• facebook
  • twitter
Wednesday, 12 February, 2025

সাগরদ্বীপের বাঘ

সমুদ্রের জলে বারবার ভেসে গিয়ে আবার তৈরি হয়েছে এই আশ্রমটি। মন্দিরটিতে ইঁটের দেওয়াল তৈরি হয়েছে ১৯৬১ সালে।

সত্তরের দশক। চিমাগুড়ি। পশ্চিমবঙ্গের মূল ভূখণ্ড থেকে গঙ্গা বক্ষে সাগরদ্বীপে যাওয়ার জন্য তিনটি প্রধান ঘাট রয়েছে। কচুবেড়িয়া, বেনুবন এবং চিমাগুড়ি। এখান থেকেই নৌকা থেকে নেমে কপিলমুনি আশ্রমে যাওয়ার জন্য পথ ধরেছে উত্তরপ্রদেশের দেহাতি এক পরিবার। সন্ধ্যে ক্রমশ রাতের দিকে এগোচ্ছে। চারদিকে তখনো গভীর জঙ্গল। পরিবারটি ঠিক করল, সেই রাতটা কোনোরকমে একটি গরান গাছের তলায় কাটিয়ে দিয়ে পরদিন ভোর ভোর কপিলমুনির মন্দিরের দিকে এগোবে। সেই তাঁরা গরান গাছের নিচে আশ্রয় নিল। কিন্তু বিধিবাম। মধ্যরাতে বাঘের গর্জন। পরিবারের কর্তাকেই গভীর জঙ্গলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেল বাঘ। হইচই বেঁধে গেল প্রশাসনিক মহলে। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলেন গঙ্গাসাগরের প্রবীণ বাসিন্দা, বৈদ্যনাথ গায়েন। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল চিমাগুড়ির ঘাটে। এছাড়াও তীর্থযাত্রীদের বাঘে টেনে নিয়ে যাবার অনেক ঘটনা ছড়িয়ে রয়েছে সাগরদ্বীপের অন্দরে অন্দরে জানালেন তিনি।

গঙ্গাসাগরের আচারের উল্লেখ পাওয়া যায় ‘মহাভারত’ এবং ‘রামায়ণ’ থেকে। প্রায় ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রতি বছর মকর সংক্রান্তির শুভ সময়ে লক্ষ লক্ষ তীর্থযাত্রী এই যাত্রায় যাত্রা করেন। মহা কবি কালিদাসের লেখা ‘রঘুবংশম’ এর মতো পঞ্চম শতাব্দীর সাহিত্যে গঙ্গাসাগরের ভক্তিমূলক যাত্রার উল্লেখ রয়েছে। সত্যযুগের পর থেকে সাগর দ্বীপের এই যাত্রা বিশ্বাস এবং মোক্ষের অনুভূতির সাথে জড়িত। এটি সময়ের চেয়ে পুরানো একটি উত্তরাধিকার। যা এখনও প্রশান্তি এবং নির্বাণ খুঁজে পাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রবাহিত করেছে।

‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে,
মৈত্র মহাশয় যাবেন সাগরসংগমে,
তীর্থস্নান লাগি। সঙ্গীদল গেল জুটি,
কত বালবৃদ্ধ নরনারী; নৌকা দুটি
প্রস্তুত হইল ঘাটে।’

এটি রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার প্রথম কয়েকটি পংক্তি। গুরুদেবের ‘কথা’ কাব্য গ্রন্থে এই কবিতাটি রয়েছে। যেখানে সাগর স্নানের উল্লেখ রয়েছে।

১৯১২ (পৃ. ১০-১৮) বাংলার ১৩ই কার্তিক, ১৩০৪ সময়কালে লেখা। গভীর অরণ্য কেটে তৈরি হয়েছিল সাগরদ্বীপের বসতি এলাকা। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ সকলের সাহিত্যে উঠে এসেছে গঙ্গাসাগরের বিচিত্র সব কাহিনী। নানান অক্ষান বা ঘটনার পরম্পরা গঙ্গাসাগরের থৈ থৈ করছে। পুরানে যে গঙ্গাসাগরের কাহিনী রয়েছে, শুধু তাই নয় আধুনিক সাহিত্যেও ঠাঁই পেয়েছে গঙ্গাসাগর। ১৮৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্কিমচন্দ্র মেদিনীপুর জেলার নেওয়া মহাকুমায় ডেপুটি কালেক্টর পদে যোগদান করেন। এই সময় তাঁর সমুদ্র সাক্ষাৎ ঘটে। এক আশ্চর্য কাপলিকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে তাঁর। ফলস্বরূপ ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাস।’কপালকুণ্ডলা’ সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত দ্বিতীয় উপন্যাস। সম্ভবত এটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস।

১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। গঙ্গাসাগর থেকে মকর সংক্রান্তির স্নান সেরে ফেরার পথে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে নবকুমার এক জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপে আটকা পড়েন। সেখানে এক কাপালিক তাকে বলি দিতে উদ্যত হয়। তখন কাপালিকের পালিতা কন্যা কপালকুণ্ডলা তার প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। স্থানীয় মন্দিরের অধিকারীর সহায়তায় নবকুমার কপালকুণ্ডলাকে বিয়ে করে নিজের বাড়ি সপ্তগ্রামে ফিরে আসেন। এর পরের ঘটনা প্রবাহ আমাদের সকলেরই জানা। আরো ৩১ বছর পরে, রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি। যেখানে স্পষ্ট তীর্থস্থান এর কথা।

‘মরিসন’ নামে এক ইংরেজ এই অঞ্চলে জলসফর করতেন। তিনি এক বর্ণনায় বলেছেন, ১৮১৮-১৯ তাহলে এই অঞ্চলে তিনি গন্ডার, বাঘ, কুমিরকে ঘুরে বেড়াতে দেখেন। ১৮ ফুট লম্বা একটা কুমিরকে ঘুরতে দেখেছিলেন তিনি। গুলি করে সেটিকে শিকার করেন। সেই কুমিরের পেট থেকে প্রচুর সোনার অলংকার পাওয়া যায়। অনুমান করা হয়, সম্ভবত কোনো ধনী মহিলাকে খেয়েছিল কুমিরটি।

গঙ্গাসাগর, প্রয়াগ রাজ, ত্রিবেণী বলে নয়, মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গার জলে আবগাহন, স্নান হিন্দুদের অতি পুণ্য কর্ম। তবে গঙ্গার মাহাত্ম্য শুধু হিন্দু কেন, মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিলেন। জাফর খাঁ গাজীর রচিত গঙ্গাস্তোত্র খানিও বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ‘ সুরধ্বনি মুনিকণ্যে তারয়ে: পুণ্যবন্তঙ স ভর্তি নিজ পুনৈস্তত্র কিঙতে মহত্বম্ যদি তু গতিবিহীনঙ তারয়ে: পাপিনৎমাঙ তদিহতব মহত্বৎ তন্ম হত্বঙ মহত্তম।’

কবি-সাধক জাফর খাঁ মনে করিয়ে দিয়েছেন,- সাধু পুরুষেরা তো তাঁদের নিজ পুণ্য ফলে উদ্ধার লাভ করেন, কিন্তু প্রকৃত পাপীদের উদ্ধার করলে তবেই বোঝা যাবে গঙ্গার আসল মহত্ব। যে উপলব্ধি প্রয়াগরাজে মহাকুম্ভমেলাতেও সমান ভাবে প্রযোজ্য।

১৮০০ সালের শুরুর দিকে, সাগরদ্বীপে যেটুকু বসতি গড়ে উঠেছিল তা দিনে দিনে তমলুক বা কাকদ্বীপে সরে যেতে থাকে। নেপথ্য কারণ, কলকাতা বন্দর তৈরি হওয়া। ফলে সাগরদ্বীপের জাহাজ ঘাটের গুরুত্ব ক্রমেই কমে আসে। ক্রমান্বয়ে সাগরদ্বীপ ঘন নিবিড় জঙ্গলে ঠাসা জনমানব শূন্য প্রান্তরে পরিণত হয়। ইংরেজ শাসকরা ১৮১১ সালে দ্বীপ উদ্ধারের পরিকল্পনা করে। ‘জোনস’ নামে এক ইউরোপীয়কে সাগরদ্বীপের জমি বন্দোবস্তের জন্য দশ বছরের মেয়াদে পাট্টা দেওয়া হয়। তবে তিনি অসফল হন। ১৮১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘সাগরদ্বীপ সোসাইটি’। তখন তাদের পুঁজি ছিল মাত্র আড়াই লক্ষ টাকা। ২৪ পরগনা জেলার কালেক্টর ‘টাওয়ার’ সাহেব ছাড়াও অনেক ভারতীয় অংশীদার ছিলেন সেই সোসাইটির। ওই সমিতি সরকারের কাছে সাগরদ্বীপে উন্নয়নের পরিকল্পনা করে জমির দরখাস্ত করে। এরপরেই সাগরদ্বীপ ইজারা দেওয়া হয়। জঙ্গল সত্বর পরিষ্কার করা হলেও, সাগরের তীব্রতা নেবার ক্ষমতা মাটির ছিল না। তবুও পিছিয়ে না গিয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া হল। ১৮৩৩ সালের প্রবল ঝড়ে সোসাইটির সব রূপান্তর ধ্বংস হয়ে যায়। ভাঙ্গা ঘরের খেলা চলতে থাকে। সোসাইটি লবণ তৈরি করলে তার সুনাম গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ব্যবসা ও ভিত্তি গড়ে ওঠে। তারপর থেকেই সাগরদ্বীপে চলছে ভাঙ্গা-গড়ার খেলা।

ঋষি কপিলকে বলা হয় সাংখ্য দর্শনের অন্যতম প্রবক্তা। আর গীতায় তাকে ‘সিদ্ধাচল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই কপিল মুনির নামে যে আশ্রমটি রয়েছে সাগরদ্বীপে তার প্রাচীনত্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতানৈক্য আছে। লোককথা অনুযায়ী এই আশ্রমের অবস্থান প্রায় ১৫০০ বছরের বেশি। আবার ১৮৩৭ এর ৪ ফেব্রুয়ারি ‘হরকথা’ পত্রিকায় লেখা হয় এই আশ্রম ১৪০০ বছরের পুরনো। আবার ষোড়শ শতকের পুঁথি ‘তীর্থতত্বপ্রদায়িনী’তে ওই কপিলমুনির মন্দিরের উল্লেখ পাওয়া যায়। ইক্ষাকু বংশের রাজা সাগরের অশ্মমেধ যজ্ঞের ঘোড়া ছলনা করে কপিল মুনির আশ্রমে লুকিয়ে রেখেছিলেন ইন্দ্র। সাগরের ষাট হাজার পুত্র কপিল মুনিকেই ঘোড়া চুরি সন্দেহ করে হুলুস্থুল বাধালে পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। কপিলমুনি তাঁদের ভস্ম করে দেন। পরে সাগরের উত্তর পুরুষ ভগীরথ সাধনা করে গঙ্গাকে মত্তে নামিয়ে এনে সেই ভস্মিভূত সন্তানদের মুক্তি দেন।

সমুদ্রের জলে বারবার ভেসে গিয়ে আবার তৈরি হয়েছে এই আশ্রমটি। মন্দিরটিতে ইঁটের দেওয়াল তৈরি হয়েছে ১৯৬১ সালে। তৎকালের মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের উদ্যোগে। ১৯৭৪ সালে তা আজকের রূপ নেয়। এখন এমন অনেক লোক কথনে জড়িয়ে আছে কপিল মুনির আশ্রম। আজও মকর সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর মেলা আধুনিকতম এবং অন্যতম আকর্ষণ।

‘সংবাদ দর্পণ’ বলছে কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ মানুষের জমায়েত হতো এই মেলায়। এমনকি ব্রহ্মদেশ অর্থাৎ মায়ানমার থেকেও আসতেন অনেকে। আর এত বিস্তৃত ও বর্ণময় জনতার উপস্থিতিতে হারিয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। মেলায় হারিয়ে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক ছিল। কঠিন ছিল আত্মীয়দের খুঁজে পাওয়া। আর এই ভাবেই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসে পথ হারিয়েছিলেন নবকুমার। সমুদ্রের চরে দাঁড়িয়ে কপালকুণ্ডলা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘পথিক কি তুমি পথ হারাইয়াছ?’

এখন অবশ্য অনেক সুরাহা হয়েছে। নবকুমারদের দেখা পাওয়া মুশকিল। হারিয়ে গেলেও খুঁজে পাওয়া সহজ। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অসংখ্য। প্রশাসনের তরফ থেকে রাস্তার নাম, নাম্বার, এবং ছবি দিয়ে পট নির্দেশনা করে দেওয়া হয়ে থাকে। তাছাড়া রয়েছে অনুসন্ধান অফিস। গত বছরই দেখছিলাম, একজন মহিলা অনুসন্ধান কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে ঘোষনা করছেন, ‘মোগলসরাই থেকে আসা মুনিয়ার বাবা যেখানে থাকো এসে দেখা কর’। কে এই মুনিয়ার বাবা ? ওই মহিলার স্বামী। এখনো দেহাতি ভারতে মহিলাদের স্বামীর নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ। তাই ওই মহিলা এইভাবে ঘুরিয়ে নাক দেখাচ্ছিলেন বলা যায়।

আবার সুলতানি যুগের গল্প শোনা যায় সাগরদ্বীপের অনেক মানুষের মুখে। টিপু সুলতান এর সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন ইংরেজ সাহেব হেক্টর মুনরো। সেই হেক্টর মুনরোর দুই ছেলে সাগরদ্বীপে বাঘ শিকার করতে এসে নিহত হন বাঘের হাতে। এই সংবাদ পেয়ে টিপু সুলতান মহা খুশি হন। মহীশূরে তাঁর প্রাসাদে বানান বাঘের মূর্তি। ফৌজি টুপি ও নীল ব্রিজেচ পড়া ইংরেজ শাসকের টুঁটি চেপে ধরেছে বাঘ। এর মধ্যে ছিল স্বজত্যবোধ। স্বাভিমান। জাতীয়তাবাদ। আর টুঁটি চিপে ধরা সেই বাঘ ছিল ‘সাগরদ্বীপের বাঘ’।