পূর্ব প্রকাশিতর পর
ইংলন্ডের মূল ভূখন্ডে সশস্ত্র বাহিনীতে ছিল ১২ লক্ষ ৭০ হাজার লোক (আর সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে— ১৬ লক্ষ ৬২ হাজার ৬০০টি তোপ আর মর্টার কামান, ৫৪৭টি ট্যাঙ্ক, ৩,৮৯১টি বিমান, প্রধান প্রধান শ্রেণীর ৩২৮টি যুদ্ধ-জাহাজ ও নৌ-বাহিনীর ১,২২২টি জঙ্গী বিমান।
Advertisement
ফ্যাসিস্ট জার্মানির রণনীতি যে-মতবাদটির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল সেই মতবাদটির নাম হল ‘ব্লিট্সক্রিগ’— অর্থাৎ ‘বিদ্যুৎগতির যুদ্ধ’।
Advertisement
এই ধারণা অনুসারে, বিজয় লাভ করা উচিত অল্প সময়ের মধ্যে— শত্রু কর্তৃক তার সশস্ত্র বাহিনী এবং সামরিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতার পূর্ণ ব্যবহারের আগেই। ‘ব্লিট্সক্রিগ’ মতবাদে প্রতিফলিত হয় ফ্যাসিস্ট জার্মানির আগ্রাসন নীতি, তা জার্মানির রাজনীতিজ্ঞ আর সামরিক নেতাদের হঠকারী চিন্তাধারা গড়ে তোলে৷
এবং জার্মান সমরবাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যগুলোর আয়ু বৃদ্ধি করে।
ইতালিতে সামরিক মতাবাদের সার কথাটি ছিল বায়ু যুদ্ধ। সেই সঙ্গে উভয় দেশেই ট্যাঙ্ক যুদ্ধের উপরও বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হত। ফ্রান্সে ‘অবস্থানমূলক যুদ্ধের’ মতবাদের প্রাধান্য ছিল, আর ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে— ‘সমুদ্র শক্তির’ মতবাদের।
২। দূর প্রাচ্যে যুদ্ধের জ্বালামুখ
ফ্যাসিস্ট জার্মানির মতো সমরবাদী জাপানও সর্বশক্তি দিয়ে বিশ্বাধিপত্যের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম চালাতে প্রস্তুত হচ্ছিল। সুদীর্ঘ বছর ধরে সে সোভিয়েত দূর প্রাচ্যে, চীনে ও অন্যান্য এশীয় দেশে আক্রমণাত্মক ক্রিয়াকলাপে লিপ্ত থাকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বৃহৎ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি চালিয়ে যায়। একই সঙ্গে জাপানী সমরবাদীরা পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারগুলো থেকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীদের—ইউরোপের পুঁজিতান্ত্রিক দেশসমূহ আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে— বিতাড়িত করতে এবং সুবিশাল ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়তে প্রয়াস পাচ্ছিল। পশ্চিমের দেশসমূহ ভেবেছিল যে তারা জাপানের আক্রমণকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে পারবে এবং এই আশায় তারা তাকে স্ট্র্যাটেজিক কাঁচামাল দিয়ে সাহায্য করছিল, তার কাছে লৌহ আকরিক, তেল ইত্যাদি বিক্রি করছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও নেদার্ল্যান্ডস থেকে জাপান পেল সমস্ত আমদানিকৃত সামরিক সামগ্রীর ৮৬ শতাংশ। বোঝাই যায় যে প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে বঞ্চিত জাপান এই বিপুল পরিমাণ স্ট্র্যাটেজিক মাল না পেলে কিছুতেই যুদ্ধ করতে পারত না।
এই ভাবে, ইংলন্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী সোভিয়েতবিরোধী নীতি কেবল ফ্যাসিস্ট জার্মানিকেই নয়, সমরবাদী জাপানকেও ক্রিয়াকলাপের স্বাধীনতা দিচ্ছিল এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আক্রমণে অনুপ্রাণিত করছিল। সেই ১৯২৭ সালেই তথাকথিত ‘তানাকা স্মারকলিপিতে’ চীন, ভারত ও অন্যান্য এশীয় দেশ দখলের জাপানী পরিকল্পনাগুলোর উল্লেখ ছিল। তাতে বিশেষভাবে বলা হয়েছিল যে চীন দখলের জন্য জাপানকে ‘প্রথমে মাঞ্চুরিয়া ও মঙ্গোলিয়া অধিকার করতে হবে।
পৃথিবী দখল করতে হলে আমাদের প্রথমে চীন অধিকার করতে হবে। আমরা যদি চীন দখল করতে সক্ষম হই, তাহলে এশিয়া মাইনরের বাদবাকী দেশগুলো ভারত আর দক্ষিণ সমুদ্রসমূহের দেশগুলোও আমাদের ভয় করবে এবং আমাদের সামনে আত্মসমর্পণ করবে। দুনিয়া তখন বুঝে নেবে যে পূর্ব এশিয়া আমাদের, এবং আমাদের অধিকার প্রসঙ্গে কোন প্রশ্ন তুলতে সাহস পাবে না… চীনের সমস্ত সম্পদ আত্মসাৎ করে আমরা ভারত, দক্ষিণ সমুদ্রসমূহের দেশগুলো দখল করতে আরম্ভ করব, আর তারপর এশিয়া মাইনর, মধ্য এশিয়া এবং অবশেষে ইউরোপ অধিকারের কাজে হাত দেব’।
সমরবাদী জাপান তার সৈন্য বাহিনীর পুনর্সংগঠন ও পুনরস্ত্রসজ্জিতকরণের ব্যাপারে কিছু ব্যবস্থা অবলম্বনের পর তার আগ্রাসনমূলক পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়িত করতে লাগল। ১৯৩১ সালে সে দখল করে নিল উত্তর-পূর্ব চীন (ওখানে মাঞ্চু-গো নামে একটি ক্রীড়নক রাষ্ট্র গড়ল) এবং অভ্যন্তরীণ মঙ্গোলিয়ার একটি অংশ।
মাঞ্চুরিয়া নিয়ে নেওয়ার পর জাপানী সমরবাদীরা সমগ্র চীন দখলের জন্য এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধানার জন্য একটি পাদভূমি প্রস্তুত করতে আরম্ভ করল। জাপান ও মাঞ্চুরিয়ার কলকারখানাগুলোতে কাঁচা লোহা, আর ইস্পাত গালাইয়ের পরিমাণ, কয়লা নিষ্কাশন ও কৃত্রিম তেল উৎপাদন বৃদ্ধি পেল।
(ক্রমশ)
Advertisement



