অচেনা মুখ দেখলেই মুখে কুলুপ সীমান্ত বাসীর

পুলিশ এবং বিএসএফের কড়া নজরদারির ফলে পাচারকাজ চালাতে বেশ কিছু সময় অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয় পাচারকারীদের। এর মধ্যে পাচারকারীরা বহিরাগত হওয়ায় খুব সহজেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়াতে এক নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে পাচারকারীরা।

Written by Rakesh Shil North 24 Parganas | April 19, 2019 6:45 am

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি (Photo: iStock)

পুলিশ এবং বিএসএফের কড়া নজরদারির ফলে পাচারকাজ চালাতে বেশ কিছু সময় অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয় পাচারকারীদের। এর মধ্যে পাচারকারীরা বহিরাগত হওয়ায় খুব সহজেই ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পুলিশ-প্রশাসনের নজর এড়াতে এক নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে পাচারকারীরা। বাদুড়িয়া, স্বরূপনগর, গাইঘাটার আংরাইল, সুটিয়া, হাসনাবাদের সীমান্তবর্তী গ্রাম ঘােরার পর স্থানীয়দের কথায় উঠে এসেছে এই তথ্য। ‘চেনামুখ’ অর্থাৎ সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের পাচারকাজে লাগিয়ে কিছুটা হলেও নিশ্চিত হতে চাইছে পাচারকারীরা। এই কাজে বিশেষ করে গ্রামের বেকার যুবক অথবা মাঝবয়সী লােকজনকে কাজে লাগানাে হচ্ছে।

প্রকাশ্যে এবিষয় নিয়ে আলােচনা না করলেও হাসনাবাদ, স্বরূপনগর সীমান্তের বাজার বা চায়ের দোকানের আড্ডায় যােগ দিয়ে কান পাতলেই শােনা যায় এ সমস্ত কথা। শেখ শামিম নামে এক যুবকের কথায়, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছেন গ্রামের বহু যুবক। চাষবাস ছাড়া সেভাবে কোনও কাজ না মেলায় বহু যুবকই এই পাচার কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছে বাধ্য হয়েই। ‘চেনামুখ’ পছন্দ ওদের। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, অচেনা মুখের মানুষজন এই পাচার কাজ করলে স্বাভাবিকভাবে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে আর পুলিশ বা বিএসএফের জেরার মুখে পড়তে হয়। তাই চেনামুখ অর্থাৎ গ্রামের কাউকেই যদি একাজে নিয়ােগ করা যায়, তাতে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। তাই চেনামুখেই ভরসা করছে পাচারকারীরা।

গ্রামবাসীদের মধ্যে যদি কেউ একাজ করে, তবে পাচারসামগ্রী যেমন রাখার অসুবিধা নেই, তেমনই পুলিশ-বিএসএফের নজরদারি জোরদার হলে সেই গ্রামবাসীর বাড়ি আত্মীয় হিসেবে থেকে যাওয়ারও সুবিধা রয়েছে। গ্রামবাসীরা যে এ কাজ করতে চান, তা নয়, কিন্তু কখনও হুমকি আবার কখনও মারধরের ভয় দেখিয়ে নিযুক্ত করা হয় এ কাজে। বর্তমানে সমগ্ৰী পাচারের বিনিময়ে নগদ অর্থ নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সােনা দিয়েই কাজ চালাচ্ছে পাচারকারীরা, কয়েক দফায় পাচারসামগ্রী পাঠানাের পর সেই মূল্যের সােনার বাট দিয়ে চোকানাে হয় মুল্য। যেসকল ব্যক্তি পাচার কাজে যুক্ত থাকে, তারাই চাষের কাজ করতে বা গবাদি পশু মাঠে চড়াতে যাওয়ার সময়ই সেই সােনা নিয়ে আসে এবং তা নির্দিষ্ট ব্যক্তির হাতে তুলে দেয়। এর বদলে মেলে সামান্য কিছু অর্থ। ইচ্ছে না থাকলেও প্রাণভয়ে একাজ করতে বাধ্য হন বাসিন্দারা।

তরিকুল মােল্লা (নাম পরিবর্তিত) নামে এক কৃষক জানালেন, পাচারকারীদের কথা অমান্য করে তার চাষের জমি ব্যবহার করতে দিতে রাজি না হওয়ায় পরের দিন রাতে ধানখেত নষ্ট করে দিয়েছিল পাচারকারীরা। তাই অনেক সময় পাচার কাজ সঠিক নয় জেনেও বাধ্য হয়ে অনেককে এ কাজ করতে হয়।

সীমান্তবর্তী গ্রাম এলাকায় ঘুরতে গিয়ে একটি নতুন বিষয় নজরে এল। গ্রামের সকলে কাজ শেষে পড়ন্ত বেলায় একসঙ্গে আড্ডায় মেতে উঠেছে। চলছে রাজনীতি থেকে গ্রামের নানান অসুবিধার কথা। এরকমই এক আড্ডায় হাজির হতেই অচেনা মুখ দেখে হঠাৎই সকলে নির্বাক হয়ে গেলেন। কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলেও তেমন কোনও উত্তর মিল না। কিছুদূর যাওয়ার পর এক বৃদ্ধের কাছে একথা বলতেই, তিনি বললেন, অচেনা লােক দেখলে তার সঙ্গে কথা বলতে পাচারকারীদের নিষেধ আছে। সেই ব্যক্তি সম্পর্কে না জেনে কোনও কথা বলা যাবে না এটাই নির্দেশ। যদি এই নির্দেশ না মেনে কথা বলা হয় তবে সেকথা তাদের (পাচারকারীদের) কানে গেলে শাস্তির মুখে পড়তে হতে পারে। তাই অচেনা লােক দেখলে মুখে কুলুপ আঁটেন গ্রামবাসীরা। এরপরই শহর থেকে এসেছি একথা শুনতেই ওই বৃদ্ধও তড়তড়িয়ে এগিয়ে গেলেন, আর কোনও কথার জবাব দিলেন না তিনি। ভােট আসে ভােট যায় কিন্তু পাচার রােধে নানান প্রতিশ্রুতি মিললেও তা পূরণ হয় না।

এর ফলে নিরীহ গ্রামবাসীরা অনিচ্ছা সত্ত্বেও পাচারকারীদের ভয়ে পাচারে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য হন। তা না হলে ধনেপ্রাণে মারা পড়তে হতে পারে। আবার পাচার করতে গিয়ে ধরা পড়লে আইনের কঠোর শাস্তির খাঁড়াও নেমে আসতে পারে মাথার উপর। তাই সকলেরই একান্ত আশা, প্রশাসন এ বিষয়ে যথেষ্ট কঠোর হােক। পাচারকারীদের হুমকি, অত্যাচারের ভয়মুক্ত হয়ে সুস্থ জীবনযাপন করতে প্রশাসন তার আইনের হাত প্রসারিত করুক কঠোরভাবে, এটাই এখন একান্ত প্রার্থনা সীমান্তবর্তী এলাকায় বসবাসকারী সাধারণ মানুষজনের। 

পড়ুন । বড়লােক হওয়ার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্বান্ত সীমান্তের বেকার যুবকরা

পড়ুন । ‘জমির আল’, ‘উঠোন’ ভাড়া দিয়ে সীমান্তে রমরমিয়ে চলছে পাচার কাজ