লড়াই জীবনের বাস্তব সমস্যার বিরুদ্ধে যেখানে কর্পোরেট ঘনিষ্ঠতা ও দুর্নীতি দেশের ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ কৃষক ও কৃষিশ্রমিককে দুই বেলা খাদ্যের নিশ্চয়তা পেতে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। সরকারি স্কুলগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য বিপন্ন। তরুণ-তরুণীদের কর্মসংস্থানে ও জীবিকা অর্জন এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাস্তবের দুঃখ-কষ্টকে দেবতামুখী আনুগত্যের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে আরএসএস। আরএসএসের এই মুখোশই টেনে খুলে ফেলে দিতে হবে।

Advertisement