• facebook
  • twitter
Thursday, 13 February, 2025

বাংলা গদ্যের ইতিবৃত্ত

যাঁরা একদিন তাঁর মুখের কথা শুনে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা আজ তাঁর লেখা পড়তে গেলে সেই কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পাবেন এমনি জীবন্ত তাঁর ভাষা।

ফাইল চিত্র

হীরেন্দ্রনাথ দত্ত

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তবে স্বীকার করতে হবে রবীন্দ্রযুগে যে গদ্যরীতি লেখক মহলে চালু ছিল তাঁরা সেই বাঁধা সড়কেই চলেছেন। এখানে ওখানে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করেছেন, এ ছাড়া ভাষার বিশেষ কোন নতুনত্বের আমদানি তাঁরা করেন নি। এদিক থেকে এক বিশিষ্ট ব্যতিক্রম বলতে হবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের পরিবারভুক্ত, তাঁর একান্ত স্নেহের পাত্র কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গদ্যরীতিতে এবং অবনীন্দ্রনাথের গদ্যরীতিতে বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই। অবনীন্দ্রনাথ রসরাস, কিন্তু ভাষার বেলায় তিনি রাজপথের পথিক নন. তিনি চলেছেন নিজের তৈরি নিজের পায়ে চলা পথে।

তিনি একেবারেই একলা পথের পথিক। এ পথে দুজনে চলবার মতো প্রশস্ত স্থান নেই। অর্থাৎ কিনা এ বাচন ভঙ্গি অনুকরণসাধ্য নয়. এ ভাষা একান্ত ভাবেই তাঁর নিজস্ব ভাষা—তাঁর মুখে বলা ভাষা। যাঁরা একদিন তাঁর মুখের কথা শুনে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা আজ তাঁর লেখা পড়তে গেলে সেই কণ্ঠস্বর আবার শুনতে পাবেন এমনি জীবন্ত তাঁর ভাষা। এই তো দেখুন না, নিজের পরিচয় দিচ্ছেন—‘কোন্ ঠাকুর? না, অবন ঠাকুর, যে ছবি লেখে।’

ছবি লেখা! তাহলেই দেখুন, একমাত্র অবনীন্দ্রনাথই ছবি লিখেছেন, আর সবাই ছবি এঁকেছেন। ওদিকে আবার যখন কলম দিয়ে লিখতে বসেছেন তখন মনে হয়েছে ছবি আঁকছেন। নানা কাহিনীতে, নানা বর্ণনায় রং-এর ছড়াছড়ি— মনে হবে কলম দিয়ে লেখেন নি, তুলি দিয়ে লিখেছেন। অতুল গুপ্ত মশায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের গদ্য মহাকবির গদ্য; অবনীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে তেমনি বলা চলে, অবনীন্দ্রনাথের গদ্য মহাশিল্পীর গদ্য। যা কিছু বলেছেন, লিখেছেন— তা যত সামান্য বিষয়ে হোক্—প্রতিটি বাক্যে শিল্পীজনোচিত কারুকার্য প্রকাশ পেয়েছে।

একটু নমুনা দিচ্ছে, বালক বয়সের বর্ষা দিনের স্মৃতিচারণ—‘‘সারারাত সাতদিন ঝমাঝম। মটর ভাজি কড়াই ভাজি ভিজে ছাতি। যেদিকে চাও ভিজে শাড়ি পরদা টেনে হাওয়ায় দুলছে, তারই তলায় বেড়ানো সারাদিন। সন্ধ্যে থেকে কোলা ব্যাঙ বাদ্য বাজায় রাজ্যের মশা ঘরে সেঁধোয় টাকাং দিং টাকাং দিং মশারি ঘিরে। দাসী চাকর সরকার বরকার সবার মাথায় চড়ে গোলপাতার ছাতা।…ছেলে বুড়ো মিলে গান গল্প, বাবু ভায় মিলে খোস গল্প—আরো কত কি মজা, আঠারো ভাজা, জিবে গজা। গুড়গুড়ি ফরসি দাদুরীর বোল ধরছে গুড়ুক ভুড়ুক।’’

(ক্রমশ)