• facebook
  • twitter
Saturday, 20 December, 2025

ভারতীয় সিনেমার অন্যতম স্থপতি: বীরেন্দ্রনাথ সরকার

প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তাঁর চেয়ে মাত্র দুবছরের বড় বীরেন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত গভীর। ১৯৪০-এ প্রমথেস নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে চলে যাওয়ায় গভীর আঘাত পেয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ। এমনকি মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এমনকি তাদের সম্পর্কও নষ্ট হয়নি কখনও | মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্রমথেস। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী শবযাত্রা বীরেন্দ্রনাথের এলগিন রোডের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়, যাতে মৃত্যুর পরেও বন্ধুকে শেষ দেখা দিয়ে যেতে পারেন।

ফাইল চিত্র

সুব্রত রায়

বাংলা নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব প্যারিচরণ সরকারের ছেলে নৃপেন্দ্রনাথ সরকার ছিলেন অভিভক্ত বাংলার এডভোকেট জেনারেল। ব্রিটিশ সরকার তাকে নাইট উপাধি দিয়েছিল। তাঁর মেজ ছেলে বীরেন্দ্রনাথ এর জন্ম ১৯০১এর ৫ই জুলাই। পড়াশুনা প্রথমে হিন্দু স্কুল তারপট প্রেসিডেন্সিতে। বয়স যখন বাইশ তখন সে কালের প্রথা মেনে বিয়ে দেওয়া হলো চোরবাগানের মিত্র বাড়ির বারো বছরের মেয়ে অমিয়বালার সঙ্গে। বিয়ের পরেই বীরেন্দ্রনাথকে লন্ডনে পাঠানো হলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। পাঁচ বছর পরে ফিরে এসে বিলেতফেরত বীরেন্দ্রনাথ কলকাতায় তাঁর নিজের ব্যাবসা শুরু করলেন| পার্টনার আরও এক ইঞ্জিনিয়ার প্রমথনাথ রায়। তাঁর মাধ্যমেই আলাপ হলো হরেন ঘোষের সঙ্গে। হরেনবাবু তখন “বুকের বোঝা” নামে একটি ছবি করছিলেন। টাকার অভাবে মাঝপথে সেটির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তখন টাকা দিলেন বীরেন্দ্রনাথ। ১৯৩০ সালের নভেম্বরে কলকাতার “পূর্ণ” সিনেমায় ছবিটি মুক্তি পেল এবং বক্সঅফিসে মুখ থুবড়ে পড়ল। কিন্তু টাটা দমলেন না বীরেন্দ্রনাথ। ব্যবসার পার্টনার প্রমথনাথ ও বন্ধু অমর মল্লিককে সঙ্গে নিয়ে ১৯৩০ এর ডিসেম্বরে তৈরী করলেন, “ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ক্রাফট”। দুটি নির্বাক ছবি” চাষার মেয়ে”ও “চোরকাঁটা” নির্মিত হলো এই সংস্থার অধীনে। প্রথমটি পরিচালনা করলেন চারু রায়, মুক্তি পেল ১৯৩১ এর এপ্রিলে এবং দ্বিতীয়টির পরিচালক প্রফুল্ল রায়, মুক্তি পেল সেপ্টেম্বরে দুটি ফ্লপ।

Advertisement

বীরেন্দ্রনাথ এর মধ্যেই শহরের দক্ষিণ প্রান্তে রয়‍্যাল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাবের কাছে বিঘে দশেক জমি লিজ নিয়েছেন বাসন্তী কটন মিলের মালিকদের কাছ থেকে। জঙ্গল পরিস্কার করে গড়ে তুলেছেন বিরাট এক স্টুডিও। তৈরি করেছেন বড় বড় দুটি ফ্লোর, রেকর্ডিং রুম, ল্যাব, ক্যান্টিন, অফিস ঘর। বাকি জমিতে সুসজ্জিত বাগান, নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ, ঘাট বাঁধানো পুকুর, খেলার মাঠ। ১৯৩০ এর ১৯শে সেপ্টেম্বর স্টুডিওর উদ্বোধন হলো | নাম “নিউ থিয়েটার্স। প্রতীক হলো হাতির মুখ। কিন্তু স্টুডিওতে তো ছবি তৈরি করতে হবে, সে ছবি দেখতে গেলে নিজেদের প্রেক্ষাগৃহও চায়। অতএব ওই বছরই খোলা হলো আধুনিক দুটি সিনেমাহল। একটি উত্তর কলকাতায়, নাম চিত্রা, (পরে মিত্র) এবং অন্যটি মধ্য কলকাতায় নাম “নিউ সিনেমা।

Advertisement

১৯৩১ সালের ১০ই ফেব্রুয়ারি “দি নিউ থিয়েটার্স লিমিটেড” কোম্পানি হিসাবে রেজিস্ট্রেশন পেল। বীরেন্দ্রনাথ ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এবং প্রমথনাথ চিফ এগজিকিউটিভ | কলকাতা তখন অভিভক্ত ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির অন্যতম কেন্দ্র। যেখানে ম্যাডান থিযেটার্স কোম্পানির একচ্ছত্র আধিপত্য। সিংহল ও ব্রম্ভদেশ পর্যন্ত তাদের সাম্রাজ্য বিস্তৃত | কানন দেবী, সরজুবালা, অহিন্দ্র চৌধুরী সব তাদের মাইনে করা শিল্পী। নামি বলতে নিউ থিয়েটার্স এ কেবল আছেন ওমর মল্লিক। এবং এর উপরই স্টুডিওর শিল্পী নির্বাচনের দায়িত্ব। অতএব তিনি উঠে পরে লাগলেন শিল্পা জোগাড় করতে। নিয়ে এলেন দুর্গদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, নিভাননী-সহ আরো অনেকে।

বম্বেতে ইম্পেরিয়াল মুভিটোন তখন আরদেশীর ইরানির পরিচালনায় পৃথ্বীরাজ কাপুর, জুবেইদা ও মাস্টার বিঠলকে নিয়ে ভারতের প্রথম টকি “আলম আরা” তৈরি করছে। বীরেন্দ্রনাথ চলে গেলেন বোম্বে | টকি তৈরির প্রযুক্তি জানতে। ফিরে এসে তৈরি করলেন তাঁর “নিউ থিয়েটার্স”এর ব্যানারে তাঁর প্রথম ছবি “দেনাপাওনা” কাহিনী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, পরিচালনায় প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, ক্যামেরা নীতিন বসু, সংগীত রাইচাঁদ বড়াল | অভিনয়ে দুর্গদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অমর মল্লিক, জহর গঙ্গোপাধ্যায়, নিভাননী প্রমুখ। বীরেন্দ্রনাথের উদ্যোগে প্রথম ছবিটিই ছিল টকি। কাজ শেখানোর জন্য বহু টাকা ব্যয় করে বম্বে থেকে আনা হয়েছিল উইলিয়াম ডেমিংকে। যিনি “আলম আরা” তে শব্দের কাজ করেছিলেন।
বোম্বের ম্যাজেস্টিক সিনেমায় প্রথম ভারতীয় সবাক ছবি “আলম আরা” মুক্তি পেল ১৯৩১ সালের ১৪ই মার্চ। ম্যাডান থিয়েটার্সর ব্যনারে, অমর চৌধুরীর পরিচালনায় প্রথম বাংলা টকি “জামাই ষষ্টি” মুক্তি পেল ১৯৩১ এর ১১ই এপ্রিল কলকাতার ক্রাউন সিনেমায়। আর নিউ থিয়েটার্স এর প্রথম ছবি “দেনাপাওনা”মুক্ত পেল কলকাতার “চিত্রা”সিনেমা হলে। ১৯৩১ এর ৩০ শে ডিসেম্বর।

এবার তিনি রবীন্দ্রনাথকে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর “নটির পূজা” নিত্রনাট্যটিকে চিত্ররূপ দেওয়ার জন্য। রবীন্দ্রনাথ সম্মত হলেন। সাড়ে দশ হাজার ফুটের ছবিটির শুটিং শেষ হয়ে গেল চার দিনের মধ্যে। ছবিতে কবি স্বয়ং অভিনয় করলেন। রবীন্দ্রনাথের পরিচালনায় একমাত্র চলচ্চিত্র “নটির পূজা” মুক্তি পেল ১৯৩২ সালের ২২শে মার্চ চিত্র সিনেমায়। এই ছবির ক্যামেরার দায়িত্বে ছিলেন নীতিন বসু। এই একটি জায়গাতে রবীন্দ্রনাথের দানবীয় প্রতিভা থমকে গেল। ছবিটি একেবারেই চলচ্চিত্রের ভাষা ব্যাবহার করেনি। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে নৃত্যনাটিকে ক্যামেরাতে তুলে রাখা হয়েছে মাত্র। এই একই বছরেই নিউথিয়েটার্সের হিন্দি ছবি” মহব্বত কি আসু”তে আত্মপ্রকাশ করলেন সিনেমার প্রথম গায়ক নায়ক কুন্দনলাল সায়গেল। অবশ্য সায়গলকে তারকা হয়ে উঠতে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বীরেন্দ্রনাথ প্রথম সাফল্যের মুখ দেখলেন দেবকী বসুর “চণ্ডীদাস” ছবিতে। ১৯৩২ এর ২৪ শে সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়ে ছবিটি চলেছিল টানা ৬৪ সপ্তাহ। ছবিটির বিপুল বাণিজ্যিক সাফল্যে বীরেন্দ্রনাথ ছবিটির হিন্দি সংস্করণ তৈরি করলেন। নীতিন বসুর পরিচালনায় হিন্দি “চণ্ডীদাস” মুক্তি পেল ১৯৩৪ সালে। শুরু হলো একই ছবি দুটি ভাষায় তৈরি করার এক নতুন উদ্যোগ | ভারতীয় সিনেমায় “ডাবল ভার্সন” ছবি করার প্রথম উদ্যোক্তা কিন্তু বীরেন্দ্রনাথই।

১৮৩৪ সালেও নিউ থিয়েটার্সে এলেন গৌরীপুরের রাজকুমার প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। কিন্তু তার প্রথম ছবি “রূপরেখা”ফ্লপ করলো। প্রমথেস শরৎচন্দ্রের কাছে গিয়ে তাঁর “দেবদাস” উপন্যাসটিকে ছবি করার জন্য অনুমতি চাইলেন। শরৎচন্দ্র মোটেও রাজি হলেন না। এটি তাঁর কম বয়সের একটি অতি কাঁচা লেখা। তিনি প্রমথেশকে পরামর্শ দিলেন, তাঁর অন্য কোনো উপন্যাস নিয়ে ছবি করতে। কিন্তু রাজপুত্রের জেদ, তাঁর ওই “দেবদাস”ই চায়। ১৯৩৫- এ মুক্তি পেল “দেবদাস”। বাকিটা তো ইতিহাস।

প্রমথেশ বড়ুয়ার সঙ্গে তাঁর চেয়ে মাত্র দুবছরের বড় বীরেন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব ছিল অত্যন্ত গভীর। ১৯৪০-এ প্রমথেস নিউ থিয়েটার্স ছেড়ে চলে যাওয়ায় গভীর আঘাত পেয়েছিলেন বীরেন্দ্রনাথ। এমনকি মুখ ফুটে কিছু বলেননি। এমনকি তাদের সম্পর্কও নষ্ট হয়নি কখনও | মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে প্রয়াত হন প্রমথেস। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী শবযাত্রা বীরেন্দ্রনাথের এলগিন রোডের বাড়ির সামনে দাঁড়ায়, যাতে মৃত্যুর পরেও বন্ধুকে শেষ দেখা দিয়ে যেতে পারেন।

নিউথিয়েটার্স তাঁর বাণিজ্য বিস্তার করেছিলেন সুদূর লাহোর পর্যন্ত। বীরেন্দ্রনাথ সেখানে “নিউ ইন্ডিয়া ফিল্ম স্টুডিও”তৈরি করেন ১৯৩৪ সালে। ১৯৩৭ এ স্টুডিওটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ সব কিছু মিলিয়ে চলচ্চিত্র শিল্প গভীর সংকটে পরে। ফিল্ম ইন্দ্রাস্ট্রিতে বিপুল পরিমাণ কালো টাকার অনুপ্রবেশ এই শিল্পের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। সর্বত্র বড় বড় স্টুডিও গুলি বন্ধ হয়ে যায়। মোটামুটি পাঁচের দশকের মাঝামাঝি থেকে

নিউ থিয়েটার্স বন্ধ হয়ে যায়। বীরেন্দ্রনাথ বাড়ি থেকে বেরোনো প্রায় বন্ধ করে দেন। বিভিন্ন ভাষায় ১৩০ টি ছবি প্রযোজনা করার যে মানুষটি ভারতীয় সিনেমা কে বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্টিত করেছেন, তাঁর সেই স্বপ্নের স্টুডিও বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ব্যাক্তিগত সংসারের ছোট্ট গন্ডির মধ্যে তিনি নিজেকে স্বেচ্ছাবন্দি করে ফেলেন। পারতপক্ষে চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকল বিষয় ও মানুষকেই তিনি এড়িয়ে চলতে থাকেব। ভারত সরকার ১৯৭০ সালে তাঁকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার এবং ১৯৭২ সালে পদ্মভূষণ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৮০ সালের ২৮ শে নভেম্বর ভারতীয় সিনেমার অন্যতম স্থপতি বীরেন্দ্রনাথ সরকারের জীবনাবসান হয়। তাঁর সঙ্গে শেষ হয়ে যায় ভারতীয় সিনেমার ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়।

Advertisement