• facebook
  • twitter
Tuesday, 18 March, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ প্রয়োগে ভাষার ধার বাড়িয়েছেন

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তা ছাড়া সকলের মুখে একই রকমের বাক্চাতুর্য বেশ একটু বেমানান ঠেকে। ‘চার অধ্যায়’ কাহিনীর অন্যতম চরিত্র কানাই গুপ্ত। তিনি পুলিশের দারোগা। এলাকে বলছেন— ‘‘অলকানন্দা তৈল পাঁচ পিপে তৈরি করে রেখেছি। মহাদেবের জটা নিংড়ে বের করা। একটা সার্টিফিকেট দিয়ো বৎসে, বলো, অলকা তেল মাখার পর থেকে চুল বাঁধা একটা আপদ হয়েছে, দীর্ঘায়মানা বেণী সামলে তোলা স্বংয় দশভুজা দেবীর দুঃসাধ্য।’’ ইন্দ্রনাথের মুখে যে কথা মানিয়ে যেত কানাই গুপ্তর মুখে সে কথা বা ভাষা ঠিক মানানসই নয়। অমিত রায়ের বোনেরা বলেছিল, ও সকালে উঠেই সারা দিনের জন্যে শানিয়ে বলা কথা বানিয়ে রেখে দেয়। এ ভাষাও তেমনি বানানো, স্বতঃস্ফূর্ত নয়। তবে এ কথা মানতে হবে যে ভাষার বাক্চাতুর্য এবং wit-এর ক্ষমতা তিনি শত গুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন।

রবীন্দ্রযুগে প্রমথ চৌধুরী এক নতুন গদ্যরীতির প্রবর্তন করেছিলেন। আজ যে আমাদের গদ্য রচনায় সাধু ভাষার ব্যবহার বলতে গেলে উঠেই গিয়েছে এবং কথ্য ভাষাকেই সাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে—এর মূলে প্রমথ চৌধুরী। তিনি এ নিয়ে রীতিমতো একটি আন্দোলন চালিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথকেও দলে টেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত হয়েও প্রমথবাবু গদ্যে পদ্যে কোথাও রবীন্দ্রনাথের পদাঙ্ক অনুসরণ করেননি। লিখেছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে, এক সময়ে সেটা বীরদলী ঢং বলে পরিচিত হয়েছিল। প্রমথবাবু ছিলেন ফরাসি ভাষায় সুপন্ডিত, ফরাসি সাহিত্যের অনুরাগী, ভলটেয়ার-এর বিশেষ ভক্ত। ভলটেয়ার-এর ভাষা সম্পর্কে প্রমথবাবু বলেছেন— ‘লঘু, তীক্ষ্ণ, চোস্ত, সাফ।’ এই সব ক’টি বিশেষণই প্রমথ চৌধুরীর গদ্য রচনা সম্পর্কে ন্যায্য ভাবে প্রযোজ্য। ভাষায় কোথাও ঢিলেঢালা ভাব নেই, যেমন আঁটসাট সুঠাম দেহ তেমনি বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল মুখশ্রী। যুক্তিবাদী, বুদ্ধিজীবী মানুষ—বাক্য সংযত সংহত। ভাষা জিনিসটা স্বভাবতই মুখর; বীরবল মুখের ভাষাকে তুখোড় করবার চেষ্টা করেছেন।

সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ প্রয়োগে ভাষার ধার বাড়িয়েছেন, wit এর চুমকি বসিয়ে পাঠকের মনে চমক লাগিয়েছেন। প্রবন্ধ ছেড়ে যখন গল্প লিখেছেন তখনও রচনাচাতুর্যে যথেষ্ট চমকের সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু প্রমথবাবুর গুণগ্রাহী পাঠকরাও স্বীকার করবেন যে তাঁর রচনায় বুদ্ধিবৃত্তির ছাপ যতখানি হৃদয়বৃত্তির ছাপ ততখানি নয়। প্রবন্ধের বেলায় সেটা বেশ মানিয়ে গিয়েছে; কিন্তু প্রবন্ধসাহিত্য এবং কথাসাহিত্যের মেজাজ এক নয়। গল্পে উপন্যাসে হৃদয়বৃত্তিকে যথাযোগ্য স্থান দিতে হয় নতুবা মনুষ্য চরিত্রের প্রতিই অবিচার করা হয়। প্রমথবাবু হৃদয়াবেগকে সযত্নে পরিহার করে চলেছেন। এর ফলে তাঁর গল্পে আর্দ্রতার অভাব। সময়ের ব্যবধানে এ জিনিস brittle হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। এখনই তা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধের পাঠক এখনও প্রচুর। কিন্তু গল্পের পাঠক খুব বেশি নেই।

আমাদের ‘রস’ কথাটি বড় সুন্দর; কথাটির মধ্যেই একটু আর্দ্রতার আভাস আছে। যেখানে রসবৃষ্টি সেখানে হৃদয় আপনা থেকেই দ্রব হয়, সেজন্যে ভাষাকেও একটু আধটু বিগলিত না হলে চলে না।

(ক্রমশ)