‘সংকীর্ণ পথ প্রসারিত হােক, বড়দিনে বড় হােক ভাবনা’, প্রার্থনা নাগরিক সমাজের

কোলাহল থাকুক, কলহ শেষ হয়ে যাক। ভয়, দ্বেষ, ঘৃণা বাদ দিয়ে বড়দিনের ভাবনা বড় করার ডাক দিল নাগরিক সমাজ।

Written by Tuhina Mandal Kolkata | December 26, 2019 1:34 pm

বড়দিন উপলক্ষে কলকাতার সেন্ট পলস ক্যাথেড্রালে ভিড়। (Photo: Kuntal Chakrabarty/IANS)

কোলাহল থাকুক, কলহ শেষ হয়ে যাক। ভয়, দ্বেষ, ঘৃণা বাদ দিয়ে বড়দিনের ভাবনা বড় করার ডাক দিল নাগরিক সমাজ। আলােয় মােড়া রাজপথ। রঙিন ঠোঁট কিঞ্চিৎ বঙ্কিম করে চলছিল দেদার সেলফি ক্লিক। মাথায় সান্তা টুপি চাপিয়ে ভিড়ের মধ্যে হাঁটছিল কলকাতার যিশু। উৎসবের আমেজে ডুবেছিল তিলােত্তমাবাসী। বড়দিনের উৎসব, উৎসবের বড়দিন। আর এই দিন থেকেই ভাবনাগুলাে হাওয়া, বাতাস পাক, সতেজ হােক চাইছে শহরবাসী।

‘কাল দেখলাম, ছেলেটার প্রতিবাদী কণ্ঠ হঠাৎ থেমে গেল জলকামানের আঘাতে’। ‘ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত হাত নিয়ে প্রাণপণে বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছিল ছেলেটা, কিন্তু একটা বুলেট বুকের এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিল’। ‘রাজনীতির মঞ্চে ব্যক্তিগত আক্রমণ’। এই সব শব্দর অস্বস্তি মিটে যাক বড়দিনেই, দাবি সব প্রজন্মের, সব পেশার, সব প্রান্তের বাসিন্দাদের মধ্যে।

এনআরসি এবং সংশােধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদ জানিয়ে মঙ্গলবারই পথ হেঁটেছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী তন্দ্রাণি মিত্র। এই ছাত্রীর কথায়, মেয়েবেলাটা এত ঘেরাটোপ, চিন্তা, বিভাজনের বাইরে ছিল। দিন দিন বিভাজনের ফাটলটা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। বড়দিনে এই সংকীর্ণতা আর বিভাজনের ‘স্পষ্ট ফাটল’-এর ক্ষত সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাক, যিশুর কাছে এটাই প্রার্থনা, জানান তন্দ্রাণি।

উত্তর কলকাতার একটি শ্মশানঘাটে পৌরােহিত্যের কাজ করেন কমল ভট্টাচার্য। বড়দিনের আনন্দে মেতেছিলেন তিনিও। ওয়াইন বা সান্তাটুপি পরে নয়, গঙ্গার ঘাটের পাশে বসে ছয় টাকার কেক খেতে খেতে কমলবাবুর আক্ষেপ, ‘সােমবার স্ত্রীকে ট্রপিকালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু বাস আর নড়ে না’, আক্ষেপের সুর এই প্রবীণের কণ্ঠে। তাঁর কথায়, প্রতিবাদ বা সমর্থন হােক, কিন্তু পথ আটকে নয়। সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করার মানসিকতার পরিবর্তন হােক, বড়দিনে এমনটাই আর্জি কমলবাবুর কণ্ঠে।

এদিকে ভাবনা বড় করার প্রথম ধাপ চেতনা বৃদ্ধি এমনটাই, জানান শিল্পী শুভাপ্রসন্ন। তাঁর কথায়, ক্ষমা পরম ধর্ম। মানুষের মনে চেতনা জাগানাের বার্তা দেয় বড়দিন। হিংসা, দ্বেষ-এর শেষ হােক বড়দিনে, এমনটাই জানান তিনি। কিছুটা একই সুর শােনা গেল তরুণ কবি রেজমানের কণ্ঠে। তাঁর কথায়, যেখানেই হিংসা হবে, সেখানেই গর্জে উঠবে তাঁর প্রতিবাদী কলম। কিন্তু প্রতিবাদী কলম হবে যুক্তিবাদী, দাবি রেজমানের। এই তরুণ কবির কথায়, আমাদের সংস্কৃতিতে প্রতিবাদী ভাষা আলাদা। সেই ভাষাতে রক্তচোখের জায়গা নেই। রাখিবন্ধন উৎসবের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সর্বকালীন সেরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন বলে জানান রেজমান বড়দিনের পর আগামী দিনে রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যাতে প্রতিবাদ করেন সাধারণ মানুষ, এমনটাই ইচ্ছে রেজমানের।

রাজনীতির মঞ্চে নিজের বক্তব্য রাখার জন্য সুর উঁচু করতে হয় তাঁকে। কিন্তু রাজনৈতিক আক্রমণ যাতে কখনওই ব্যক্তিগত স্তরে না পৌঁছায় বড়দিনে এমনটাই জানালেন কলকাতা পুরসভার মেয়র পারিষদ (উদ্যান) দেবাশিস কুমার। তাঁর কথায়, লড়াইটা রাজনৈতিক মতাদর্শের, ব্যক্তিগত নয়। ঘাত-প্রতিঘাত থেকে অল্প সরে গিয়ে শিল্প আর শিল্পীসত্তার বিস্তার হােক, এমনটাই চাইছেন কুমােরটুলির মৃৎশিল্পী রতন পাল। তাঁর কথায়, আগে মুর্তি গড়ার পাশাপাশি অনেক হাতের কাজ করতেন তিনি। কিন্তু দিন দিন সেই শিল্পের কদর কমছে। পেট চালানাের তাগিদে সেই হাতের কাজও তিনি বন্ধ করেছেন দীর্ঘদিন। রতনবাবুর কথায়, চারপাশের সকলে ভাল থাকুক আর এই ছােট্ট ছােট্ট হাতের কাজ আরও কদর পাক, বড়দিনে এটাই তিনি উপহার চান সান্তার থেকে।

বড়দিন শেষ। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই সরিয়ে ফেলা হবে রাস্তাজোড়া আলােকসজ্জা, মােড়ের মাথায় বসানাে ক্রিসমাস ট্রি। বড়দিনে ভাবনাগুলাে বড় হােক, যিশুর কাছে প্রার্থনা সব পক্ষের।