অতনু রায়:
‘আপনারা সবাই থাকুন, থিয়েটার দেখুন। আর আপনারা যদি বলেন যে আমরা থাকব না, তাও থিয়েটার হবে। ফাঁকা গ্যারেজে হলেও হবে, স্কুল বাড়িতে হলেও হবে, সমুদ্রের ধারে হলেও হবে’, বক্তা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু। এই প্রজ্ঞার সঙ্গেই শুরু হল পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির আয়োজনে ২৫তম নাট্যমেলা। চলবে ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত। রবীন্দ্রসদনে উদ্বোধনের মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী ব্রাত্য বসু, ইন্দ্রনীল সেন ও অরূপ বিশ্বাস সহ নাট্যব্যক্তিত্ব অর্পিতা ঘোষ, পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমির সভাপতি দেবশঙ্কর হালদার, আকাদেমির সচিব শান্তনু চক্রবর্তী এবং তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগের সমন্বয় অধিকর্তা কৌস্তভ তরফদার।
Advertisement
এই বছর নাট্যমেলায় কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব তৃপ্তি মিত্র, বাদল সরকার এবং ঋত্বিক ঘটকের জন্মশতবর্ষ উদযাপন করা হবে। রবীন্দ্রসদন, গিরিশ মঞ্চ, রবীন্দ্রতীর্থ, শিশির মঞ্চ, তৃপ্তি মিত্র নাট্যগৃহ, একতারা মুক্ত মঞ্চ, গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালা মিলেই হচ্ছে এবারের নাট্যমেলা। ছোট বড় সব মিলিয়ে এবার মোট ১৬১টি দল অংশগ্রহণ করছে। এবারের মেলার মোট বাজেট কমবেশি ১ কোটি ৪৮ লক্ষ টাকা।
Advertisement
ব্রাত্য বসুর ভাবনায় গগনেন্দ্র শিল্প প্রদর্শশালায় ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে তৃপ্তি মিত্র’র জীবন আধারিত প্রদর্শনী ‘অপরাজিতা’। ব্রাত্য বসুর সম্পাদনায় ‘চর্চা’ পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ‘অপরাজিতা’র আনুষ্ঠানিক প্রকাশও হয় উদ্বোধনী মঞ্চে। আগামী ৪ জানুয়ারি মিনার্ভার পক্ষ থেকে মিনার্ভা ন্যাশনাল থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল করা হবে।একতারা মুক্তমঞ্চে থাকছে খন, ডোমনি, আলকাপ, বেণী পুতুল, ডাং পুতুল, রং পাঁচালি, ভাঁড়যাত্রা, বহুরূপী ও রণপা সহ বিভিন্ন ধারার লোক নাটক।
দেবশঙ্কর হালদার তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘নাটক করার সময় আমি অরূপ বিশ্বাসকে দর্শক আসনে একাধিকবার দেখেছি। নাট্যের প্রতি ব্রাত্যের প্রেম সর্বজনবিদিত। মেলার খুঁটি পোঁতা থেকে শুরু করে পুরোটায় ও থাকে। ইন্দ্রনীলও সব খুঁটিনাটি খবর নেয়, তাই বোঝা যায় যে ওঁরও নাট্যকে কেন্দ্র করে একটা উৎসাহ আছে। আসলে মুখোমুখি বসবার জায়গাটা নাট্য করে দেয়। যে নাটক দেখে না, তাকে বলুন যে এমন একটা জায়গায় তোমাকে নিয়ে যাব যেখানে তুমি জীবন্ত মানুষের কারবার দেখতে পাবে।’
ব্রাত্য বসু বলেন, ‘অরূপ বিশ্বাস যাত্রা আকাদেমির সভাপতি। ইন্দ্রনীল সেন সঙ্গীত আকাদেমির সভাপতি। অর্পিতা ঘোষ শিশু কিশোর নাটক আকাদেমির সভাপতি এবং আমি বাংলা আকাদেমির সভাপতি। আমাদের প্রত্যেকের রাজনৈতিক পরিচয় আছে। দেবশঙ্কর হালদার আমাদের সময়ের একজন সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পক্ষপাতহীন মানুষ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন একজনকে সভাপতি হিসেবে বেছেছেন, যিনি থিয়েটারের ব্যাপার সবটা বোঝেন এবং কোনো নির্দিষ্ট পক্ষ নেবেন না। ওঁর সভাপতিত্বে কাজগুলো সুচারু ও সুষ্ঠুভাবে হয়ে যাবে।’
ইন্দ্রনীল সেন বলেন, ‘২০১১ সালের পর থেকে বাংলার নাট্য চর্চাকে শুধুমাত্র কলকাতায় নয়, ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে জেলায় জেলায়। এর কৃতিত্ব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আবার ২০২৬ সালে চতুর্থবারের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পরের আগামী পাঁচ বছরে আমাদের বাকি পরিকল্পনাগুলোর রূপায়ণ করে ফেলতে পারব। আপাতত কেউ সাত-সতেরো না ভেবে ৭ থেকে ১৭ তারিখ নাট্যমেলায় যোগ দিন।’
অরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘চারপাশে নাটকের মেসি – রোনাল্ডোদের মাঝে আমিই শুধু দর্শক। এটাই নাটকের মাহাত্ম্য যে, একজন দর্শককেও মঞ্চে জায়গা করে দিয়েছেন। দেবশঙ্করের আমি ফ্যান, তাঁর জন্য আমি কয়েক মাইল দৌড়ে গিয়েও নাটক দেখতে প্রস্তুত। সবাই বলে মানুষ খেলা পাগল হয়, আমি বলব নাটক পাগলও হয়। আমি দেখেছি যাঁরা সমস্ত কিছু ছেড়ে নাটক করেন। আমিও চাই সবাই এই পাগলগুলোর পাশে দাঁড়ান, তাঁদের নাটক দেখে সমৃদ্ধ হন।’
অর্পিতা ঘোষ বলেন, ‘২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে প্রথমেই বলেছিলেন যে কলকাতা নয় নাট্যমেলাকে জেলায় জেলায় ছড়িয়ে দিতে হবে। আকাদেমি সেভাবেই এগিয়েছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের দশটা জায়গায় উৎসব হয়ে গেছে, কলকাতায় হয়ে শেষ হবে। পূর্ণ দৈর্ঘ্য, স্বল্প দৈর্ঘ্য, লোকনাটক, অন্তরঙ্গ নাটক, মাইম সমস্ত কিছু মিলিয়ে ১৬৩টা নাটক থাকছে। এর বাইরে সারা বছর ধরে কলেজে কলেজে সেমিনার ও নতুন নাট্য প্রতিভা খুঁজে আনার জন্য নাট্যবিষয়ক বিবিধ কর্মশালা তো হয়ই।’
শিল্প-রাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে ব্রাত্য বলেন, ‘শিল্পের একটা শ্রেণী বিশ্বাস করে, আকবর ছাড়া তানসেন হয় না…বিক্রমাদিত্য ছাড়া কালিদাস হয় না…সিজার ছাড়া ভার্জিল হয় না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রনোদনা লাগবে নাকি লাগবে না, এই দ্বন্দ্ব! আবার এক দলের বিশ্বাস, গালিব আছেন…মান্টো আছেন। যাঁরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ জানাতে জানাতে গেছেন, আনুকূল্য নেননি। সত্যজিৎ রায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কিছু টাকা সাহায্য পেয়েছিলেন, কিন্তু ঋত্বিক ঘটক পাননি। আমার মনে হয়, এই প্রবাহমান দুটো ধারাই পশ্চিমবঙ্গে বরাবর জায়মান থেকেছে। রাষ্ট্রের আনুকূল্য নেবে কিনা আর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ দেখাবে কিনা, দুটোই বাঙালি জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।’
প্রসঙ্গত, গত বছরের মতো এবারেও নাট্য আকাদেমির পক্ষ থেকে ৪০০টি রেজিস্টার্ড দলকে বছরে ৫০০০০ টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। সূত্রের খবর, আগামী বছর থেকে দল এবং অনুদান দুইই বাড়ানোর ভাবনা আছে আকাদেমির।
Advertisement



