• facebook
  • twitter
Monday, 5 May, 2025

সিন্ধু জল-চুক্তি বাতিলে পাকিস্তানের আদৌ কোনও ক্ষতি হল কি?

বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আগে আরও ২ বার এই চুক্তি বাতিলের চেষ্টা হয়েছিল – ২০১৬ ও ২০১৯ সালে।

ফাইল চিত্র

পুলক মিত্র

জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে সাম্প্রতিক জঙ্গি হামলায় ২৬ জন হিন্দু পর্যটক সহ ২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনায় গোটা দেশ ক্ষোভে ফুঁসছে। অতীতে বিভিন্ন সময়ে উপত্যকায় জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু এবারের হামলার সঙ্গে তার পার্থক্য হল, এই প্রথম ধর্মীয় পরিচয় জেনে বেছে বেছে হিন্দু পর্যটকদের হত্যা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইতিমধ্যেই হুঙ্কার দিয়ে বলেছেন, এর জবাব এমনভাবে দেওয়া হবে, যা কল্পনাতীত।

এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর যে প্রশ্নটি বিশেষভাবে উঠে আসছে, তা হল, ৫ অগাস্ট, ২০১৯-এ সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির পর জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তা পরিস্থিতির আদৌ কোনও উন্নতি ঘটেছে কি?

৩৭০ ধারা বাতিলের পর হিংসা কমেছে কি?
২০১৯-এর অগাস্ট মাস থেকে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণভার পুরোপুরি নিজেদের হাতে তুলে নেয়, যদিও সে সময় ওই রাজ্যে ক্ষমতার ছিল নির্বাচিত সরকার। চলতি মাসের ৮ এপ্রিল শ্রীনগরে যে উচ্চ-পর্যায়ের বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ জম্মু-কাশ্মীরের নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলির প্রস্তুতি পর্যালোচনা করেছিলেন, সেখানে ডাকা হয়নি ওই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহকে। কেন্দ্রীয় সরকার হামেশাই “জিরো টলারেন্স” বা শূন্য সহনশীল নীতির সাফল্যের কথা তুলে ধরে থাকে। গত বছরের জুলাই মাসে লোকসভায় এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছিল, ২০১৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে জঙ্গি হামলার ঘটনা (২২৮ থেকে ৪৬), সাধারণ মানুষের মৃত্যু (৫৫ থেকে ১৪) এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মৃত্যু (৯১ থেকে ৩০) উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা কেন্দ্রের কৌশলের সাফল্যের বার্তা দিচ্ছে।

তবে সাউথ এশিয়া টেররিজম পোর্টাল (এসএটিপি)-এর পরিসংখ্যান অন্য ইঙ্গিত দিচ্ছে। ওই পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, সন্ত্রাসবাদ-সংক্রান্ত ঘটনাবলী ২০১৮-র ৫৯৭ থেকে ২০১৯ সালে ৩৬৯-এ নেমে এলেও, ৩৭০ ধারা বাতিলের পর সেখানে হিংসা বেড়েছে। ২০২০-তে জঙ্গি হামলার ঘটনার সংখ্যা ছিল ৪১৫টি, ২০২১-এ তা পৌঁছে যায় ৪৬০-এ। এরপর থেকে অবশ্য এ ধরনের ঘটনা কমতে থাকে। যেমন ২০২২-এ ৪৫৭, ২০২৩-এ ২৬৭ এবং ২০২৪-এ ২১০-এ নেমে আসে। এসএটিপি-র পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত হিংসার ঘটনার সংখ্যা ছিল ৫৬টি।
এবার আসা যাক, মৃত্যুর পরিসংখ্যানে। ২০১৯-এ ৭৮, ২০২০তে ৫৬, ২০২১-এ ৪৫ এবং ২০২২-এ ৩০, ২০২৩-এ ৩৩ এবং ২০২৪-এ ২৬ জনের মৃত্যু হয়। যাই হোক, পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট, ৩৭০ ধারার অবলুপ্তির পর জম্মু-কাশ্মীরের নিরপত্তা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে খুব বড়সড় কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। অর্থাৎ, এই ধারা বাতিলের ৬ বছর পরও উপত্যকায় শান্তি ও স্থিতিশীলতা স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে।

সিন্ধু জল-চুক্তি
পহেলগাঁওয়ে হামলার জেরে সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল করেছে ভারত। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে করাচিতে ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু এবং পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সিন্ধু জল চুক্তি। এই চুক্তিতে মধ্যস্থতা করেছিল বিশ্ব ব্যাঙ্ক। চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু এবং তার দুই উপনদী, বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জলের উপরে বেশি অধিকার ও কর্তৃত্ব থাকবে পাকিস্তানের। অর্থাৎ সিন্ধু ও এর উপনদী-শাখা নদীগুলির জলের ওপরে পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ এবং ভারতের ২০ শতাংশ অধিকার থাকবে।
অন্যদিকে, সিন্ধুর অন্য তিন উপনদী— বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সুতলেজ) এবং ইরাবতীর (রাভি) জলের উপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এই চুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল, ভারত বা পাকিস্তান নিজেদের প্রয়োজনে ওই জল ব্যবহার করলেও, কোনও অবস্থাতেই জলপ্রবাহ আটকে রাখতে পারবে না। পাকিস্তানের দিকে যে তিনটি নদী বয়ে গিয়েছে, সেই নদীগুলির জল মূলত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। এই জলকে সংরক্ষণ করার অধিকার ভারতের সেভাবে নেই।

বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত রাখার ফলে, পাকিস্তানের ৬০ শতাংশের বেশি মানুষের ওপর তার প্রভাব পড়বে। যে সব এলাকা দিয়ে এই নদীগুলি গিয়েছে, সেখানকার ৮০ শতাংশ কৃষিকাজ এগুলির জলের ওপর নির্ভরশীল। জলচুক্তি স্থগিত হওয়ায় কৃষিকাজ ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি শহরের যে সব এলাকা দিয়ে সিন্ধু ও তার শাখানদী, উপনদীগুলি বয়ে গিয়েছে, সেখানকার অর্থাৎ করাচি, লাহোর, মুলতানের মানুষ পানীয় জলের সঙ্কটে পড়বেন। এছাড়া, পাকিস্তানের সিন্ধু অববাহিকায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

চুক্তি স্থগিতে পাকিস্তানের আদৌ ক্ষতি হবে কি?
সিন্ধু জলচুক্তি বাতিল হওয়ার পর ভারতের মিডিয়া মোদির স্তুতিতে মেতে উঠেছে। ভাবটা এমন, দেখলেন, পাকিস্তানকে কেমন শাস্তি দিলেন মোদি। হাতে না মেরে একেবারে ভাতে মারার কৌশল। প্রথম প্রথম তাই মনে হয়েছিল। যাকে বলে, একেবারে মোক্ষম জবাব।

কিন্তু আদৌ কি তাই? সিন্ধু জলচুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ৬টি নদী। চুক্তি অনুসারে, পূর্ব মুখী ৩টি নদী শতদ্রু, ইরাবতী ও বিপাশা ভারতের। পশ্চিমমুখী ৩টি নদী – সিন্ধু, ঝিলম আর চেনাবের জল পাকিস্তানের। এগুলিতে জলের পরিমাণ ৮০ শতাংশ। আর পূর্বের নদীগুলিতে জলের পরিমাণ ২০ শতাংশ।

পাকিস্তানকে যদি পশ্চিমমুখী নদীগুলির জল দেওয়া বন্ধ করতে হয়, তবে ভারতকে বাঁধ দিতে হবে। নদীগুলি সবই হিমালয়ের। ওই উচ্চতায় বাঁধ বসানো কতটা কঠিন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। এছাড়া, বাঁধ তৈরি এক বা দুই দিনের কাজ নয়, তার জন্য প্রচুর সময়, অর্থাৎ বেশ কয়েক বছর সময় লেগে যাবে। অর্থাৎ এই জলচুক্তি বাতিল করে পাকিস্তানকে শাস্তি দিতে গেলে, অন্তত পাঁচ বছর সময় লেগে যাবে।

আরও বড় প্রশ্ন হল, এই বাঁধ দিয়ে কী কাজ হবে? বিদ্যুৎ উৎপাদন কিংবা সেচের জল সরবরাহ? বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী সেটি কিন্তু ভারতের পক্ষে করা সম্ভব। ওই তিনটি নদীতে বাঁধ দেওয়া অত্যন্ত ব্যয়সাপেক্ষ কাজ। এছাড়া আশেপাশে খুব বেশি চাষাবাদের জমি নেই। তাই বাঁধের খরচ বাস্তবসম্মত হবে না। ব্যবসায়িক দিক থেকে এই বাঁধ তৈরিতে ভারতের লাভ হবে না। অর্থাৎ বাঁধ তৈরি করা হলে, তা হবে, নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করার মতো। তবে বাঁধ দিয়ে ভারতের লাভ না হলেও, পাকিস্তানের ক্ষতি হবে। তার জন্য সময় লাগবে ৫ থেকে ১০ বছর। ততদিন জল কোন দিকে গড়াবে বলা কঠিন।

শুধু এবার নয়, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর আগে আরও ২ বার এই চুক্তি বাতিলের চেষ্টা হয়েছিল – ২০১৬ ও ২০১৯ সালে। এবারের মতোই আগের দুবারও পাকিস্তান হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিল, তারা একে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখছে। তাই প্রশ্ন উঠছে, পাকিস্তানকে কি এভাবে শাস্তি দেওয়া যাবে? এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৬৪, ১৯৭১ এবং ১৯৯৯-এ ভারত-পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ হয়েছে। তখনও এই চুক্তি বাতিলের কথা ওঠেনি। কারণ, ভারত বুঝেছিল, এতে লাভের লাভ কিছু হবে না।

অন্যদিকে, বদলা হিসেবে পাকিস্তান সিমলা চুক্তি স্থগিত ও ভারতের উড়ান সংস্থাগুলির জন্য সেদেশের আকাশ সীমা নিষিদ্ধ করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যুদ্ধের পর ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি মূলত একটি শান্তিচুক্তি, যার আওতায় নিয়ন্ত্রণরেখার দুই তরফে শান্তি বজায় রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয় দুই দেশ। ১৯৭২ সালের ২ জুলাই, হিমাচলপ্রদেশের সিমলায় ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকর ভুট্টোর মধ্যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত-পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত্তি হিসেবে গণ্য হয় এই চুক্তি। এর ফলে যুদ্ধ ভুলে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সৌজন্য বজায় রাখার পাশাপাশি, সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে শান্তি টিকিয়ে রাখতে সম্মত হয় দুই দেশ। এই চুক্তি আপাতত বাতিল হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে চলেছে।

অন্যদিকে, পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় ক্ষতির মুখে পড়েছে ভারতীয় উড়ান সংস্থাগুলি। উত্তর ভারতের বিভিন্ন শহর, যেমন, দিল্লি, অমৃতসর, লখনউ, বারাণসী এবং জয়পুরের মতো শহরগুলি থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমমুখী যে কোনও দেশে যাওয়ার সময় পাকিস্তানের আকাশ ব্যবহার করত ভারত। এয়ার ইন্ডিয়া, ইন্ডিগো, এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস এবং স্পাইসজেটের মতো সংস্থাগুলি এই রুট দিয়ে আন্তর্জাতিক বিমান চালায়। কারণ, এই রুট ব্যবহার করলে, অন্তত ১ ঘণ্টা সময় বাঁচে, জ্বালানির খরচও কমে। এখন সেসব বিমান বাধ্য হচ্ছে বিকল্প পথ বেছে নিতে। এর ফলে বাড়বে বিমান ভাড়াও।

তাই পাকিস্তানকে বাগে আনতে হলে, ভারতকে অন্য কিছু ভাবতে হবে। সরাসরি যুদ্ধের পথ, নাকি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক, কোন পথে হাঁটবে? পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে, তার ফলাফলও ভাবতে হবে। কারণ, যুদ্ধে নামলে, দেশের অর্থনীতিতে তার ব্যাপক পড়বে।