• facebook
  • twitter
Wednesday, 30 July, 2025

সামাজিক নয়, অসামাজিক অপরাধ ‘ধর্ষণ’

নারীদের ধর্ষণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং হঠাৎ করে ধর্ষণের শিকার হলে নিজেদের বাঁচাতে পারে এমন আত্মরক্ষামূলক কৌশল শেখানো উচিত।

প্রতীকী চিত্র

হীরক কর

ধর্ষণ শুধু একটি মেয়ের ওপর নিপীড়ন নয়, বরং পুরো সমাজের ওপর আঘাত। ধর্ষণ মানুষের মৌলিক অধিকার ও সম্মান ভয়াবহভাবে লঙ্ঘন করে। তাই এটা সামাজিক অপরাধ বলা যায় না। বরং এটি অসামাজিক অপরাধ।

ইদানীং দেশে আশঙ্কাজনক হারে ধর্ষণের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কলকাতা কম কিসে; গত বছর আরজি কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, এবছর সাউথ কলকাতা ল’ কলেজ। এখন সারা ভারতে সংবাদ শিরোনামে।

শিশু থেকে ষাটোর্ধ্ব জননী কেউ হায়েনাদের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে ধর্ষণের বীভৎস চিত্র। ধর্ষণের ভয়াবহতায় মানুষ আঁতকে উঠছে।

ধর্ষণ নিয়ে সমাজের বদ্ধমূল ধারণা হলো, এটি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের জন্য সম্মানহানিকর। ফলে অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও মুখ খোলেন না। এমন ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। বিচারকার্যে দীর্ঘসূত্রতা সহ বিভিন্ন জটিলতা নিরসনে প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে হবে।

ধর্ষণের ভয়াবহতা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, নারী পারিবারিকভাবে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। একা একা বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে এমন বিভীষিকাময় ও অসহিষ্ণু অবস্থা দেখে যে কেউ আতঙ্কিত হতে পারে। ধর্ষণকারী শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, অনেক সময় ধর্ষণের পর ভুক্তভোগীকে নৃশংসভাবে হত্যা পর্যন্ত করছে। আরজি করের তিলোত্তমা তার প্রমাণ। এটা শুধু যে আইনশৃঙ্খলার ব্যর্থতা তেমনটা নয়, বরং নৈতিকতার চরম অবক্ষয়।

‘ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি’— ধারণাটি ভুল। ইন্টারনেটের হাটুরে ব্লগে, এনজিওদের সাইটে বা ধর্ষণ প্রতিরোধমূলক সামাজিক আন্দোলনের সাইটেও ‘রেপ ইজ আ সোশ্যাল ডিজিজ’ বাক্যটির বারোয়ারি প্রকাশ দেখা যায়। কিন্তু বিদ্বজ্জন কেন এই ভুল করবেন? বাংলায় লেখা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সমাজবিজ্ঞানের পাঠ্যবইয়েও এ ভুল আছে। যাঁদের এ ভুল করা মোটেই উচিত নয়, যেমন: সমাজবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান বা নারী ও জেন্ডার অধ্যয়নের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা, তাঁদেরও এ ভুল করতে দেখা যায়। সাংবাদিকেরা লিখছেন। ছাপছেনও। তাতে ‘সমাজের অসুখ’ ভাবটি বোঝানোর একটি চেষ্টা থাকে। যদিও এই অগভীর ভাবধর্মী (সাবজেক্টিভ) ধারণা নীতি-নৈতিকতা-মূল্যবোধের অসুখ বা স্খলনের দিকে ইঙ্গিত করে। তাহলেও ধর্ষণ মোটেই ‘সামাজিক ব্যাধি’ নয়। এ ভুলের তাৎক্ষণিক বিপদগুলো ভেবে দেখা দরকার।

ধর্ষণ তো সামাজিক নয়, অসামাজিক। ধর্ষণের শিকার হওয়া ইচ্ছাধীন নয়, ইচ্ছাবিরুদ্ধ। প্রকাশ্য নয়, গোপন। আনন্দের নয়, বেদনার। আইনি নয়, বেআইনি— এক কথায় অন্যায়-অনৈতিক-অধার্মিক-বেআইনি, সবই।

তা ছাড়া ‘সমাজ’ অনেক বড় ক্যানভাস। যুদ্ধে, জেলখানায়, থানায়, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা হেফাজতে, পুনর্বাসন কেন্দ্রে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ষণের ঘটনাগুলোর একেকটি অন্যটির চেয়ে আলাদা। শিশুদের যৌন বলাৎকার আরেক ধরনের নির্যাতন। ধনী-দরিদ্র, শিক্ষা-সুযোগ প্রাপ্ত-শিক্ষা-সুযোগ বঞ্চিত, ধর্মপ্রভাবযুক্ত-প্রভাবমুক্ত ইত্যাদি বর্গের ধর্ষণঝুঁকির তারতম্য আছে। গৃহকর্মী, আশ্রিতা নারী, ঘরের বাইরে কর্মজীবী নারী, কৃষিজীবী নারী, আদিবাসী নারী, শারীরিক ও বুদ্ধিপ্রান্তিক নারী, শহুরে মধ্যবিত্ত নারী, শিক্ষিতা মহিলাদের বেলায় ধর্ষণের অপঘাত ভিন্নভিন্ন রকম হতে পারে। পুরুষও কি ধর্ষণের শিকার হয় না? ‘সামাজিক ব্যাধি’ হলে ধর্ষণের এত বৈচিত্র্য ও রকমফের থাকত না।

ধর্ষণ একটি ভয়াবহ ‘অপরাধ’। জঘন্য এই অপরাধকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ বললে প্রকারান্তরে অপরাধটির লঘূকরণ ও নির্দোষকরণই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হতে পারে সমাজই যেন ধর্ষণের জন্য দায়ী। কিন্তু সমাজে ধর্ষণবিরোধী মানুষের সংখ্যাই বেশি এবং সমাজের সৃষ্টিই হয় ধর্ষণের মতো মারাত্মক অপরাধ যাতে না হয়, সে জন্য; ধর্ষণের মতো অপরাধের দায় নেওয়ার জন্য নয়। সোজা কথা, আইনমতে ধর্ষণ অপরাধ। অপরাধবিজ্ঞানের চোখে ধর্ষণ অপরাধ ও স্খলন (ক্রাইম অ্যান্ড ডেভিয়্যান্স)। সমাজবিজ্ঞানে ধর্ষণের কারণ ‘সামাজিক বিচ্যুতি’ (সোশ্যাল ডিজঅর্গানাইজেশন)।

অর্থাৎ ‘সামাজিক ব্যাধি’ কোনো বিজ্ঞানসম্মত ধারণাই নয়। ‘সামাজিক ব্যাধি’ বলা হলে বরং ধর্ষণের জন্য নারী দায়ী বা পোশাক দায়ী ধরনের পিতৃতান্ত্রিক আদি ও আদিম অভিযোগই প্রতিষ্ঠা পায়। ২০০৫ সালে সাফোক ইউনিভার্সিটি ‘ল রিভিউ’ জার্নালে ইলিন সেইডম্যান ও সুজান ভিকার্স ‘দ্য সেকেন্ড ওয়েভ: অ্যান অ্যাজেন্ডা ফর দ্য নেক্সট থার্টি ইয়ারস অব ল রিফর্ম’ শিরোনামের গবেষণা প্রবন্ধে এ রকম সিদ্ধান্তেই উপনীত হন যে, ধর্ষণই নয়, অযাচিত শারীরিক আগ্রাসনও (আনওয়ান্টেড ফিজিক্যাল অ্যাগ্রেশন) মারাত্মক অপরাধ। এটি প্রায় ধর্ষণেরই পূর্বপর্যায়। অনেকে একে সামাজিক সমস্যা বললে তাঁরা মানলেন না। সেইডম্যান ও ভিকার্স বললেন যে, অযাচিত শারীরিক আগ্রাসনকেও অপরাধ ঘোষণা করতে হবে এবং কঠোর নিরোধী আইন তৈরি করতে হবে। সে জন্য তাঁরা আইন সংশোধনও চান। ‘ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি’ লেখা এবং বলার মাধ্যমে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধকে লঘূকরণ করা বন্ধ হোক। এই চিন্তাটিই প্রতিষ্ঠিত হোক যে ‘ধর্ষণ সামাজিক ব্যাধি’ কখনোই নয়। অসামাজিক চূড়ান্ত শাস্তিযোগ্য অপরাধ হল ‘ধর্ষণ’।

২০১৮ সালে জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো ভারতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি ধর্ষণের খবর দিয়েছে। উপরন্তু, এনসিআরবি-এর তথ্য অনুসারে, দেশে একদিনে ৯১টি পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাই, এই পরিস্থিতি গবেষকদের এই ধরনের অপরাধের কারণগুলো অনুসন্ধান করার জন্য তাৎক্ষণিক মনোযোগ আকর্ষণের দাবি করে। বর্তমান গবেষণা ১৮ থেকে ২৫ বছর বয়সী ৩৭ জন পুরুষের ওপর করা হয়েছিল। যে গুরুত্বপূর্ণ মূল বিষয়গুলো উঠে এসেছে তার মধ্যে রয়েছে ধর্ষণের প্রতি মনোভাব, যৌন সীমাবদ্ধতা, পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য, পশ্চিমাকরণ, সামাজিক সহায়তার অভাব, শোষণ, আইনের প্রতি উপলব্ধি এবং মনোভাব, মানসিক প্রভাব এবং শৈশবকালীন মানসিক আঘাত। এই গবেষণায় বেশ কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে।
পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে উদ্ভূত বলে ব্যাখ্যা করা হয় যেখানে নারীদের পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে দেখা হয়। এর উৎপত্তি যাই হোক না কেন, ধর্ষণ একটি গুরুতর অপরাধ এবং বেশিরভাগ দেশেই সাধারণ আইন ব্যবস্থায় এটিকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক ধর্ষণের বিচারে, অভিযুক্তের অপরাধবোধ বা নির্দোষ তা নির্ভর করে ভুক্তভোগী কিনা তার ওপর। যৌন মিলনের জন্য সম্মতি। সম্মতি নির্ধারণ প্রায়শই কষ্টকর হতে পারে। আদালতে ধর্ষণের শিকারদের জেরা। ফলস্বরূপ, অনেক ধর্ষণের শিকার ব্যক্তি পুলিশে অপরাধের রিপোর্ট না করা বা তাদের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে অস্বীকৃতি জানান।

নানামুখী কারণে ধর্ষণের মতো এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। ধর্ষণের পিছনে যেসব কারণকে দায়ী করবো, তা হল নৈতিকতার অভাব বা অবক্ষয়, নারীদের সচেতনতার অভাব, দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি না দেওয়া, পারিবারিক ও সামাজিক প্রতিরোধের অভাব, সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার উদাসহীনতা ইত্যাদি। এরকম নানান কারণে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। লাঞ্ছিত হচ্ছেন নারীরা। এটি কারো একার পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা। ধর্ষণ প্রতিরোধে সর্বপ্রথম যা প্রয়োজন বলে মনে হয়, তা হল সকলের মধ্যে নৈতিকতাবোধ জাগরণ। কোনও ধর্মেই ধর্ষণের মতো কাজকে উৎসাহিত করা হয়নি। সুতরাং ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার উপর প্রবল গুরুত্ব দেওয়া উচিত। নৈতিকতাবোধ সৃষ্টি ও নৈতিক অবক্ষয় রোধ করার মাধ্যমে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব সৃষ্টিই পারে ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রধান ভূমিকা রাখতে।

এছাড়া নারীদের ধর্ষণ সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এবং হঠাৎ করে ধর্ষণের শিকার হলে নিজেদের বাঁচাতে পারে এমন আত্মরক্ষামূলক কৌশল শেখানো উচিত। অন্য আরেকটি ব্যাপার যা ধর্ষণ প্রতিরোধে অনন্য ভুমিকা রাখতে পারে, তা হল অভিভাবকের সতর্কতা। ধর্ষণ নিয়ে সমাজের বদ্ধমূল ধারণা হলো, এটি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারের জন্য সম্মানহানিকর। ফলে অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়েও মুখ খোলেন না। এমন ধারণার পরিবর্তন করতে হবে। সাহসী হয়ে থানায় আসতে হবে। পুলিশকে অভিযোগ জানাতে হবে। যেমনটা করেছে সাউথ ক্যালকাটা ল কলেজের মেয়েটি। তাকে ‘হ্যাটস অফ’।