সুবীর পাল
সংশোধনাগারের আরও একটি বাংলা তর্জমা রয়েছে। যাকে বলে ‘কারাগার’। ইংরেজিতে বলে ‘জেল’। তবে আমাদের বাংলায় প্রচলিত কথার একেবারে অন্দরমহলে ইংরেজি ভাষার এই ‘জেল’ শব্দটি কিন্তু বহু যুগ ধরে পাকাপাকি আসন করে নিয়ে ফেলেছে। ফলে অতি বড় নিরক্ষর বাঙালিও ব্যবহারিক মাতৃভাষার প্রয়োগের প্রয়োজনে জেল শব্দকে অনায়াসেই আত্মস্থ করে নিয়েছে একেবারে স্বাভাবিক ছন্দে।
আক্ষরিক অর্থেই ‘সংশোধনাগার’ বলতে যেখানে সামাজিক ভাবে চিহ্নিত অপরাধীদের রাখা হয় কারাবন্দী করে। তবে আসামীদের চিহ্নিতকরণের প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করে থাকে সাধারণ ভাবে কোনও রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়োজিত আদালতের তদারকিতে।
সংশোধনাগারের মূল লক্ষ্য হলো, অপরাধীদের বন্দি করে কারাগারে তাঁদের চরিত্রগত, মানসিকগত ও শরীরগত দিক থেকে পরিশুদ্ধ আত্ম আচরণের এবং মানবিক আত্ম সংযমের সুযোগ সৃষ্টি করতে সাহায্য করা। যাতে বিচার শেষে বন্দিদশার অবসানে তাঁরা যাতে সুসভ্য সমাজের উপযুক্ত বাসিন্দা হয়ে উঠতে পারে খুব সহজেই। ফলে এই সমস্ত পরিকল্পিত ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সংশোধনাগারে বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ধারাবাহিক কঠোর অনুশাসনের ব্যবস্থা তো থাকেই। একইসঙ্গে দৈনন্দিন বন্দি জীবনের মধ্যে সময়ানুবর্তিতার সঙ্গে কর্ম সংযোগের সংস্থানও রাখা হয়। আসামীদের মানসিক গঠনে ইতিবাচক অনুসঙ্গ ঘটাতে মেডিটেশন থেকে নানান সাংস্কৃতিক ও বিনোদনের উপযোগী পরিবেশও নিয়মিত সৃষ্টি করা হয়ে থাকে বিভিন্ন সংশোধনাগারে।
তবু এই বিশ্ব যে সবসময়ের জন্য এই মনুষ্য জীবনক্ষেত্রে ‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি।’ তাই ব্যতিক্রমের এই বিশ্ব গালিচায় রয়ে গেছে কত যে অভিনব অস্তিত্বগত তথ্যমালা, তার যথার্থ হিসাব আমরা কতজনই বা সঠিক পরিসংখ্যান বগলদাবা করে রাখতে পারি!
পৃথিবীর এই অবাক সরাইখানায় অন্যান্য নানা চর্চিত বিষয়ের মতো স্বাভাবিকভাবেই থেকে গেছে অদ্ভুত সব সংশোধনাগারের রকমারি উদ্ভাবন। আমাদের ভাবনার জগতে তা কখনও হয়ে উঠেছে অপরূপ সোনার কাঠির ছোঁয়ায় এক স্বপ্নময় আধুনিক জীবন যাপনের বিলাসবহুল পরিকাঠামো, আবার সেই সংশোধনাগার কোনও প্রান্তের সাক্ষী হয়ে উঠেছে নরখাদকের আস্তানার। আসলে এই পৃথিবীর চেহারাটাই এমন বৈচিত্র্য ঘেরা। যেখানে কারাগার কোথাও অভিজাত হোটেলের আদলে আরামদায়ক দিনগত পাপক্ষয় করার নিবাস খুঁজে পাওয়া। আবার পাল্টা পরিভাষায় এই পৃথিবী কলঙ্কিতও হয়েছে কারাগারের পৈশাচিক অভিধানে। এমনও সংশোধনাগারের হদিশ মেলে এই ধরণীতে যার কারাকক্ষের তুলনা বিশ্বের জঘন্য চিড়িয়াখানাকে অনায়াসে লজ্জায় ফেলে দেয় অমানুষিক নির্মমতার লাগাতার প্রবাহে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দরতম সংশোধনাগারে কথা আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই করে প্রথম যে নামটি অন্তরের দরজায় অবধারিত ভাবে টোকা মারে সেটি হলো ‘বাস্তয় কারাগার।’ এটি নরওয়ের একটি জেল। যা বাস্তয় দ্বীপে অবস্থিত। দ্বীপটি নির্জন হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর। শুনলে অবাক অবশ্যই হতে হয়, এই কারাগারের কোথাও কোনও দেওয়াল বা প্রাচীর নেই। এমনকি এখানকার আবাসিক আসামীরা এই জেল থেকে পালানোর চেষ্টা পর্যন্ত করে না। এটি একটি নিম্ন নিরাপত্তা কারাগার। যেখানে শতাধিক বন্দি থাকতে পারে পরিকাঠামোগত পরিবেশের কারণে।
পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক সুন্দর সুযোগ প্রাপ্ত এই কারাগারে প্রতিটি বন্দির জন্য নির্ধারিত রয়েছে পৃথক পৃথক কক্ষ। বরং কক্ষ না বলে আবাসস্থল বলাই ভালো। কি নেই সেই সব আবাসস্থলে। এ যেন বিলাসবহুল হোটেল রুমের মতো অনুকরণীয় অনেকটা। শয়নকক্ষ থেকে শুরু করে ড্রইংরুমে, রান্নাঘয়, শৌচালয়, টিভি, গিজার, এসি, ফ্রিজ, সোফাসেট, রিডিং টেবিল, আলমারি, সংবাদপত্র, পড়াশোনার জন্য কম্প্যুটার, ছোট মাপের সংগৃহীত বইয়ের র্যাক প্রভৃতি সবকিছুর সম্ভার থাকে এখানকার প্রতিটি আবাসে। বন্দিরা এই কারাগারে একত্রে থাকলেও বসবাস করেন নিজেদের জন্য নির্দিষ্ট করা আবাসে। যেখানে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা বর্তমান। যদিও তাঁদের জন্য সার্বজনীন রান্না ও খাওয়ার পরিষেবাও দেওয়া হয় কারাগার কর্তৃপক্ষের তরফে। আর যদি বন্দিরা নিজের জন্য নিজেই রান্না করে থাকলে সেই কারণে তাঁরা ভাতাও পেয়ে থাকেন।
বাস্তয় কারাগারে বন্দি আসামীদের জন্য আয় সংস্থানেও বন্দোবস্ত রয়েছে। শব্জি ও খাদ্যশস্য উৎপাদন, সাইকেল মেরামতি, ঘোড়াশালের দেখাশোনা, কারাগার পরিচ্ছন্ন করার মতো কাজে যুক্ত হতে হয় এখানকার আবাসিকদের। পরিবর্তে তাঁরা পেয়ে থাকেন তাঁদের শ্রম অনুযায়ী উপার্জিত অর্থ। এছাড়া জীবনের উন্নতি সাধনের জন্য বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি একাধিক উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয় এখানকার বন্দিদের।
এই সংশোধনাগারে বর্তমানে ১১৫ জন বিচারাধীন আসামী রয়েছেন। আর কারাকর্মী আছেন ৬৯ জন। শুনতে অবাক লাগে রাতের বেলায় এখানে কর্মরত অবস্থায় থাকেন মাত্র পাঁচ জন কারা কর্মচারী থাকেন। অবসর সময়ে আসামীরা এখানে মাছ ধরতে পারেন, বই পড়তে পারেন, ঘোড়ায় চরতে পারেন, গির্জায় যেতে পারেন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে যেতে পারেন, টেনিস খেলতে পারেন, এমনকি চুটিয়ে প্রেম ও স্বেচ্ছার যৌনমিলনেও লিপ্ত হতে পারেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো এখানে কর্মরত কারাকর্মীরা বেশিরভাগই সমাজসেবী হিসেবে সমাজে পরিচিত।
আরও অবাক হওয়ার মতো ফিরিস্তি রয়েছে এখানে। এই জেলটির আয়তন এক বর্গমাইল পরিধিতে আবদ্ধ। এর এক প্রান্তে রয়েছে একটি কলোনি। রয়েছে বাজার। থেকেছে প্রাথমিক স্কুলও। বন্দিদের পরিবারের সদস্য সদস্যারা মনে করলে স্বেচ্ছায় এই কলোনি এসে বসবাস করতেই পারেন। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বাজার থেকে কেনাকাটা করা এবং পরিবারের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠানোর মতো পরিষেবা এখানে পেয়ে থাকেন বন্দিদের পারিবারিক পরিজনেরা। ফলে সংসার ধর্ম পালন করা থেকে বিলাসবহুল জীবনযাপন সহ কর্ম সংস্থানের মতো যাবতীয় সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য পেয়ে থাকেন এখানকার আবাসিক বন্দিরা।
বিশ্বখ্যাত সংবাদপত্রটির নাম ‘দ্য গার্ডিয়ান।’ নরওয়ের এই সংশোধনাগারে স্থিত বন্দিদের বক্তব্য সম্পর্কে পত্রিকার প্রতিক্রিয়া হলো, ‘এটা যেন একটি গ্রাম। একটি বন্দি সম্প্রদায় এখানে বসবাস করছে। প্রত্যেককে কাজ করতে হবে। কিন্তু আমাদের অবসর সময় আছে যাতে আমরা কিছু মাছ ধরতে পারি অথবা গ্রীষ্মে আমরা সৈকত থেকে সাঁতার কাটতে পারি। আমরা জানি আমরা বন্দি। কিন্তু এখানে আমরা নিজেদের সুন্দর স্বাভাবিক মানুষের মতো অনুভব করি।’
কারাগার সম্পর্কে আরও একটা মজার তথ্য হলো পৃথিবীতে বেশকিছু কারাগার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে কয়েদির অভাবে। ভাবা যায়? আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে যেখানে দিনের পর দিন আসামীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। যেখানে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রগুলোর সরকার অহরহ বিচলিত হয়ে পড়ে এই ভেবে যে সংশোধনাগারের পরিকাঠামো আরও কোনও উপায়ে আড়ে বহরে বৃদ্ধি ঘটানো যায়। অথচ সুইডেন, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, লিস্টেনস্টাইন, নিউজিল্যান্ডের মতো দেশগুলোতে বছরের পর বছর ধরে একটার পর একটা কারাগারের ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে আসামীর সংখ্যা হ্রাস পাওয়ার কারণে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে সুইডেনে ২০০৫ সালে কারাদণ্ড প্রাপ্ত আসামীর সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। এখন তার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিন হাজারে। ফলে অনেকগুলো জেল বন্ধ করে দেয় সুইডিশ কারা বিভাগ। ওই একই কারণে নেদারল্যান্ডে ২০১৩ সালে তেরোটি জেলকে হিমঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০১৭ সালে অতিরিক্ত পাঁচটি কারাগারের ফটকে চিরকালের জন্য তালা ঝোলানো হয়। হতবাক হতে হয় চৌত্রিশ হাজার নাগরিকের দেশ লিস্টেনস্টাইনের তথ্য সামনে এলে। বর্তমানে সেই দেশে কারাগারের সংখ্যাটি হলো কুড়ি। আর সেখানে সাম্প্রতিক জেল সাজাপ্রাপ্ত কয়েদির সংখ্যা কত হতে পারে? বিস্ময়কর হলেও সেখানে এখন আসামীর সংখ্যা হলো মাত্র উনিশ। অর্থাৎ ওই দেশে উনিশজন অপরাধীর জন্য বরাদ্দ রয়েছে কুড়িটি সংশোধনাগার।
পৃথিবীতে যদি বাস্তয় কারাগার থাকতে পারে তবে বিপরীতে অবশ্যই শিকড় গেড়ে বসে থাকবে ‘গীতামারা সংশোধনাগার’। কারণ আলোর উদারতার বিপক্ষেতেই তো অন্ধকারের প্রবল রাজত্ব। বিশ্ব যদি বাস্তয়ের সুখ্যাতিতে মশগুল হতে পারে, তবে তো গীতামারার কুখ্যাতিতেও শিউড়ে ওঠবে প্রত্যাশিত অনুকরণে। এই সংশোধনাগারে আসামীদের সংশোধন করার প্রয়াস তো দূর অস্ত, এখানে কয়েদিদের নরখাদকে রূপান্তরিত করা হয়ে থাকে একেবারে নিজস্ব অমানবিক ঘরানায়।
এ হেন কারাগারের ভেতরে জায়গা রয়েছে পাঁচশো থেকে ছয়শো জন থাকার। অথচ সেই জায়গায় রাখা হয় ছয় হাজার থেকে সাত হাজার বন্দিকে। সুতারাং একে কারাবাস উল্লেখ না করে নরকবাস উল্লেখ করাই শ্রেয়। এটাকে বলা যায় দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্করতম কারাবাস। পূর্ব আফ্রিকার অন্তর্গত দেশ রুয়ান্ডা। সেখানেই রয়েছে মনুষ্যত্বের অভিশাপ এই গীতারামা কারাগার। এখানকার জেলে বন্দিরা একে অপরকে খুন করে। তারপর মৃত ব্যক্তির মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে অন্যেরা। এমনই চাঞ্চল্যকর খবর একদা প্রকাশিত হয়েছিল আফ্রিকার এক দৈনিকে।
সেই কুখ্যাত গীতারামা জেলে শোয়া বসা তো দূরে থাক, ঠিকমত দাঁড়ানোর জায়গাও থাকে না সেই জেলের সেলে থাকা কারাবাসীদের। খাওয়ার দেওয়া হয় মেরেকেটে একশো জনের জন্য, তাও ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাত্র দুইবার। গায়ের জোরে সেইসব খাবার কেড়ে খেয়ে নেয় পঞ্চাশ ষাট জন বন্দি।
অভুক্তই থেকে যান বাকিরা। প্রচন্ড খিদেতে এরপর শুরু হয় একে অপরকে খুন করার পালা। খুন করার একমাত্র লক্ষ্য হলো সহ-বন্দিদের মাংস খেয়ে খিদের জ্বালা মেটানো। এভাবে সারাদিনে অন্তত সাত জন বন্দি মারা যেত। খুন করে মাংস খেয়ে চিৎকার করতে থাকে বন্দিরা। দুর্বল হয়ে পড়লেই পরদিন সহ-বন্দিরা তাঁকেও মেরে ফেলে।
এই খবর সামনে আসার পরই নড়চড়ে বসে বিশ্বের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন। ক্রমেই বিশ্ববাসীর কাছে গীতামারা কারাগার হয়ে ওঠে নরহত্যার এক জৈবিক কারখানা। যার মুখোশ হলো প্রতিশ্রুত সংশোধনের আর মুখ হলো পৈশাচিক নরখাদককের।