• facebook
  • twitter
Sunday, 7 December, 2025

ধর্মীয় মানুষের ঐক্যে ভোটের রাজনীতি সরগরম হলেও মানুষের ধর্মই আজ বিপন্ন

ভারত শুধু বহু ধর্মের দেশই নয়, এটি একটি ধর্মের আদর্শের দেশ। এই দেশে সব ধর্মের সহাবস্থান ঘটেছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরলপ্রায় এজন্য এ দেশের গৌরব ও সৌরভ তার ধর্মীয় বৈচিত্র।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

স্বপন কুমার মণ্ডল

আবার রাজনীতির খোলা ময়দানে বাবরি মসজিদ বনাম রামমন্দির প্রতিষ্ঠার যুদ্ধং দেহি মনোভাব নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। ১৯৯২-এর ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভেঙে অবশেষে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রামমন্দির নির্মাণ ও কিছুদিন আগে প্রতিষ্ঠার (২০২৫-এর ২৫ নভেম্বর) পরেও পুনরায় মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় এ বছরের সেই ৬ ডিসেম্বরে রাবরি মসজিদের ভিত্তি প্রস্তর নির্মাণের কথা স্বাভাবিক ভাবেই গণমাধ্যমে শোরগোল ফেলে দেয়। সামনে ২০২৬-এর রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ময়দানে মুসলিম অধ্যুষিত মুর্শিদাবাদে বাবরি মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে যে ভোটরাজনীতি বর্তমান, তা সহজেই অনুমেয়। আপাতভাবে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগ অপ্রত্যাশিত হলেও তার অবিচ্ছেদ্য প্রকৃতি অত্যন্ত স্বাভাবিক। রাজ করার মধ্যেই ক্ষমতা ও শাসনের আধিপত্য। সেক্ষেত্রে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের যোগ অত্যন্ত নিবিড়। ধর্মের কল্যাণকামী পবিত্র চেতনায় ধর্মনীতিই রাজনীতিতে শুধু আধিপত্য কায়েম করে না, তার অধিকারও প্রতিষ্ঠা পায়। জোর করে অধিকার মেলে না, কর্তব্য করেই তা অর্জিত হয়। অন্যদিকে জোর করে আধিপত্য বিস্তার করা গেলেও তা অধিকারে আসে না। সেক্ষেত্রে ধর্মের কল্যাণকামী পবিত্র চেতনায় তার আধিপত্যও গৌরব ও সৌরভ বয়ে আনে। সেখানে ‘রাজধর্ম’ হয়ে ওঠে ‘ন্যায়ধর্ম’, বিচারক হন ‘ধর্মাবতার’। সেই রাজের উৎকর্ষেই ‘ধর্মরাজ’-এর আধিপত্য বিস্তার। স্বাভাবিক ভাবেই সেই আধারে রাজনীতির ক্ষমতায়নে ধর্মীয় নীতিআদর্শ শ্রেষ্ঠত্বের পরাকাষ্ঠায় তার অবিচ্ছেদ্য অস্তিত্ব ধর্মপ্রাণ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। সেখানে ধর্ম ও রাজনীতি আপাতভাবে স্বতন্ত্র মনে হলেও তার অবিচ্ছিন্ন প্রকৃতি নানাভাবেই প্রকাশমুখর। আসলে রাজনীতির সংকীর্ণ স্বার্থপরতা ও নীতিআদর্শহীন ক্ষমতাসর্বস্ব প্রকৃতির সঙ্গে পবিত্র ধর্মীয় চেতনার সংযোগের প্রতি সাধারণ মানুষের তীব্র অনীহা বর্তমান। এমনিতেই ভোটরাজনীতিতে নির্বাচনের বিদ্বেষী প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে যুদ্ধং দেহি মনোভাবে মানুষের স্বাভাবিক সম্পর্ক বিপন্ন হয়ে পড়ে। সেখানে রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের সংযোগ যে সেই বিদ্বেষকে বিধ্বংসী করে তুলতে পারে তা ভেবেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ তার আতঙ্ক শিউরে ওঠেন। সেদিক থেকে ধর্মের মানুষের জিগিরে মানুষের ধর্মই আজ আরও ঘোরতর সংকটে মনে হয়।

Advertisement

আসলে মানুষের পরিচয়ে ধর্মীয় অস্তিত্ব অতি নিবিড়। রাজনৈতিক সচেতনতাই সেই পরিচয়কে আরও প্রকট করে তুলেছে। মানুষের অস্তিত্বের সোপানে ধর্মীয় পরিচয় তার মানবিক অস্তিত্বের সঙ্গেই বিজড়িত। সেখানে উচ্চতর জীবনের পথের (way of higher life) দিশায় ধর্মের সংযোগ অত্যন্ত স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। প্রত্যেকের গন্তব্য এক হলেও মতের ভিন্নতায় তার পথের বৈচিত্র দেখা দেয়। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের কথায় ‘যত মত, তত পথ’। এই মত ও পথের ভেদে ধর্মীয় ভেদাভেদের বিস্তার ও তা পারস্পরিক বিদ্বেষের আধারে রাজনীতির সংযোগ স্বাভাবিকতা লাভ করে। অন্যদিকে বিদ্বেষে যেমন বিচ্ছিন্নতা ও আধিপত্য বোধ জেগে ওঠে, তেমনই স্বধর্মীয়দের মধ্যে ঐক্যভাবনা জাগিয়ে তোলে। সেক্ষেত্রে ধর্মীয় বিদ্বেষের পুঁজিই ভোটরাজনীতিতে মহার্ঘ মূলধন হয়ে ওঠে। আর সেখানেই রাজনীতির কারবারিরা ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য ধর্মযুদ্ধের আয়োজন করতেও দ্বিধা করে না। প্রসঙ্গত, এবার যে রাজনৈতিক নেতা মসজিদ নির্মাণে সক্রিয় হয়েছেন, তিনি আসলে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবেই তা করেছেন। তিনি নতুন কোনও মসজিদ শিলান্যাস করতে চাননি, সেটি বিতর্কিত ‘বাবরি মসজিদ’কে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চান নিজের এলাকায়। আবার তা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনেই তার নতুন করে শিলান্যাসের আয়োজন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর উদ্দেশ্য আরও প্রকট হয়ে ওঠে। অর্থাৎ ধর্মের জিগির তুলে ধর্মীয় ঐক্যে ভোটতরণী পারের আয়োজনই তাঁর অর্জুনের পাখির চোখ।

Advertisement

স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার অভাবই তাতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্যদিকে বিতর্কিত বাবরি মসজিদের পাল্টা রামমন্দির প্রতিষ্ঠার আয়োজনে ধর্মীয় বিদ্বেষ রাজনীতির ময়দানকে আরও অস্থির ও ভয়ার্ত উত্তেজনামুখর করে তুলেছে। আসলে ধর্ম (religion) থেকে যখন ধর্মাচার (ritual) বড় হয়ে ওঠে, তখন ধর্মীয় চেতনাকেই আচ্ছন্ন করে তোলে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, কেউ ধর্মে গোঁড়া, কেউ আচারে। সেক্ষেত্রে যে ধর্মে গোঁড়া, সে আসলে ধর্মাচারেই গোঁড়া। তা পালনের মাধ্যমে প্রকট হয় বলেই তার ধর্মপ্রাণ অস্তিত্ব স্বধর্ম রক্ষাতেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, তাতে স্বকীয় ধর্মের আধিপত্য বিস্তার থেকে তার শ্রেষ্ঠত্ববোধে মোহাচ্ছন্ন অন্ধত্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে তার বিধ্বংসী রূপ নগ্নতা লাভ করে। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাষায় ‘ধর্মের নামে মোহ যারে এসে ধরে/ অন্ধ যে জন, মারে আর শুধু মরে।’ ধর্মাচারসর্বস্ব ধর্ম শুধু পালনেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে, উল্টে জাগিয়ে তোলে একদেশদর্শী প্রতিহিংসাপরায়ণতা। সেখানে মানুষের ধর্মের চেয়ে ধর্মের মানুষ প্রাধান্য লাভ করে।

ভারত শুধু বহু ধর্মের দেশই নয়, এটি একটি ধর্মের আদর্শের দেশ। এই দেশে সব ধর্মের সহাবস্থান ঘটেছে যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরলপ্রায় এজন্য এ দেশের গৌরব ও সৌরভ তার ধর্মীয় বৈচিত্র। অথচ এই দেশটির রাজনীতি সঙ্গে ধর্মের যোগ অবিচ্ছেদ্য। ধর্মভেদেই দেশভাগের শিকার হয়েও নানা ধর্মের সহাবস্থানে ভারতের চিরায়ত গৌরব আজও অক্ষুণ্ণ ও অম্লান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মহামানবের সাগর তীরে ভারততীর্থে আজও ধর্মের সমন্বয়ী বার্তা বিশ্ববাসীকে পথ দেখিয়ে চলেছে। সেখানে ধর্মীয় মৌলবাদীদের কোনও স্থান নেই। যে অন্য ধর্মকে অস্বীকার করে সে নিজের ধর্মকেও ভালোবাসে না। নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসাই অন্যের মাকে ভালবাসতে শেখায়। ধর্ম মানুষকে ভালোবাসতে শেখায়, উদার ও মুক্তপ্রাণা প্রকৃতিই সৌরভ। ধর্মে যা মিলনের বাণী, ধর্মাচারেই তা বিচ্ছেদের পারানি, ভাবা যায়! বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৩-এর ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগো বিশ্ব ধর্মসভায় সে কথাই উচ্চারণ করে বিশ্ববাসীর মন জয় করেছিলেন, ‘সব ধর্মকে সমান শ্রদ্ধা করি এবং সত্য বলে মানি।’ যখন অন্যসব ধর্মীয় প্রতিনিধিরা নিজেদের ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে জাহির করেছিলেন, তখন স্বামীজির উদাত্ত কণ্ঠের উদার হাতছানি নতুন করে ধর্মের মুক্ত পরিসরকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেখানে ধর্মীয় আধিপত্যবাদে মৌলবাদীদের সন্ত্রাসী আবহাওয়ায় ধর্মের উদার আকাশই শুধু সংকীর্ণতায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়েনি, তার জন্য মানবিক মূল্যবোধও আজ অস্তিত্ব সংকটে। মানুষের ধর্ম ‘বাঁচো এবং বাঁচাও’। অথচ ধর্মীয় বিদ্বেষে নিজে ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য অন্যকে অস্বীকার করার প্রবণতাও সক্রিয় হয়ে উঠছে। সেখানে মানুষের মানবিক পরিচয় নয়, তার ধর্মীয় পরিচয়ই সবচেয়ে বড় হয়ে উঠেছে।

স্বাভাবিক ভাবেই তাতে রাজনীতির ধর্মে ধর্মীয় পরিচয় সুলভ ও সহজলভ্য মনে হয়। শুধু তাই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ বলে যারা রাজনীতি থেকে ধর্মের সংযোগকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষপাতী,তারাও নানা কৌশলে ধর্মীয় ভোটব্যাঙ্ককে কুক্ষিগত করতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। আসলে ধর্মকে আফিমের সঙ্গে তুলনা করেও সেই আফিমের নেশাতেই বুঁদ করে রাজনৈতিক ফায়দা উসুল করাই সেক্ষেত্রে অনন্যোপায়ে জরুরি হয়ে পড়ে। ধর্মের তাসে রাজনীতির কিস্তিমাত করার প্রবণতা নতুন নয়, বরং তার বহুব্যবহারে ধর্মের মানুষের অভাব না হলেও মানুষের ধর্মের সংকট ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করে চলেছে। এখনও ধর্মীয় বিদ্বেষে দেশভাগের রাজনীতি বহাল তবিয়তে বেঁচে আছে, এখনও দেউলিয়া রাজনীতির ময়দানে ধর্মীয় পরিচয়ের বীভৎস উল্লাস নগ্ন হয়ে খেলা করে। ধর্মীয় ঐক্যে ভোটের রাজনীতি আর কতদিন চলবে,আর কত মানুষের ধর্ম বিপন্ন হলে মানুষের চেতনা ফিরবে, তার আজ মানবিক মূল্যবোধের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে!

Advertisement