প্রবীর মজুমদার
উপলক্ষ হিন্দু ধর্মের মহামিলনের মেলা। মূল লক্ষ্য রাজনৈতিক সমীকরণ গঠন। মহাকুম্ভ মেলাকে রাজনীতির হাতিয়ার করতে বিজেপি চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। বারো বছর অন্তর পূর্ণকুম্ভ হলেও, এবারের মত মহাকুম্ভ হয় ১৪৪ বছর অন্তর। সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে চলেছে উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর ঠান্ডা যুদ্ধও বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। অযোধ্যার রামমন্দির উদ্বোধনে প্রচারের কেন্দ্রে ছিলেন মোদী। মহাকুম্ভকে কাজে লাগিয়ে যোগী এবার কেন্দ্রীয় ভূমিকা নিয়েছেন। উগ্র হিন্দুত্ববাদ আর বুলডোজাররাজ কায়েম করা ছাড়া আদিত্যনাথ সরকারের আর কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান নেই। নারী নিরাপত্তা, সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য দেওয়া, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য দূরীকরণ – সবদিক দিয়ে এই সরকার ব্যর্থ। বহু আন্দোলন দমনে বুলডোজারের অপব্যবহারে উত্তরপ্রদেশ সরকার কুখ্যাত।
মৌনী অমাবস্যায় মহাকুম্ভ মেলায় কতজন স্নান করেছেন তার তথ্য দেওয়া হয়েছে অবিরত। অথচ পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা জানাতে লেগে গেল ১৭ ঘন্টা। পুণ্যার্থীদের জীবনের গুরুত্ব প্রশাসন ও সরকারের কাছে কতখানি, তা এতেই স্পষ্ট। গত ২৮ জানুয়ারি মৌনী অমাবস্যা তিথিতে স্নান করতে গিয়ে পদপিষ্ট হয়ে মারা যান অনেক পুণ্যার্থী। রাত একটা থেকে দুটোর মধ্যে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনা সংবাদমাধ্যমকে জানাতে এসে যায় ২৯ জানুয়ারি বিকেল। সরকারি পক্ষ থেকে মাত্র ৩০ জনের পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর কথা জানানো হলেও, বিভিন্ন মহলের মতে সংখ্যাটা তার থেকে অনেক বেশি। বহু মানুষ ঘটনার দিন পাঁচেক পরেও নিখোঁজ। নিহত ও আহতদের খবর নিতে গিয়ে চূড়ান্ত হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে পরিবার পরিজনকে। হিন্দুরা বিপদে আছেন বলে যারা দেশজুড়ে বিদ্বেষের রাজনীতি করছে, হিন্দুদের ধর্মীয় মহোৎসবে তাদের পরিচালিত সরকারের এই দায়িত্বজ্ঞানহীনতা অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। বিজেপিবিরোধীদের অভিযোগ – বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের ধর্মে যত না মতি, তার চেয়ে বেশি মতি ধর্ম নিয়ে রাজনীতিতে। মহাকুম্ভ মেলা সেই অভিযোগের যাথার্থ্য প্রমাণ করেছে।
চূড়ান্ত অব্যবস্থা ও প্রশাসনের গাফিলতির জন্য ভিআইপি সংস্কৃতিকে দায়ী করা হচ্ছে। মেলার শুরু থেকেই চূড়ান্ত অব্যবস্থার অভিযোগ আসছিল। যে অব্যবস্থা কেবল প্রয়াগরাজকে নয়, বারাণসী, অযোধ্যাকেও প্রভাবিত করেছে। প্রয়াগরাজমুখী পুণ্যার্থীদের গতিরোধের জন্য বারাণসীর আশেপাশে বহু স্কুল, কলেজ সরকার সাময়িকভাবে নিয়ে নিয়েছে। প্রয়াগরাজের ৫০ কিলোমিটার জুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার এসব অভিযোগ ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা না করে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে এই মৃত্যুগুলো এড়ানো যেত। পুণ্যার্থীদের মৃত্যুর পর অগত্যা ভিআইপি পাশ বাতিল করা হয়েছে। প্রয়াগরাজে গাড়ি প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই ভিআইপি সংস্কৃতি আগে বন্ধ করা হল না কেন? সাধারণ মানুষের প্রাণহানির পর সরকারের বোধোদয় হল?
মন্ত্রী, সান্ত্রী সমেত রাজনীতিবিদ, সেলিব্রিটিদের স্নানের পথ সুগম করতে সাধারণ পুণ্যার্থীদের যাতায়াতে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। অনেক অস্থায়ী পুল বন্ধ রাখা হয়েছে। জায়গায় জায়গায় ব্যারিকেড তুলে পুণ্যার্থীদের স্নান করতে যাওয়ার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করা হয়েছে। বিখ্যাত ব্যক্তিদের গাড়ি চড়ার জন্য সাধারণ পুণ্যার্থীদের যেতে আসতে ২০-৩০ কিলোমিটার অবধিও হাঁটতে হচ্ছে। স্নান করতে যাওয়া ও আসার পথ আলাদা না করাতেও সমস্যা সৃষ্টির অভিযোগ আগেই অনেকে করেছিলেন। উত্তরপ্রদেশ সরকার ভিআইপি থেকে ভিভিআইপি পর্যন্ত নানারকম পাশের ব্যবস্থা করে বিখ্যাতদের পুণ্যার্জনের পথ মসৃণ করেছে। ২০১৭ সালে এক ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদী নতুন ভারতে ভিআইপি সংস্কৃতি তুলে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নতুন ভারতে প্রত্যেকটা মানুষই গুরুত্বপূর্ণ। নতুন ভারতে ‘ভিআইপি,-র বদলে ‘ইপিআই’ (‘Every Person is Important’) সংস্কৃতি চালু করা হবে। অথচ তাঁদের বহুল প্রচারিত মহাকুম্ভ মেলায় ভিআইপি সংস্কৃতির নিকৃষ্টতম নমুনা দেখছে ভারত। এর জন্য অনেক পুণ্যার্থীকে প্রাণ দিতে হল।
দুর্ঘটনার পর থেকেই সত্য ধামাচাপা দিতে সরকার অতি তৎপর। মৃত ব্যক্তিদের দেহ পরিবার পরিজনদের হাতে তুলে দেওয়া, তাঁদের দেহ বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ – কিছুই করা হয়নি। নিখোঁজদের সন্ধান করতেও বিশেষ তৎপরতা প্রশাসন দেখাচ্ছে না। মৃত ব্যক্তিদের পরিবারের তরফ থেকে অভিযোগ আসছে, মৃতদেহ গ্রহণ করা, বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁ হাতে টাকা চাওয়া হচ্ছে। ময়না তদন্ত তো হচ্ছেই না, উপরন্তু মৃতদের মৃত্যুর শংসাপত্র পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। সরকারি সিলমোহর ছাড়া কাগজে কেবল দেহ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়ার কথা লিখে দেওয়া হচ্ছে। সেই কাগজের আইনি বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা তো আছেই, পাশাপাশি সিলমোহরহীন এই কাগজের জন্য পরবর্তীকালে নানা ক্ষেত্রে পরিবারের হেনস্থার আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আড়াল করতেই এই অব্যবস্থা, অরাজকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির মাতব্বররা পুণ্যার্থীদের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতিতেও সমান নির্লজ্জ। আদিত্যনাথের রাজত্বে নাম বদলের রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এলাহাবাদের নাম আগেই হয়ে গেছে প্রয়াগরাজ। মহাকুম্ভ আয়োজনের জন্য সরকার ৭,৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে। অখিল ভারতীয় আখড়া পরিষদের দাবি মেনে মেলায় অহিন্দুদের দোকানপাট দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। এতকিছুর পরেও পুণ্যার্থীদের নিরাপত্তায় এত গলদ কেন?
যোগ্য সঙ্গত করছে গোদি মিডিয়া। অধিকাংশ মূলধারার প্রচারমাধ্যমই দুর্ঘটনাকে লঘু করার চেষ্টা করে চলেছে। তবে কিছু ব্যতিক্রমী সংবাদমাধ্যমের পরিবেশিত তথ্যে খোদ উত্তরপ্রদেশ ও কেন্দ্রের ডবল ইঞ্জিনের সরকারের দায় স্পষ্ট হয়েছে। একটি বহুল প্রচারিত হিন্দি সংবাদমাধ্যম এই ঘটনার জন্য ছজন প্রশাসনিক আধিকারিকের ভূমিকাকে দায়ী করেছে। তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার বিশ্লেষণও করেছে।
মহাকুম্ভ কাজে লাগিয়ে ভোটে জিততে গেলে যেমন ভিআইপিদের আগমন প্রয়োজন, তেমন বিপুল জনসমাগমও দরকার। সেই লক্ষ্যেই বিখ্যাতদের সুবিধা করে দিতে, নিরাপত্তা দিতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা, পরিষেবাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি সরকার। বিশিষ্টদের আগমন ঘিরে সংবাদমাধ্যমে উন্মাদনা সৃষ্টির জন্য সরকারি কোষাগার, প্রশাসনিক ক্ষমতা সবকিছুই ব্যবহার করা হয়েছে। প্রচারে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি হলে, সাধারণ পুণ্যার্থীদের আগমনও বেশি করে হবে। তাঁরা তো কেবলই সংখ্যা। তাঁদের মানুষ হিসাবে মর্যাদা, জীবনের নিরাপত্তা দিতে সরকারের বয়েই গেছে। হিন্দুত্ববাদের জিগির তুলে ভোটে জেতার মহাযজ্ঞে কয়েকজন হিন্দু পুণ্যার্থী মারা গেলেও তারা বিচলিত নয়। কোটি কোটি মানুষের সমাগমে কয়েকজনের মৃত্যুতে কী-ই বা এসে যায়? সেসব সাধ্যমত ধামাচাপা না দিতে পারলে মহাকুম্ভের আয়োজন মাঠে মারা যাবে। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির কারবারীদের কাছে ধর্মভীরু মানুষ যে কেবলই সংখ্যা, মানুষ নন – এবারের মহাকুম্ভ সেকথা আবার প্রমাণ করল। মহাকুম্ভ প্রমাণ করল, বিজেপির কুম্ভ মানুষকে অমৃত দিতে পারে না।
ধর্ম এবং রাজনীতি মিশে গেলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা পড়ে সাধারণ মানুষ। প্রয়াগরাজে ঠিক কতজনের মৃত্যু হয়েছে তা এখনও জানা যায়নি।
১৯৫৪ সালে মৌনী অমাবস্যায় এলাহাবাদে স্নান করতে গিয়ে কয়েকশো পুণ্যার্থীর মৃত্যু হয়েছিল। কালকূটের ‘অমৃত কুম্ভের সন্ধানে’ উপন্যাসে এই ঘটনার উল্লেখ আছে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে সেই দুর্ঘটনার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে দায়ী করেছিলেন মোদী। এবারে পদপিষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনার দায় কি তাহলে স্বয়ং মোদীজির উপরে বর্তাবে?