অধুনা শুল্কের হুমকি ট্রাম্প সাহেবের। পৃথিবী ব্যাপী তো এখন এটাই লেটেস্ট রাজনৈতিক স্ট্যান্ট। চুক্তি চাই। চুক্তি চাই। অবাধ্য হলেই কড়া সবক শেখানো হবে। শতগুণ চক্রবৃদ্ধির শুল্ক ঘানিতে। বিশ্বের বহু দেশতো এমন ঘোষণায় হুজুর হুজুর করতেই ব্যস্ত। কিন্তু ভারতের তো এসব নিয়ে হুঁসই নেই। হলোটা কি?
অতুলপ্রসাদ সেনের রচিত সেই ছত্রগুলো আজকের দুনিয়ায় কি প্রবল প্রাসঙ্গিক তাই না? মনে পড়ে যায় সেই কালদর্শিত কলম আঁচরগুলো। ‘বলো, বলো, বলো সবে, শত বীণা বেণু রবে, ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে। ধর্মে মহান্ হবে, কর্মে মহান হবে, নব দিনমণি উদিবে আবার পুরাতনে পূরবে।’
Advertisement
আজকের ভারত তো অতুলপ্রসাদ সেনের সেই চেতন প্রতিফলনের বাস্তব রূপ। নইলে পৃথিবীর তথাকথিত স্বঘোষিত দাদা দেশগুলো ভারতের প্রতি এতো ঈর্ষান্বিত হতে যাবেই বা কেন খামোখা?
Advertisement
আজ তামাম দুনিয়ার কাছে এই স্পর্শকাতর বিষয়টাই অনেক বড় আকারে পরিণত হয়েছে। অগ্রগতির চরাচরে ভারত যেখানে অগ্রপথিককের বেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, সেখানে দ্বিচারিতার আত্মলেহনে নিজস্ব ইতিবাচক আদর্শকেও বর্জন করতে কসুর করতে ছাড়ছে না ইউরোপীয়, ইউরো এশীয় এবং এশীয় মুরুব্বি রাষ্ট্রগুলো। আসলে তাদের বড় বুক জ্বালা ভারতের সার্বিক বিশ্ব শিরোপার নিপুণ হাসিলে।
অবশেষে বিশ্ব দ্বিচারিতার বিরুদ্ধে প্রশ্নটা কিন্তু কিছুতেই দমানো গেল না। তারজন্য যতই উল্টো দিকের নীরব উপেক্ষা ধেয়ে আসুক না কেন
এই প্রশ্নটা আসলে ভারত আত্মার অন্তরে বাহিরে। প্রশ্নকর্তা অবশ্যই একজন প্রবীণ সম্পাদক সাংবাদিকের। তিনি আর কেউ নন। দেশবরেণ্য ওজনদার অকুতভয় কলামিস্ট এম জে আকবর। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও বটে। প্রশ্নটি এরকম, ‘ভারতে সন্ত্রাস ঘটলে পশ্চিমী দুনিয়া চুপ করে যায় কেন? জঙ্গিপনার বিরুদ্ধে পশ্চিমী দেশগুলো দুই মুখো নীতি নিয়ে চলে কেন?’
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসের মঞ্চ থেকে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এম জে আকবর এই প্রশ্নগুলো ছুড়ে দিয়েছিলেন বাকি বিশ্বের নানা প্রান্ত বিভিন্ন প্রান্তিকে। কিন্তু অদ্ভুত বিস্ময়কর বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক দুয়ারে যখন প্রশ্নগুলো তুলে ধরা হয়েছে ঠিকই তখন তার অনুররণ মার্কিন দাদাগিরির হোয়াইট হাউস থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর ব্রাসেলসে অবশ্যই কড়া নেড়েছে, এতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু এই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আরও একটা সন্দেহাতীতভাবে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন উঠে গেল, ভারতের মনে সন্দেহ জাগা এই প্রশ্নের উত্তর কি পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর অজানা? নাকি সব জেনেও অজানার ভেক সেজে থাকছে বাকি দেশগুলো?
অপারেশন সিঁদুর আপাতত স্থগিত রাখার পর দেশের সাতটি সংসদীয় দল সারা বিশ্বের ৩২ টি দেশে ভ্রমণ করে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট ভাবে ব্যাখা করেছে। এরমধ্যে প্রবীণ সাংবাদিক এম জে আকবরের তোলা এই প্রশ্ন সূচক বক্তব্য সমস্ত ভারতবাসীর হৃদয়কে ছুঁয়ে গেছে। আর বাকি দুনিয়াবাসী মুখটাকে টেনে এনে একটা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে তিনি দীপ্ত কন্ঠে বলতে পেরেছেন, এই দেখ তোমাদের দুমুখো সত্ত্বাটা। ভালো করে আরও একবার তোমরা নিজেদের চিনে নাও।
বিজেপি সাংসদ রবিশঙ্করের নেতৃত্বে সংসদীয় দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে এম জে আকবর গিয়েছিলেন বেলজিয়াম, জার্মানি, ফ্রান্স, ডেনমার্ক, ইতালিতে। এই সফরকালেই তিনি সরাসরি প্রশ্ন তোলেন, ‘ভারত আদৌ প্রতিহিংসা পরায়ণ দেশ নয়। আমাদের দেশ চিরকালীন শান্তিতে বিশ্বাসী। সারা বিশ্বকে শান্তির পথ এতকাল দেখিয়ে এসেছে এই ভারত। কিন্তু ভারতেরও তো আত্মরক্ষার অধিকার আছে। এটা কেন বাকি দুনিয়া বুঝতে চাইছে না। আমাদের দেশ জঙ্গির নিশানা হলে আমাদের ন্যায় বিচার চাওয়ার দাবি তো থাকবেই।’
যুগান্তকারী এই অসাধারণ বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘আমরা তো ইউরোপীয় দেশগুলোর স্বার্বভৌমত্বকে সম্মান করি। তাদের গণতান্ত্রিক প্রশ্নগুলোকে যথাযথ মর্যাদা দিই। তাহলে এই পৃথিবীতে দুটো আইন চলতে পারে কোন অধিকারে? পাকিস্তানের আশ্রিত সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রশ্নে জঙ্গি হানায় বিক্ষত ভারতকে সংযমী হতে বলে বাণিজ্য সম্পর্ক টেনে চাপ দেওয়া হয়েছে। আবার সেই আমেরিকা নিজেদের বিধ্বস্ত টুইন টাওয়ারের বদলা নিতে ১২ হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছিল আফগানিস্তানকে সবক শেখাতে। আর পাকিস্তানের মাটিতে পাঁচশো কিলোমিটার কম দূরত্বে আমাদের দেশ জঙ্গিদের নিশানা করলে ভারতকে নিরস্ত্র থাকার আবেদন জানানো হচ্ছে। এটা কেমন দ্বিতত্ত্বের দুনিয়া।’
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা প্রথিতযশা কলামিস্টের এই দুনিয়া কাঁপানো প্রশ্নের প্রেক্ষাপটে সংসদীয় দলের প্রধান রবিশঙ্কর জানান, আমরা সারা বিশ্বের কাছে জানতে চাই যাঁরা জঙ্গির আক্রমণের শিকার হয়েছেন তাঁদের কি মানবাধিকার প্রাপ্তির অধিকার আছে? ভারত আদতে কিন্তু সংযমী রাষ্ট্র। এবার বিশ্ববাসীর জবাব দেবার সময় উপস্থিত।’
কিন্তু ‘কি তার জবাব দেবে যদি বলি আমি কি হেরেছি! তুমিও কি একটুও হারোনি।’ না আমি বলতে ভারতবর্ষ আজ কিন্তু হারিনি। বরং সংযমে, নৈতিকতায়, আত্মরক্ষায় আমরা আজ বিজয়ী। আর তুমি? পাকিস্তানের পক্ষ নেওয়া হে পশ্চিমা তোমরা আজ দুই আইনের ধামা ধরে নিঃশ্চুপ, তোমরা ঈর্ষাকাতর সুবিধাবাদী। তাই তোমরা এখন পরাজিত পাক পক্ষপাতিত্বের একেকজন নিঃশ্চুপ প্রতিনিধি মাত্র।
হ্যাঁ তোমরা ঈর্ষাকাতরই। তাইতো ভারতীয় একজন সাংবাদিক বুক চিতিয়ে প্রশ্নটা সঠিক জায়গায় উত্থাপন করে এসেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতর ব্রাসেলসের মাটিতে দাঁড়িয়ে। তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কমিশনের সভাপতি উরসুলা ভন ডের লেইন এখনও চুপ কেন? কথা কও কথা কও। আর কথা কও! একটাই অকথিত উত্তর, ভারতের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণতা।
আজ ভারত স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৭৮তম বছরের দোড় প্রান্তে দাঁড়িয়ে। আজকের ভারত সে তার অতীতের যাবতীয় দ্বিধাগ্রস্ত ভারতের ছায়া মাত্র। ১৯৯১ সালে ভারত অর্থনৈতিক উদারীকরণের ডাক দিয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বে। অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ক্যারিশমায়। ভারতীয় মিশ্র অর্থনীতির নেহরু চেতনার অঙ্গনে যেন হঠাৎ শুরু হওয়া এক লপ্তের বিশ্বায়ন উদারনীতির দক্ষিণা বাতাস। এটাই হলো নব ভারতের প্রথম অভিযাত্রা আগামীর লক্ষ্যে। বিবিধের মধ্যে আর্থিক সতন্ত্রতার অভিসারে।
সেই শুরু এগিয়ে চলার পথে সওয়ার হবার। ধীরে ধীরে শ্রেষ্ঠত্বের স্বপ্নপূরণে। তারপর ১৯১৪ সাল থেকে উদারীকরণের পথে কালো ঘোড়ার দুরন্ত সাহসী দৌড়ের বাজি ধরলেন নরেন্দ্র মোদী। দৌড়ের তুরুপের তাস হিসেবে ট্রাম্পকার্ড সামনে নিয়ে এলেন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া।’ এরপর আর ভারতকে পিছিয়ে তাকাতে হয়নি। বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারত আজ একদম প্রথম সারির থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। অর্থনৈতিক দিক থেকে জাপানকে পিছনে ফেলে ভারত আজ চতুর্থ বিত্তশালী দেশ। সামরিক ক্ষেত্রে এই দেশ আজ চতুর্থ শক্তিধর রাষ্ট্র। বাণিজ্যের ময়দানে আমেরিকার শুল্ক বৃদ্ধির একচেটিয়া দাদাগিরির পাল্টা ভারতীয় শুল্ক মাশুলে অতিরিক্ত অঙ্ক চাপিয়ে দেওয়ার হিম্মত, স্বদেশে তৈরি সামরিক অস্ত্র বিদেশে রপ্তানির নয়া উদ্যোগ আজ যে বহু পশ্চিমা দেশের আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছে আজকের ‘জয় হো’ ভারত।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সে আজ ভারত পশ্চিমার চ্যালেঞ্জ। মেধায় আজ ভারত পশ্চিমার নতমস্তকের। উন্মুক্ত বাজারে আজ ভারত পশ্চিমার হিংসা। আভ্যন্তরীণ ব্যুরোক্রাটের সম্মিলিত সাফল্যে আজ ভারত পশ্চিমার হতবাক। এরসঙ্গে ককটেল পাঞ্চ হয়েছে ভারতের অধুনা জাতীয়তাবোধ। শেষ একটা দশকে ভারতবাসীর মধ্যে একটা অতিরিক্ত মাত্রায় তীব্র জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটতে দেখা গেছে। যা ভারত অগ্রগতির পালে বাড়তি হাওয়া যুগিয়েছে অনায়াস ছন্দে।
সুতরাং ভারতের সর্ব আঙ্গিকের এই উচ্চ যেথা শির অনেক পশ্চিমা দেশের শিরঃপীড়া কারণ হয়ে উঠেছে। ফলে অস্তিত্ব সঙ্কট জনিত ঈর্ষা যে আজ কিছু ইউরোপীয় দেশের ভারতীয় অ্যালার্জিতে পরিণত হয়েছে স্বাভাবিক কারণেই। মনে রাখতে হবে, অধুনা অ্যাপেল কর্তা এবং টেসলা বা স্পেসএক্সের মালিক আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মুখের উপর বাণিজ্যিক চপেটাঘাত করে অধুনা ভারত বন্দনায় মশগুল।
অগত্যা কি আর করারই বা আছে। সুতারাং ‘ঝিকে মেরে বৌকে শেখানো’র মতো ঈর্ষান্বিত পশ্চিমী দেশগুলো আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র জঙ্গিদের বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানের পিঠ চাপড়াতে ব্যস্ত। অন্তত দইয়ের বদলে ঘোলেই ডুবে থাকা যাক আপাতত। কিন্তু সাবধান, উগ্রপন্থা কখনও কারও পোষ্য হয় না। তারা শুধু লালিত হয়। একটু দয়া করে ‘৯/১১’র ঘটনাকে দয়া মনে রাখবেন তথাকথিত একদা তালিবানের মদতপুষ্টেরা।
আর ভারত? কোনও ঈর্ষার মাপকাঠিতে ভারতকে রোখা যে যাবে না বস্। সুচনার সুচনাটা নরসীমা রাও করে গেলেও আজকের এই দেশটি যে মোদীর ভারত। হে বিশ্ববাসী তোমাদের কোনও প্রশ্নের উত্তর আর দয়া করে দিতে হবে না, বিলিভ মি। শুধু তোমরা সমস্বরে বলো ‘জয় হিন্দ।’
দেশের অভ্যন্তরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কঠোর সমালোচনায় সর্বদাই সরব থাকেন বিরোধী দলগুলো। অথচ তাঁর দাপুটে নেতৃত্ব বিশ্বব্যাপী সকল রাষ্ট্রনেতাদের মাথা ঝোঁকানো তীব্র সমীহ একইসঙ্গে আদায় করে নেয় অহরহ। আসলে এটাই বৈচিত্র্যের ভারত। যার অভ্যন্তরীণ মতাদর্শে গণতন্ত্রই সর্বাপেক্ষা সম্মানিত। আর বহির্জগতের উঠোনে আমরা দেশজ ঐক্যের মহামিলনে একাকার। কি জাতীয়তার প্রসঙ্গে। কি বৈদেশিক নীতির প্রসঙ্গে। বহির্দুয়ারে দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ মন্ত্রে অধুনার ভারত যে নৈতিক ভাবে দীক্ষিত। দাদাবাজের দুনিয়া তো তাই দ্বিতাত্ত্বিক নীতি নিয়ে চলতে বাধ্য হবেই। নিপাতনে সিদ্ধ নিমপাতা গেলার মতো জঙ্গিবাদ নিয়ে এক চোখ খুলে তো রাখবেই। কারণ তাদের কাঙ্খিত দুনিয়া প্রভুত্বের পঞ্চমুন্ডির আসনে মেরা ভারত মহান যে অনিবার্য ভাবেই আজ প্রবল রূপের নয়া উচ্চ যেথা শির।
তাই এম জে আকবররা বিশ্বের দিকে আঙ্গুল তুলে চোখা প্রশ্ন করবেই। এবার থেকে এটাও যে দুনিয়ার সন্মুখে নয়া ভারতের তুলে ধরা একটা নতুন প্রশ্ন যুগের প্রবর্তন। আর বাকি পৃথিবীর নিঃস্তব্ধতায় একটি প্রবাদ কী অদ্ভুতরকমের বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে আজকাল, যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা। তাই তো ট্রাম্প সাহেব? আপনার তো আবার জঙ্গিপ্রেমী পাকিস্তানের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন দরদ বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়। পাকিস্তানের স্বার্থই যেন আপনার নিজস্ব স্বার্থে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে, অন্তত শান্তিকামী ভারত যখন নিজস্ব আত্মরক্ষার তাগিদে উল্টো পথের সওয়ারে ব্যস্ত থাকে।
একটা কথা আপনাকে মনে করিয়ে দিই কেমন, আজকের ভারত নিজের স্বার্থটা আগে যাচাই করতে শিখে গেছে! সে আপনি শুল্ক চুক্তি নিয়ে যতই রিমাইন্ডার জারি করুন না কেন। আপনি কাকে ভয় দেখাচ্ছেন? আপনার ডলার তো এখন পতনের মুখে। বুঝি ব্রিকস আপনার চক্ষুশূল। মিস্টার মার্কিন প্রেসিডেন্ট কান খুলে শুনে রাখুন, এই ভারতকে শুল্কে চমকানোর দিন আপনার শেষ। শুনতে পেলেন এই আপ্তবাক্যটা?
Advertisement



